শিশু বয়সে নিজেই ভাঙ্গি নিজের মাথায় কাঁঠাল

ড. গোলসান আরা বেগমঃ বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে আজকের এই আমি দাঁড়িয়েছি শক্ত মাটির উপর। ছোট বেলায় খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম।বইয়ের ধারে কাছে যেতে ইচ্ছে করতো না। খেলাধূলায় থাকতাম মেতে। ডানপিঠে স্বভাবের জন্য বাবার হাতে কাঁচা বেতের পিঠুনি খেয়েছি কতো।

বাবা ছিলো যেমন গরম তেমন নরম স্বভাবের মানুষ। তিনি তার সন্তানদের কড়া শাসন করতেন, আবার আদরও করতেন বুকে তুলে। কতোবার কাঁদতে দেখেছি অসুখ বিসুখ হলে সন্তানের । বুক উজার করা ভালোবাসা ঢেলে দিতেন সন্তানের সুখের তরে। যেদিন কোন কারণ বশত বিরক্ত হয়ে ভাইবোন কাউকে বেদম পেটাতেন, সেদিন অফিস ছুটির পর, ঐ সন্তানকে কোলে তোলে হাঁটতেন আর গুনগুনিয়ে সুরা আররাহমানু পড়তেন।মনটা হালকা করে সন্ধ্যার পড়ার টেবিলে বসতেন আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে।

আমি যতই দুষ্টামি করি না কেন, হঠাৎ করেই ৬/৭ বয়সে চোখ যায় খুলে। বুঝতে পারি– দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে হলে, পড়াশোনার বিকল্প নেই। তখন থেকেই বই কলম খাতা বুকে ধরি চেপে। হয়ে যাই সফল মেধাবী ছাত্রী। সফলতা ক্রমান্নয়ে প্রত্যাশাকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাতে থাকে,যুক্ত হয় বাবার নির্মল আর্শিবাদ ও অনুপ্রেরণা। নিবু নিবু হ্যারিকেনের আলোতে গভীর রাত জেগে যখন পরীক্ষার পড়া তৈরী করতাম,বাবা পাশে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। আহারে সেই বাবা তুমি কোথায় হারালে।

আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাঁচ ভাই বোন ও বাবা মা’র সংসার চলতো কিছুটা টেনে টুনে। শত অভাবের ভেতরেও আমাদের পড়াশোনার প্রতি ছিলো বাবার তীক্ষ নজর। মা ছিলেন বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত।সারা বছরই ঔষধের যোগান দিতে হতো। শরীরে বেরাম নিয়েও, মাটির চূলায় হাত পোড়ে ভাত রেঁধে আমাদের মুখে তুলে দিতেন মা হাসি মুখে। হায় মা তোমার দুধ মাখা ভাতের গন্ধ ও স্বাদ আজো জিহ্বায় লেগে আছে।

সংসারের সব তাল লয় রক্ষা করতে গিয়ে চাষের জমাজমি প্রায় সব বিক্রি করে দেন।বাবার ছিলো একটাই লক্ষ, তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আমার উপর দৃঢ় আস্থা ও স্বপ্ন ছিলো আমাকে ডাক্তার বানাবে। কিন্তু না সে আশা পূর্ণ করতে পারিনি। জিকজাক পথে হেঁটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই ১৯৭৭ সালে।২০২০ সালে জাবি থেকে পি.এইচডি ডিগ্রী অর্জন করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সয়েল সাইন্স ও প্রাণ রসায়নে চান্স পেলেও বোকা বলেই ভর্তি হইনি। ঢাবি থেকে ১৯৯১,১৯৯২ সালে বিএড,এমএড সার্টিফিকেট অর্জন করি।দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় আমায় উদার, প্রগতিশীল,সাহসি কলমযোদ্ধা,মানবীয় হওয়ার দীক্ষা দিয়েছে মুক্ত হস্তে। তার ছিটে ফোটা ব্যয় করেই নিজেকে আলোকিত ও ধন্য করেছি।

