আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্ত পূরণে মরিয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের পরতে পরতে থাকবে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ছক।
স্থানীয় শিল্পের কর অবকাশ ও ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা সংকুচিত করে আনা এবং সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ও মোবাইল ফোনে কথা বলা-ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে। দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জুনে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের কথা রয়েছে। এর আগে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির শর্ত পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সফর করবে। এছাড়া দলটি তৃতীয় কিস্তির শর্ত অনুযায়ী কর অব্যাহতি হ্রাস, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়, ভর্তুকি যৌক্তিক করার কৌশল এবং খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করবে। ২৮ জুন এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
জানা গেছে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর প্রশাসন সংস্কার, অব্যাহতি কমিয়ে আনা ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা আইএমএফকে জানানো হবে। ইতোমধ্যে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কনীতি বিভাগ প্রস্তুতি শেষ করেছে। যেমন রাজস্ব আয় বাড়াতে জনস্বাস্থ্যে ঝুঁকি বিবেচনায় প্রতিবছরের মতো এবারও সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হবে।
মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে। খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে ব্যাপকভাবে ইএফডি (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) মেশিন স্থাপনের রূপরেখা থাকবে। এছাড়া ২০২৫ সালের জুন নাগাদ যেসব স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলোর নতুন করে সুবিধা দেওয়া হবে না।
একইভাবে বাজেটে আয়কর খাতে কর অবকাশ সুবিধা কাটছাঁট করা হবে। বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় বাড়াতে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ কর হার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে। করজাল বাড়াতে নতুন কর অঞ্চলগুলোর কার্যক্রম জোরদারের পরিকল্পনা থাকবে। শুল্ক খাতে আগামী বাজেটে নতুন শুল্ক আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা থাকবে। এছাড়া অযাচিত অব্যাহতি পরিমাণ কমিয়ে আনা, বকেয়া শুল্ক আদায় কার্যক্রম জোরদার, আদালতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, শুল্ক আদায় প্রক্রিয়া অটোমেশন এবং কাস্টমস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কার্যকর রূপরেখা থাকবে। নীতি সংস্কার সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনাগুলো প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আইএমএফের শর্তের বেশিরভাগই নীতি সংস্কার সংক্রান্ত। যেমন অব্যাহতির পরিমাণ কমিয়ে আনা ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধির কৌশল প্রণয়ন ইত্যাদি। বাংলাদেশে নীতি সংস্কার গোপনীয়তার সঙ্গে বাজেটের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তাই আইএমএফকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর খাতগুলো সম্পর্কে উপস্থাপনার মাধ্যমে ধারণা দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, কর হার বাড়ানো বা অব্যাহতি কমিয়ে আনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্তের চেয়ে অনেকাংশেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে অনুমোদন সাপেক্ষে জনহিতকর পরিকল্পনাগুলো কার্যকর করা হবে।
খরচ বাড়বে ভোক্তার : ভ্যাট আদায় বাড়াতে ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপরে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলেও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে তা কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর ২ বছর পর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। পরে ২০১৯ সালে এটি ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের এক শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়।
বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৮৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসাবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। মোবাইল সেবার ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তারা ৭৮ টাকার কথা বলতে পারবেন।