বঙ্গবন্ধু-চার নেতার স্মৃতি জাদুঘর হচ্ছে পুরনো কারাগার

কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে কালের সাক্ষী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। নতুন নাম পেয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার কারাগারের উদ্বোধন করেছেন। খুব শিগগির শুরু হচ্ছে বন্দি স্থানান্তর।

অন্যদিকে, আড়াইশ বছরের পুরনো এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি স্মরণীয় করে রাখতে রুপ নিচ্ছে বঙ্গবন্ধূ জাদুঘরে। এখানে গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার পৃথক স্মৃতি জাদুঘর, পার্ক, মিনি কারাগার, কয়েদিদের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কারা কল্যাণ ভবন, কমিউনিটি সেন্টার, আরও অনেককিছু।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বদলে যাবে চিরচেনা নাজিমউদ্দিন রোডের চিত্র। রাতভর জেগে থাকা সড়ক, কারাগারকে কেন্দ্র করে হইচই, মানুষের আনাগোনা, খাবারের দোকান, চায়ের টং, আলোকবাতি- বদলে যাবে চিত্রপট, চিরচেনা দৃশ্য।

সূত্র জানায়, কালের সাক্ষী পুরনো এ কারাগারের ১১ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও চার নেতার পৃথক দুটি স্মৃতি জাদুঘর, কারা কল্যাণ ভবন ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হবে। থাকবে সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার, বহুতল পার্কিং, আধুনিক শপিং কমপ্লেক্স ও সিনেপ্লেক্স। এছাড়া বাইরের অংশে থাকবে সবুজ উদ্যান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এ কারাগারের তিনটি কক্ষে বন্দি করে রাখা অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সেলকে ঘিরেই মূলত ৪ নেতার জাদুঘরটি তৈরি করা হবে।

এছাড়া কারাগারের সঙ্গে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের পাশে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হবে। বাকি জমিতে নির্মাণ হবে কারা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট।

কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের পর খালি জমিকে কাজে লাগানোর জন্য এর আগে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই এসব নির্মাণ করা হবে।

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে ১৭৮৮ সালে তৈরি হওয়া এই কারাগার দেশের প্রাচীনতম এবং সর্ববহৎ কারাগার।

মুগল সুবাদার ইব্রাহিম খান চকবাজারে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে দুর্গটি ঢাকার নায়েব নাজিমের আবাসস্থল ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ১৭৮৮ সালে দুর্গের ভেতরে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত দুর্গটিকে কারাগারে রূপান্তর করা হয়।

আঠার শতকের শেষদিকে ঢাকা কারাগারে ১০টি ওয়ার্ড ছিল এবং সে সময়ে গড়ে ৫০০ থেকে ৫৫০ জন বন্দিকে রাখা হতো।

প্রথমদিকে একজন বন্দির খাদ্য সরবরাহ বাবদ দৈনিক বরাদ্দ ছিল দুই পয়সা। ১৭৯০ সালে তা বাড়িয়ে এক আনা করা হয়। পরবর্তী সময়ে কারাগারটির ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়। এটিই বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। বেঙ্গল জেল কোডে যে কয়টি কারাগারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অন্যতম। প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে এবং বন্দি সংখ্যার আধিক্য বিবেচনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কারাগার।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভূমির পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৭৬ একর। এর মধ্যে পেরিমিটার ওয়ালের ভেতরে অর্থাৎ কারা অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৫৫ একর, পেরিমিটার ওয়ালের বাইরে ১৯ দশমিক ২১ একর।

এই পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ওয়ার্ড ৪৮টি, সেল ভবন ১২টি, সেলের কক্ষ ২৩৩টি, রান্নাঘর ৫টি, ওয়ার্ক সেড ৬টি, মেরামত প্রশিক্ষণ শেড ৪টি, কারা বেকারি ১টি, ডে-কেয়ার সেন্টার ১টি ও মাল্টিপারপাস শেড আছে ১টি। তাছাড়া বন্দিদের সাক্ষাতের জন্য একটি দ্বিতল ভবন ও প্রধান ফটক সংলগ্ন অফিস ভবন রয়েছে।

১১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয় বন্দিদের। তবে পাকিস্তান আমলে এই কারাগারের আশপাশের অনেক জমি বেদখল হয়ে যায়। এখন সব মিলিয়ে প্রায় ১৬ থেকে ১৭ একর জমি রয়েছে। ১৯৮০ সালে আশপাশে বড় ভবন হওয়ার কারণে কারাগারটি সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

১৭৮৮ সালে স্থাপিত নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারের ধারণ ক্ষমতা দুই হাজার ৮২৬ জন হলেও সেখানে বন্দি রয়েছে প্রায় তিনগুণ।

কেন্দ্রীয় কারাগারের যে কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকতেন এবং জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান কারাগারের যে কক্ষে নিহত হয়েছেন, ওই কক্ষগুলোও সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই কক্ষগুলোকে কেন্দ্র করে এবং দুই জায়গার মাঝখান মিলিয়ে তৈরি করা হবে মিউজিয়াম। আর ৩-৪ একরের মতো জায়গায় উন্মুক্ত পার্ক হবে। বাকি ১৩ একর জায়গায় কারা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, একটি মিনি কারাগার এবং কিছু কারা সদস্যের জন্য আবাসস্থলের ব্যবস্থাও থাকবে।

কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কয়েদি-হাজতিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে এই পুরনো কারাগারে। হাজতি-কয়েদিদের এখানে প্রশিক্ষণ দেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তারা সার্টিফিকেটও প্রদান করবে। পাশাপাশি কয়েদিদের মধ্যে যারা প্রশিক্ষণে ভাল করবে তাদের ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থাও করবে কয়েকটি এনজিও। আর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দিদের নিরাপত্তার জন্য গড়ে প্রতিদিন ২০০ জন কারারক্ষীকে ঢাকায় থাকতে হয়। তাদের আবাসনের জন্য একটি ব্যারাক নির্মাণ করা হবে। একটি মিনি কারাগারও থাকবে এখানে।

কারা অধিদফতরের এই পরিকল্পনাকে প্রধানমন্ত্রী নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্পটি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদনের পরপরই কাজ শুরু হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর