হাওর বার্তা ডেস্কঃ আজ থেকে দুই দশক আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে গিয়েছিলো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল ভর্তি আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজ আঘাতে হেনেছিলো নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে। জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত ১৯ জঙ্গি চারটি উড়োজাহাজ ছিনতাই করে এই আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি জায়গায়।
৯/১১-এর সেই হামলায় প্রাণ হারিয়েছিল ২ হাজার ৯৯৬ জন। আহত হয়েছিল আরও কয়েক হাজার মানুষ। ওই হামলা পুরো বিশ্বকেই বদলে দিয়েছে। আর ওই হামলার জবাব দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই হামলার পর দীর্ঘ দুই দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আসলে কোথায়? কী হারিয়েছে দেশটি? আর কী-ই বা পেয়েছে।
ওপরের প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গেলে, দেখা যাবে, এই হামলা শুধু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বকে একতাবদ্ধ করেনি বরং নিরাপত্তা, অভিবাসননীতিও বদলে দিয়েছে। বর্ণবৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক অপরাধ বাড়িয়েছে।
নাইন-ইলেভেনের হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হামলার পর প্রথম দিনেই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধস নামে। এক মাসেই চাকরি হারান ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ। ধারণা করা হয়, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলায় আনুমানিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়েছিল।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে হামলার স্থান, যেখানে টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেই ‘গ্রাউন্ড জিরো’র ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে সময় লেগেছিল আট মাসেরও বেশি। ওই জায়গায় এখন তৈরি হয়েছে জাদুঘর, সঙ্গে স্মৃতিসৌধও।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ, মধ্য এশিয়ার ছোট দেশ আফগানিস্তান ছাড়িয়ে ইরাকে পৌঁছে যায়, এমনকি আফ্রিকা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। ইরাকে এই সংঘাতে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ আমেরিকান সেনা সদস্য এবং লাখ লাখ বেসামরিক লোক প্রাণ হারান।
এরপর আফগানিস্তান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পর আরও কয়েকটি দেশে যুদ্ধ করতে গেছে। আফগানিস্তান ছাড়াও সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ায় চালানো সামরিক অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একদিকে ছিল ব্যয়বহুল, অন্যদিকে বহু আমেরিকান সৈন্যকেও এসব যুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়েছে। শুধু আফগানিস্তান যুদ্ধেই দেশটির খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি ডলার। নিহত হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সৈন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক হিসাবে বলা হচ্ছে, ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পর আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান ও সিরিয়াতে যুদ্ধ-বাবদ যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে প্রায় ছয় ট্রিলিয়ান ডলার।
এই বছর আগস্টের শেষ নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর থেকে বাইডেন প্রশাসন গত ২০ বছরকে পেছনে ফেলে রেখে আসার জন্য বেশ কিছু চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলীর ওপর আলোকপাত করতে পারে এমন কিছু নথিপত্রকে গোপনীয়তামুক্ত করেছে। একইসঙ্গে আমেরিকানদের প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলকারী তালেবান সরকার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পর্যবেক্ষণ করছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য বিস্তারের দিন শেষ হয়ে আসছে কি না, তা যদি বিবেচনা করি, তবে কিছুদিন আগে দেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্য থেকে দেখা যায়, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের পক্ষে জোর গলায় যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি অন্য আরেকটি দেশ পুনর্নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োগের যুগের অবসান ঘটানোর কথা ঘোষণা করেছেন।
বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে পরিষ্কার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। তবে জাতি কিংবা রাষ্ট্র গঠনে তার দেশ আর জড়িত হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ৬০-এর দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যেভাবে আচরণ করে আসছে, সারা বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের নতুন বাস্তবতার কারণে সেখানে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।
মানবাধিকার রক্ষার জন্য তার দেশ অন্তহীন কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের শিক্ষক ড. আলী রীয়াজ মনে করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো যুদ্ধে জড়িত হবে না; এরকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সামরিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে সেখানে জাতীয় স্বার্থ কতোটুকু আছে এবং তাতে অন্যদের সংশ্লিষ্ট করা যায় কিনা। বাইডেন বলেছেন কেউ জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে তাকে শায়েস্তা করা হবে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক শফিকুর রহমান মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই ঘোষণা রাজনৈতিক বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়।
৯/১১ এর আগে পশ্চিমা দেশগুলো অন্য যেসব দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, তুলনামূলকভাবে সেগুলো ছিল অনেক দ্রুত এবং সহজ। সিয়েরা লিওন, কসোভো, বা এমনকি ১৯৯১ সালের ডেজার্ট স্টর্ম অভিযান- এই সবগুলো অভিযান শেষ করার একটা নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা ছিল।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তান এবং ইরাকে যে আক্রমণ চালানো হলো, তার পরিণামে যে যুদ্ধ শুরু হলো, তাকে বলা হচ্ছিল ‘চিরকালের যুদ্ধ’। ২০০১ এবং ২০০৩ সালে যারা এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, তারা কেউ ধারণা করতে পারেনি যে দুই দশক পরও এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।