হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পেঁপে ও সবজি চাষে সফলতা পেয়েছেন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের বায়লাখালি এলাকার আবু বকর সিদ্দিক সুমন। এখন নিজে সফল হয়ে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি।
জানা গেছে, প্রতিদিন আগ্রহী উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে পেঁপের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের ওপর পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। পাঠশালার মতো করে হাতে-কলমে বীজ বাছাই ও বপন থেকে শুরু করে পোকামাকড় এবং রোগবালাই দমনসহ পণ্য সংগ্রহের সঙ্গে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত উদ্যোক্তাদের শেখানো হয়ে থাকে।
এদিকে নিজ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে পেঁপে চাষ করে আলোড়ন সৃষ্টি করে গত বছর প্রায় ১৫ লাখ টাকার পেঁপে বিক্রি করেন সুমন। এ বছর পেঁপে বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে গতবারের চেয়ে বেশি।
সবমিলিয়ে সুমনের বাগানসহ কর্মযজ্ঞ দেখতে অনেকেই আসছেন বাগানে আর সেই সঙ্গে আগ্রহীরা পেঁপে চাষও শুরু করেছেন। আর চাকরির জন্য অপেক্ষায় থেকে সমাজের বোঝা না হয়ে, বেকারদের এভাবে উপার্জনক্ষম হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সুমন।
সুমন অভাবের তাড়নায় নবম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে ১৯৭৭ সালে রেলওয়েতে একটি প্রজেক্টের অধীনে চাকরি নেন। চার বছর চাকরি করার পরে ১৯৮১ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।
কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়ায় সিরিয়া, ফিলিস্তিন ঘুরে ১৭ মাস পরে দেশে ফিরে বেকার যুবক হিসেবে ঠাঁই নেন ঢাকার ফকিরাপুল এলাকায়। উপার্জনের প্রয়োজনে কখনো রং মিস্ত্রি, কখনো দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৬ সালে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখে ইন্টারভিউ দিলে কুয়েতে রং মিস্ত্রির কাজ পান সুমন। এরপর সচ্ছলতা ফেরার পাশাপাশি সেখান থেকেই এ পেশায় বহু দেশ ঘুরেছেন সুমন। এরপর ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসা করেন। ২০১৫ সালে দেশে ফিরে ঢাকায় ব্যবসা শুরু করেন। দোকানে ডাকাতি হওয়ার পর অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে যান সুমন। এদিকে স্ত্রীর কিডনিজনিত সমস্যা দেখা দিলে নিরুপায় হয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জের বায়লাখালি গ্রামে ফিরতে হয় তাকে। ২০২১ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর পর অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি অনেকটাই একা হয়ে যান সুমন।
এর কিছুদিন পরে ঘুরে দাঁড়ানোর তাগিদে নিজ বাড়ির পতিত জমিতে পেঁপে চাষ শুরু করেন তিনি। আর তাও দক্ষিণ আফ্রিকায় পেঁপে চাষের ওপর নেওয়া প্রশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই পেঁপে ও সবজি চাষ শুরু করেন।
আবু বকর সিদ্দিক সমুন বলেন, গত মৌসুমে প্রায় ১৫ লাখ টাকার কাঁচা ও পাকা পেঁপে বিক্রি করেছি। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পেঁপে চারা বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকা আয় হয়েছে। এবার তার কাঁচা ও পাকা পেঁপে বিক্রি করে গতবারের চেয়ে বেশি পেঁপে বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, এখন আমার শাহী, কাশ্মীরি, টপ লেডি জাতের এক হাজারেরও বেশি পূর্ণ বয়স্ক পেঁপে গাছ রয়েছে। এপ্রিল মাসে রোপণ করা চারাগুলোতে জুলাই মাসে ফল এসেছে। উৎপাদনে আমি সন্তুষ্ট, লোকসান বা ক্ষতির কোনো শঙ্কাও দেখছি না।
সুমন বলেন, বেকাররা অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে পেঁপে চারা রোপণ করে নিজের ভাগ্য ফেরাতে পারেন। সারাদিন বসে এর যত্ন নিতে হয় না বিধায় শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়ার পাশাপাশি পেঁপে গাছ লাগাতে পারেন। এতে তাদের পড়াশুনার খরচ মেটানোর পাশাপাশি উদ্বৃত্ত থাকবে।
তিনি বলেন, আমার সফলতা দেখে অনেকেই পেঁপে চাষের বিষয়ে জানতে আমার কাছে আসেন। তাই বর্তমানে উদ্যোক্তাদের হাতে কলমে শেখানোর জন্য নতুন ঘর করে একটি পাঠশালার মতো করেছি। যারা আগ্রহী তাদের সেখানে বসে হাতে কলমে সবকিছু জানানো ও শেখানোর চেষ্টা করি। আর যারা আগ্রহী তাদের উপযুক্ত করেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
বর্তমানে সুমনের পাঠশালায় যে ১০ জন উদ্যোক্তা রয়েছেন তারা বলছেন, চাকরির বাজার খারাপ। সেখানে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যই সুমন ভাইয়ের কাছে এসেছি। তিনি হাতে-কলমে সবকিছু শিখিয়ে দিচ্ছেন, আশাকরি আমরাও সফল হবো।
এদিকে সুমনের কাছ থেকে উন্নত জাতের পেঁপে গাছের চারা নিয়েছেন বাবুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মোস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, আমি তার কাছ থেকে উন্নত জাতের চারা নিয়ে তা লাগিয়ে সফলতা পেয়েছি। এখন শিক্ষকতার পাশাপাশি আমারও নতুন আয়ের উৎস তৈরি হয়েছে।
সুমনকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে দেখছেন স্থানীয় কৃষি কার্যালয়। বাবুগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মামুনুর রহমান জানান, আবু বকর সিদ্দিক সুমনকে অনুকরণ করে অনেকেই পেঁপে চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আর এ ধরনের কাজে আমরাও সবাইকে সহযোগিতা করছি।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশালের উপ-পরিচালক মুরাদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, নিজে সফল হয়ে হাতে কলমে অন্যদের শেখানোর এ উদ্যোগকে আমরা সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছি।