যেভাবে খুন করা হয় মিতুকে

পুলিশের বড় সোর্স রাঙ্গুনিয়ার আবু মুছা। তার নির্দেশেই এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসামি মোতালেব ওরফে ওয়াসিম (২৮)।

আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন, মুছা শুধু নির্দেশদাতাই নয় তার গুলিতেই মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে।

তবে অপর আসামি আনোয়ার জবানবন্দিতে দাবি করেছেন, ওয়াসিমের গুলিতেই মিতুর মৃত্যু হয়েছে। যদিও রোববার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার জানিয়েছিলেন, ওয়াসিমের গুলিতেই মৃত্যু হয় মিতুর।

অবশ্য ওয়াসিম স্বীকার করেছেন, মুছার গুলিতে এসপির স্ত্রীর মৃত্যু হলেও তিনি একটি মিস ফায়ার করেছিলেন।

চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হারুন-অর রশীদের আদালতে এ জবানবন্দি দেন ওয়াসিম ও আনোয়ার।

আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়টি জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে মিতুকে আগে থেকে না চেনা এবং খুনের উদ্দেশ্য না জানালেও আবু মুছার নির্দেশেই ভাড়াটে কিলার হিসেবে ৭ সদস্যের কিলিং মিশন হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। এ কথা জানান দু’জনেই।

জবানবন্দিতে তারা বলেন, আবু মুছার নির্দেশে জিইসি মোড়ে এক নারীকে খুনের জন্য তারা গত ৫ জুন ভোরে জড়ো হন। হত্যা মিশনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল মুছার ওপরই।

তার নির্দেশনায় টাকার বিনিময়ে মোট সাতজন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অংশ নেয়। তারা হলেন আবু মুছা, ওয়াসিম, রাশেদ, নবী, কাুল, শাহজাহান ও আনোয়ার।

এছাড়া অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে ভোলা নামে একজনের নামও উঠে এসেছে জবানবন্দিতে।

হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানান, গত ৫ জুন ভোরে জিইসি মোড়ের অদূরে ও আর নিজাম রোডে সাতজনের একটি দল মিতুকে হত্যার জন্য মিশনে অবস্থান নেয়।

মূল হত্যা মিশনে অংশ নেন ওয়াসিম ছাড়াও আনোয়ার,

মুছা ও নবী। এর মধ্যে মিতুকে অনুসরণ করেন আনোয়ার, যাকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে।

পুলিশের উদ্ধার করা ভিডিও ফুটেজে তা দেখা গেছে। ওই দিন ভোর রাতে মুছা ও অন্য একজন মোটরসাইকেলে প্রবর্তক আসে। বাকিরা একটি সিএনজি অটোরিকশায় প্রবর্তক মোড় আসে।

এর আগে কালামিয়া বাজারে মুছা সিএনজি ভাড়া বাবদ ৫শ’ টাকা দেয় ওয়াসিম ও অন্যদের। এভাবে ভোরে ৭ জন প্রবর্তক মোড়ে এসে জড়ো হয়। এরপর তারা হেঁটে গোলপাহাড় এলাকায় পৌঁছে।

ওয়াসিম গোলপাহাড় মন্দিরের বিপরীতে রয়েল হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে মিতু বের হচ্ছে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করে। মুছা ও আনোয়ার মোটরসাইকেল নিয়ে নিরিবিলি হোটেলের সামনে অবস্থান নেয়।

নবী মিতুদের বাসার রাস্তার পাশে টিঅ্যান্ডটি বাক্সের পাশে অবস্থান নেয়। অন্যরাও গোলপাহাড় থেকে জিইসি মোড়ের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। হামলাকারীরা আক্রান্ত হলে অন্যরা যাতে ছুটে আসতে পারে।

মিতু ছেলে মাহিরের হাত ধরে মূল রাস্তায় বের হলে নিরিবিলি হোটেলের সামনে থাকা মুছা বিপরীত দিক থেকে মোটরসাইকেলে মিতুকে ধাক্কা দেয়। এরপর মোটরসাইকেল থেকে নেমে গুলি করে ওয়াসিম।

যদিও সেটি মিস ফায়ার হওয়ায় তার কাছ থেকে গুলি নিজ হাতে নিয়ে মিতুর মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে মোটরসাইকেলে চালকের আসনে থাকা আবু মুছা নিজেই।

এর আগে ছুরিকাঘাত করে গলির মুখে আগে থেকে অবস্থান নেয়া নবী। ঘটনাস্থলে মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মুুছার মোটরসাইকেলে চেপে তিনজন নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। প্রথমে তারা ষোলকবহর যায়।

সেখান থেকে মুছার কালামিয়া বাজারের বাসায় চলে যায় তারা। সেখানে হত্যাকাণ্ডে ব্যাকআপ টিমের অন্য তিন সদস্য এবয় নবীও যোগ দেয়। এদের কাউকে তাৎক্ষণিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা করে দেয় মুছা। তারপর সবাই নিজ নিজ বাসায় চলে যায়।

এদিকে মিতুর খুনিরা ছিল ভাড়াটে। তারা জানতো না কাকে তারা খুন করতে এসেছে। কিলিং মিশন শেষ করার পর টিভিতে খবর দেখে তারা মিতুর পরিচয় জানতে পারে। তখনই সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যায়।

সূত্র জানায়, আবু মুছা নামে এক ব্যক্তির নির্দেশেই ভাড়াটে কিলার হিসেবে ৭ সদস্যের কিলিং স্কোয়াড মিতু হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল বলে জানিয়েছেন দু’জনেই। তবে খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের কিছুই জানা ছিল না।

ওয়াসিম জানান, ঘটনার আগের রাতে ৭ জন মুছার বাসায় মিটিং করে। হত্যার মিশন বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন মুছা।

তবে ওয়াসিম ও আনোয়ার এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীর নাম জানায়নি। মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে হত্যা মিশনে ভাড়া করা হলেও খুনের পর দুই-তিন হাজার টাকার বেশি দেয়নি।

তারা জানান, হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে মুছার মাধ্যমে ভোলা নামে একজন তাদের একটি রিভলবার ও একটি পিস্তল সরবরাহ করে। এ দুটি অস্ত্র ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রহণ করে হত্যাকাণ্ডের আগের দিন রাতে। তবে ভোলা ঘটনাস্থলে ওইদিন ছিলেন না।

জবানবন্দিতে আনোয়ার জানান, হত্যাকাণ্ডের পর টিভিতে যখন জানতে পারি, ওই নারী এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী। তখন তারা ভয়ে মুছাকে ফোন করেন। এসময় মুছা নিজেকে এক বড় পুলিশ কর্মকর্তার সোর্স বলে দাবি করেন।

তাদের হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে চুপ থাকতে বলেন তিনি। এরপর তারা উভয়ে (ওয়াসিম-আনোয়ার) জামা-কাপড় পাল্টে আত্মগোপনে চলে যান। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও বন্ধ রাখেন।

এদিকে স্ত্রী খুন হওয়ার পর থেকে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে রয়েছেন এসপি বাবুল আক্তার। সেখানে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকছেন পুলিশের ছয়জন সদস্য।

তবে এই পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তা নিচ্ছেন নাকি জামাতার ওপর নজরদারি চালাচ্ছেন তা নিয়ে ধন্দে আছেন বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন- এমনটাই জানা গেছে গণমাধ্যম সূত্রে।

প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে নিহত হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। পরদিন পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর