ইউএনও-চেয়ারম্যান লড়াই

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। অথচ প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মচারীরা আইন মানার চর্চা না করে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর করে রেখেছেন; এটা শুধু আইন অমান্যই নয় বরং বিভিন্ন স্তরে কর্মরত ২৬টি ক্যাডারের কর্মচারীদের প্রতিও অবহেলা। আমরা আইনের চর্চার পক্ষে। কিন্তু প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মচারীরা আইন অনুসরণ করছেন না। উপজেলার বিভিন্ন দফতরের কাগজপত্র ও নথি অনুমোদনের জন্য নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করতে হবে, এটিসহ এ-সংক্রান্ত বিধি ও প্রজ্ঞাপন নিশ্চিত করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক মাস পরে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের সময় চেয়ে জবাব দিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
আগামী রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উপজেলা পরিষদ হস্তান্তর বিষয়ে কার্যক্রম পর্যালোচনা পরামর্শ প্রদান ও নির্দেশনা জারির উদ্দেশে জাতীয় পর্যায়ে গঠিত কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবকে বলেন, উপজেলা পরিষদ আইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উপজেলা পরিষদ জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। প্রশাসন এ কাজে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করতে সহায়তা দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ উপজেলা জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে ইউএনও পরিষদের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আসছেন। যা আইন ও বিধিমালার পরিপন্থী, যে কারণে ওই উপবিধি ও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক যুগ্মসচিব ইনকিলাবকে বলেন, উপজেলা পরিষদ হস্তান্তর বিষয়ে কার্যক্রম পর্যালোচনা পরার্মশ প্রদান ও নির্দেশনা জারির উদ্দেশে জাতীয় পর্যায়ে গঠিত কমিটির সভা আগামী ২১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। সভায় চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা বাস্তবায়নের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সময় চেয়ে জবাব দেয়া হচ্ছে।

 এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব ইনকিলাবকে বলেন, অনেক সময় উপজেলা চেয়ারম্যানরা আইন মানছেন না। আবার অনেকেই মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় আসছেন। এমনকি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা সব সময় ঢাকায় থাকেন। তারা নিয়মিত অফিস না করায় তাদের অধীন দফতরগুলোর ফাইল পেন্ডিং থাকছে। সরকারি গাড়ি উপজেলা পরিষদকে দিলেও তারা সে গাড়ি ব্যক্তিগতভাবেই ব্যবহার করছেন।
জানা গেছে, ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত উপজেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৮৫ সালে। পরেরটি ১৯৯০-এ। ১৯৯১ সালে এ পদ্ধতিটিই বাতিল হয়। ২০০৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের পরপর আবার উপজেলা প্রক্রিয়া চালু করা হয়। তখন থেকে সরকারদলীয় চেয়ারম্যানরা উপজেলা পরিষদ চালিয়ে আসছেন। তারপর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে জনপ্রতিনিধিদের।

আবারও নানা বিষয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা চেয়ারম্যানরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা (ইউএনও) আইন মানছেন না। দাবি আদায়ের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানরা জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে অধিকাংশ উপজেলা চেয়ারম্যান কর্মস্থলে (নিজ জেলা) থাকেন না, জরুরি প্রয়োজনে তাদের পাওয়া যায় না বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)।