সিলেট মেডিকেল কলেজে রিটেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল জানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম ওখানকার পরিচিত এক জনকে। সে কিছুই জানায়নি।ধরে নিলাম আমি উত্তীর্ণ হতে পারিনি।কিন্তু কেন যেন মন পোড়ায়, মন বলে আমি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটি আমার অজ্ঞতার জন্য হারিয়েছি।কেন নিজে ফলাফল জানতে যাইনি।সে ভদ্রলোক আমার প্রসঙ্গটি ভুলেওতো যেতে পারে।তখন মোবাইল ফোনের প্রচলন ছিলো না।এখনও মনে হলে কস্ট পাই, নিজেকে দোষারুপ করি।

বাবা অবসরে যাওয়ার পর আমাদের জীবন যাত্রা যায় পাল্টে। গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে হাড়ি পাতিল সাজাই।বড় ভাই প্রকৌশলী এ কে এম আশরাফুল হক পরিবারের সকল দায় দায়িত্ব তুলে নেয় তার ঘাড়ে। কুয়েতে চাকুরী করে এই বড় ভাই টাকা পাঠায়, তা দিয়ে চার ভাইবোনের পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ চলে।

অনেক আদরের ছোট বোন জোছনা(আমার নিক নেইম) কে রান্না ঘরে যেতে দিতো না, একটা একটা পৃষ্টা উল্টিয়ে বিজ্ঞান পড়াতো, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো আমার চোখে।সেই বোনটির ছন্দ পতনে খুবই কষ্ট পায় বড় ভাই। বোনকে নয় দায়ী করে বোনের অপরিপক্ত প্রেমকে। মনোস্থির করে আমাকে বিয়ে দিয়ে ফেলবে।

কাক পক্ষী যেন ছোবল দিতে না পারে সে দিকে ছিলো বাবার সুদৃষ্টি। আশপড়শীরা বলতো কালো কুচকুচে মেয়েটিকে পড়িয়ে কি হবে, বিয়ে দিয়ে দাও।বাবার মাথা গরম হয়ে যেতো, গালমন্দ করতো। কালো এই মেয়েটিই আমার চাঁদের আলো জোছনা। তার বুদ্ধি মেধা দশের,দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে।

জোছনা নামক মেয়েটি নিজেই ভাঙ্গে নিজের মাথায় কাঁঠাল। বাঘ বন্দি আর সাপ লুডু খেলতে খেলতে শিশু বয়সে মামাত ভাইয়ের সঙ্গে প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়ে যায়। চলতে থাকে প্রেমের লুকোচুরি। কিছুটা হলেও পড়াশোনায় ভাটা পড়ে। চোখের রং আর রঙধনুর সাত রং একাকার হয়ে মিশে যায় জীবন তরঙ্গে। প্রেমের জলে হাবু ডুবু খেতে খেতে ভুলে যাই বাবার স্বপ্নের কথা। এর জন্য চরম খেসারতও দিতে হয়। কোন অঙ্গনেই নাম ছড়িয়ে হতে পারিনি স্বনাম ধন্য জয়িতা।।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের পড়া শেষ করতে না করতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসি।ভয়ে আতংকে ছিলাম, রসায়ন বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ে পড়াশোনা যেন বন্ধ হয়ে না যায়। না তা হয়নি, সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে, ছয় মাসের শিশু সন্তান কোলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি টানি।নিয়ে আসি মাথা বোঝাই জ্ঞানের পাহাড় যার প্রতিফলন ঘটাচ্ছি প্রতি পদক্ষেপে,মানবীয় মূল্যবোধে,প্রিয় মাতৃভুমির শুভ কামনায়।

এরপর সংসার,চাকুরী,সন্তান লালন পালন, সাহিত্য সাধনা, রাজনীতির মাঠে দৌড় ঝাপ,গ্লোবাল ভিলেজ নামক বিশ্ব
পাঠশালায় লাটিমের মতো ঘুরছি, তো ঘুরছি।

লেখকঃ উপদেষ্ঠা মন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ,কেন্দ্রীয় কমিটি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর