হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করেন সংসদ সদস্যরা। সামাজিক দূরত্ব মানার কারণে অনেকে নির্বাচনী এলাকাতেও যাননি। এরপরও সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৭৫ জন এমপি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
জাতীয় সংসদের (সংরক্ষিত নারী আসনসহ ৩৫০ আসন) প্রায় (২২ শতাংশ) সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন চারজন। অপরদিকে সরকারের মন্ত্রিসভার ৪৮ সদস্যের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ জন। তাদের মধ্যে একজন প্রতিমন্ত্রী মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুর্যোগকালে তাদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ ছিল না। তাই জনগণের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তাদের বেশি সংখ্যক সহকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তবে বেশিরভাগ এমপির করোনা পজিটিভ হওয়ার পেছনে একাধিকবার পরীক্ষা করার কথাও উল্লেখ করেছেন তারা।
সংসদ সদস্যদের মধ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত হন নওগাঁ-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার। দেশে করোনা সংক্রমণের ৫২ দিনের মধ্যে ৩০ এপ্রিল তার শরীরে ভাইরাস ধরা পড়ে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়কমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রথম করোনা আক্রান্ত হন।
সংসদ সদস্যদের মধ্যে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের মোহাম্মদ নাসিম এবং নওগাঁ-৬ আসনের ইসরাফিল আলম মারা গেছেন। ১০ জুলাই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (ঢাকা-১৮) ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এছাড়াও করোনায় আক্রান্ত হয়ে সর্বশেষ সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের বেশি আক্রান্ত হবার কারণ করোনার ভয়াবহ সময়েও তারা মানুষের পাশে থেকেছে। লকডাউনের সময় সব মানুষ যখন গৃহবন্দি, তখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা বসে থাকতে পারিনি। তাদের ত্রাণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। জনগণের পাশে দাঁড়াতে হয়েছে।’
করোনায় সাবেক অনেক সংসদ সদস্যদের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অনেক সংসদ সদস্যদের তালিকা হয়নি। সংসদ সদস্যদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত বগুড়া-জয়পুরহাট জেলার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য কামরুন্নাহার পুতুল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৩ মে মারা যান। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সাংসদ হাজি মকবুল হোসেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬ জুন মারা যান। করোনায় সংক্রমিত হয়ে ১৪ নভেম্বর রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু হেনা মারা যান। এছাড়াও ২০ ডিসেম্বর মারা যান মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সামসুদ্দিন আহমেদ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২৪ ডিসেম্বর মারা যান।
দেখা গেছে, ৩০ এপ্রিল নওগাঁ-২ আসনের শহীদুজ্জামান সরকার আক্রান্ত হওয়ার পর ১৬ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের এবাদুল করিমের করোনা শনাক্ত হয়। জুনে তিন মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীসহ ১৬ জন এমপি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সরকারি দলের এমপি ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজারও ওই সময় করোনা হয়।
এই মাসে সাবেক মন্ত্রী সিরাজগঞ্জ-১ আসনের মোহাম্মদ নাসিম, গোপালগঞ্জ-৪ আসনের মুহম্মদ ফারুক খান, ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী গাজীপুর-১ আসনের আ ক ম মোজাম্মেল হক, বাণিজ্যমন্ত্রী রংপুর-৪ আসনের টিপু মুনশি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়কমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, সাবেক চিফ হুইপ ও মৌলভীবাজার-৪ আসনের উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, যশোর-৪ আসনের রণজিৎ কুমার রায়, জামালপুর-২ আসনের ফরিদুল হক খান (বর্তমানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী), চট্টগ্রাম-৮ আসনের মোসলেম উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খান, নড়াইল-২ আসনের মাশরাফি বিন মুর্তজা, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরিশাল-৫ আসনের জাহিদ ফারুক, রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হক এবং সংরক্ষিত আসনের ২৫ জুন ফেরদৌসী ইসলাম জেসির করোনা পজিটিভ হয়।
এদের মধ্যে মোহম্মদ নাসিম ১৩ জুন মারা যান। একই দিনে করোনায় মারা যান ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মুহম্মদ আবদুল্লাহ।
জুলাইতে করোনা আক্রান্ত হন নওগাঁ-৬ আসনের ইসরাফিল আলম, সিরাজগঞ্জ-৫ আব্দুল মমিন মন্ডল, নওগাঁ ৩-এর ছলিম উদ্দিন তরফদার, সাতক্ষীরা-২ আসনের মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, টাঙ্গাইল-৮ আসনের জোয়াহেরুল ইসলাম ও কুড়িগ্রাম-৩ আসনের এম এ মতিন।
এদের মধ্যে ইসরাফিল আলম ২৭ জুলাই মারা যান।
আগস্ট মাসে এক মন্ত্রীসহ ১১ জন এমপি করোনায় আক্রান্ত হন। তারা হলেন- মৌলভীবাজার-১ আসনের এমপি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৬ আসনের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, বিএনপির সংরক্ষিত আসনের রুমিন ফারহানা, সংরক্ষিত আসনের সালমা চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও-১ রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের দবিরুল ইসলাম, রাজশাহী-৫ আসনের মনসুর রহমান, টাঙ্গাইল-৭ আসনের মো. একাব্বর হোসেন, পটুয়াখালী-৩ আসনের এস এম শাহজাদা, মেহেরপুর-২ আসনের মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নুর মোহাম্মদ।
সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্ত হন দিনাজপুর-২ আসনের এমপি নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, খুলনা-৬ আসনের আক্তারুজ্জামান বাবু, টাঙ্গাইল-২ আসনের ছোট মনির, শেরপুর-১ আসনের এমপি হুইপ আতিউর রহমান আতিক ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ।
অক্টোবর মাসে কয়েকদিন জ্বরে ভোগার কারণে ১১ অক্টোবর কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তকরণের জন্য নমুনা দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ১৩ অক্টোবর পরিকল্পনামন্ত্রীর কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। ১৬ অক্টোবর উপসর্গ দেখা দেয়ায় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) নমুনা পরীক্ষা করান। একই দিন তিনি চিকিৎসকদের পরামর্শে ভর্তি হন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই তিনি জানতে পারেন কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের বিষয়ে। ১০ অক্টোবর কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের। পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শে হোম আইসোলেশন পর্ব পার করে ৩০ অক্টোবর নমুনা পরীক্ষা করতে দেন। এদিন তার মাঝে আর কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও হবিগঞ্জ-৩ আসনের মো. আবু জাহির এবং ফেনী-৩ আসনের জাতীয় পার্টির মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।
নভেম্বরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এমপি করোনায় আক্রান্ত হন। এ মাসে তিন মন্ত্রী, দুই প্রতিমন্ত্রী, একজন উপমন্ত্রী ও একজন হুইপসহ ২৩ জন এমপি আক্রান্ত হন। আক্রান্তরা হলেন- বাগেরহাট-১ আসনের শেখ হেলাল উদ্দীন, টাঙ্গাইল-৫ (সদর) ছানোয়ার হোসেন, ঢাকা-১০ আসনের শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, পাবনা-৪ আসনের নুরুজ্জামান বিশ্বাস, নওগাঁ-২ আসনের শহীদুজ্জামান সরকার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার, পাবনা-৩ আসনের মকবুল হোসেন, ঢাকা-১৩ আসনের সাদেক খান, সিলেট-৪ আসনের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের মুজিবুল হক চুন্নু, লালমনিরহাট-১ আসনের মোতাহার হোসেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা-১২ আসনের আসাদুজ্জামান খান কামাল, বগুড়া-৩ আসনের নুরুল ইসলাম তালুকদার, ঢাকা-১৭ আসনের আকবর হেসেন পাঠান (নায়ক ফারুক), গাজীপুর-২ আসনের এমপি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, কুষ্টিয়া-৩ আসনের মাহবুব উল আলম হানিফ, ঝিনাইদহ-৩ আসনের শফিকুল আজম খান চঞ্চল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেট-১ আসনের ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-৬ শহারিয়ার আলম, জাতীয় সংসদের হুইপ জয়পুরহাট-২ আসনের আবু সাঈদ আল মাহমুদ (স্বপন), বিএনপির এমপি ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান এবং সংরক্ষিত নারী আসনের নাদিরা ইয়াসমিন জলি ও তাহমিনা বেগম কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন।
ডিসেম্বর মাসে শিক্ষামন্ত্রী ও চাদঁপুর-৩ আসনের এমপি ডা. দীপু মনিসহ আট জন এমপির করোনা ধরা পড়ে। অন্যরা হলেন- নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও সিলেট-৬ আসনের নুরুল ইসলাম নাহিদ, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, বগুড়া-১ সাহাদারা মান্নান, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও পাবনা-৫ আসনের গোলাম ফারুক প্রিন্স।
এছাড়াও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপি।
জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, ‘করোনাকালীন আমাদের অনেক সংসদ সদস্যই আক্রান্ত হয়েছেন। জনপ্রতিনিধিদের কাছে তাদের জনগণই শক্তি। তবে সবাইকে সচেতন থেকেই কাজ করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য সবাই দেয় না।
তিনি বলেন, আমিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। সেটা অনেকেই জানে না।
জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আরো বলেন, সদস্যদের কোনো লক্ষ্মণ বা উপসর্গ দেখা গেলেই নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও অসুস্থ এবং বয়স্ক সংসদ সদস্যদের সংসদে না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোস্তাক আহমেদ বলেন, সংসদ সদস্যরা বেশি মানুষের সংস্পর্শে যাওয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এটা সত্য। তবে, এর পেছনে বড় কারণ হচ্ছে নমুনা পরীক্ষা। দেশের সব এমপিদের একাধিকবার নমুনা পরীক্ষা করাতে হয়েছে। সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয়ার কারণে কোনো উপসর্গ ছাড়াই তাদের নমুনা পরীক্ষা করাতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও পরীক্ষা করাতে হয়েছে। যার কারণে তাদের মধ্যে বেশি পজিটিভ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘সংসদ সদস্যসহ সবাইকেই মূল গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরে এবং সেটি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। তাই মাস্ক পরতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে এবং কর্মীদেরও সচেতন করতে হবে।