এরপর স্থানীয় সরকার বিভাগ চিঠি জারি করে বলেছে, এখন থেকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত অবস্থান করতে হবে উপজেলা চেয়ারম্যানদের। কোনো কারণে নিজ এলাকা বা কর্মস্থল ত্যাগ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। ছুটি সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধিমালা মেনে চলার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউএনওরা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমকে তার সরকারি বাসভবনে ঢুকে হামলা করে মারাত্মক আহত করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার পর ইউএনওদের সার্বক্ষণিক গানম্যান ও তাদের বাসভবনের নিরাপত্তায় পুলিশ ও সশস্ত্র আনসার দেয় সরকার। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি উপজেলা চেয়ারম্যানরা। তাদের মতে, তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে তাদেরই পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নিরাপত্তায় গানম্যান দেয়া হয়েছে। এটা তাদের জন্য অবমাননাকর। বিষয়টি নিয়ে তারা আদালতের দ্বারস্থ হলে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ইউএনওদের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং, মাসিক সমন্বয় সভাসহ উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন মিটিংয়ে তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিতে থাকে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর উপজেলা চেয়ারম্যানদের ইউএনওদের মতো নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে উপজেলা পরিষদ ভবনে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়-এর পরিবর্তে ‘উপজেলা পরিষদ কার্যালয়’ লেখা সাইনবোর্ড টানানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ধারা ১৩(ক), ১৩(খ) ও ১৩(গ) কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত। সরকারকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এর পরই মূলত দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। বিষয়টি ইউএনওরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও বিভাগীয় কমিশনারদের অবগত করেন। গত ২১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় বিভাগীয় কমিশনাররা বলেন, অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা শহরে বসবাস করেন। কালেভদ্রে তারা নিজ উপজেলায় যান। আবার কেউ কেউ ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানো বা ব্যবসায়িক কারণে রাজধানীতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ফলে এসব জনপ্রতিনিধিদের সাধারণ মানুষ নাগরিক সেবা পাচ্ছেন না। অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যানরা সরকারি গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। এর পরি প্রেক্ষিতে বৈঠকে দুটি সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্ত জানিয়ে ২৬ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এতে বলা হয়- ২১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায় তার বিভাগসংশ্লিষ্ট দুটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক. উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। দুই. যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা যেন কর্মস্থল ত্যাগ না করেন সে বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এরপর ৩১ অক্টোবর সব উপজেলা চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ চলতি মাসে আবারও চিঠি দিয়ে বিদ্যমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সদস্য ও মহিলা সদস্যদের ছুটি বিধিমালা ও বিভাগীয় কমিশনারদের সভার সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়। বিধিমালা অনুযায়ী-সরকারের অনুমতি নিয়ে পরিষদের চেয়ারম্যানরা দাফতরিক ও ব্যক্তিগত কাজে নিজ জেলার বাইরে যেতে বা অবস্থান করতে পারবেন। জরুরি ক্ষেত্রে জেলার সীমানার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে চেয়ারম্যানরা ফ্যাক্স বা টেলিফোনের মাধ্যমে মৌখিকভাবে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে ছুটি মঞ্জুর করিয়ে ছুটি ভোগ করবেন এবং ছুটি শেষে লিখিতভাবে ওই ছুটি মঞ্জুর করাবেন।

এ চিঠি পাওয়ার পরই জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয় উপজেলা চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন (বিইউপিএ)। গত ৭ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ইউএনওরা আইন মানেন না বলে অভিযোগ করেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। লিখিত বক্তব্যে বিইউপিএ সভাপতি হারুন অর রশিদ হাওলাদার বলেন, সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। অথচ প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মচারীরা আইনের চর্চা না করে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর করে রেখেছেন, যা শুধু আইন অমান্যই নয় বরং বিভিন্ন স্তরে কর্মরত ২৬টি ক্যাডারের কর্মচারীদের প্রতিও অবহেলা। আমরা আইনের চর্চার পক্ষে। কিন্তু প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মচারীরা আইন অনুসরণ করছেন না। শুধু একটি ক্যাডারের কর্মচারীদের আইন না মানার কারণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা আজ কর্ম, মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বহীন হয়ে পড়েছি। এমনকি এ ব্যাপারে হাইকোর্ট ১০ কর্মদিবসের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশনা জারি করলেও কোনো জবাব দেয়া হয়নি, যা আদালতের প্রতিও অবজ্ঞা।

সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গত ১১ নভেম্বর থেকে দেশের বিভাগগুলোয় সফর শুরু করেছেন বিইউপিএর নেতারা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আগামী বছর ১৬ জানুয়ারি দেশের সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করা হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর