দিনশেষে উন্মুখ হয়ে ফেসবুকে পরিচিত সবার নিউজফিডে ‘বইমেলা’কে খুঁজবো। সবার বইগুলোর নাম আর ফ্ল্যাপের লেখা জুম করে করে পড়বো। স্বজাতীয়-প্রজাতীয় কোনো টিভি চ্যানেলই দেখি না ; তবু গোটা ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন চ্যানেলে আর অনলাইন নিউজ পোর্টালে ঘুরে ঘুরে বইমেলা’র সব খবর খুঁজবো।
তবু- আমি বইমেলায় যাব না ।
আমার লেখার জমিনের প্রথম ফসল, “তোরসা” এখনো সেইখানেই আছে- ‘জাগৃতি প্রকাশনী’- যেখানে তার সুপ্ত অজানা বীজকে সব রকম প্রভাবক দিয়ে পরম মমতায় এক মহৎ প্রাণ সার্থক এক মহীরুহ করে তুলেছিলেন। এই বইমেলাতেও সেই জমিনে নবান্নের ফসল আসছে । অনেক বেশি যত্নের সেই ফসল ; তাই গোলা ভেঙ্গে অন্যের হাতে তা তুলে দিতে খুব দেরিই হয়ে গেল। তবুও প্রতিপালকের ইশারায় শেষ মুহূর্তের দ্বিধা থরথর চূড়ের সেই অমরাবতী শিগগিরই আসবে; “আদর্শ প্রকাশন” এ “সিবতু” নামে। স্রষ্টার মমতাময় ছোঁয়া যদি এবারেও স্পর্শ বুলিয়ে দেন- সেই ফসল `সিবতু` গেলবারের মতোই হয়তো অনেক আগ্রহী পাঠক নেড়ে চেড়ে দেখবে, কিনেও নিয়ে যাবে।
শুধু তাতে গত মেলার মতন অভাবিত সাফল্যের “সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা” হ্যাংলা লেখকের অটোগ্রাফটা থাকবে না। যাচ্ছেতাই রকম সীমাহীন ভালোবাসা নিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীরা শুরু থেকেই “এই আসছো না? এবার আসছেন কি ? বইমেলায় আসছিস কবে?” জিজ্ঞেস করছে, করেই যাবে-! এই যা!
বই ঠিকই তার লেখনীর সুধা মেপেই পাঠকের তাপিত হিয়া জুড়াবে।
তবুও আমি বইমেলায় যাব না ।
মাত্র ১ বছর আগে এই মেলায় যেই মানুষটা লেখক পরিচয়ে প্রথম পা রাখবার বিশাল আস্পর্ধা দিয়েছিলেন, সে আজ জনম জনমের শোকের কালোয় মুড়ে ‘মন খারাপ করে দেয়া স্টল’টার ফেস্টুন হয়ে গেছেন !
‘প্রয়াত ফয়সল আরেফীন দীপন’- স্বাধীন বাংলায় প্রথম কোনো প্রকাশক হত্যাকাণ্ড । তাঁর পবিত্র রক্তের লালে লাল তাঁর ২৩ বছরের পদচারণায় মুখর বইমেলায় সর্বত্র তাঁকে অস্বীকার করবার, ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা , “কিছুই হয়নি” আর “হাসিমুখো” মুখোশ ধারণ করে আছে । বইমেলার উদ্বোধনে, জ্ঞানী-গুণীদের বক্তৃতায় কেউই তাঁকে স্মরণ করেনি, যেমন করেনি অবিসংবিদিতভাবে এই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণের ৬ মাস পরের বইমেলায়! সবাই দিব্বি আছে ! গোটা জাতিরই কি এমনি গোল্ডফিশ মেমোরি?
সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য হয়ে তাঁর ভালোবাসার অমর নিদর্শন দেখায়, এর পেছনের অন্ধকারতম ইতিহাস আর নির্দয়তম পৈশাচিকতা বাতির নিচের নিকষ কালোয় ঢেকে দেয়। তেমনি “জাগৃতি” র্যাকে রাখা সীমারের কাপুরুষ আঘাতে দীপন ভাইয়ের শেষ নিঃশ্বাস আর রক্তে লেপ্টে থাকা মানিব্যাগ, কলমদানি, পাণ্ডুলিপি, ভাঙা ফ্রেম পরম যত্নে র্যাকে আগলে রাখা ডা. জলী ভাবীর অপার্থিব ভালোবাসা দেখায় না। কারণ, মানুষ মধুর মিথ্যায় আপ্লুত হতে চায়, কপট সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে চায়- নির্মম অসুন্দর সত্যটা দেখতে যায় না।
মাত্র ৩ মাস আগের টাটকা এক দুঃসহ ক্ষত আগলে কি করে “জাগৃতি” এবার মেলায় গিয়ে দাঁড়ালো , কি বার্তা দিতে এতোটা রক্তক্ষরণ তুলে ধরলো তা জানতে চায় না , ‘ওসব কিছুই না’ ভেবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ধুলিওড়া বইমেলার ধূসর জনারণ্যে কপট আমোদে মুখর হয়ে যায়। আদতে আমাদের জাতীয় জীবনে আমোদ প্রমোদের কোনো জায়গা নেই, কোনো ব্যবস্থাও নেই ; এতো ঝুট ঝামেলা, জ্যাম, অফিস সেড়ে বইমেলায় এসে মর্সিয়া ক্রন্দনের বিলাসিতা কারো নেই। ১ মিনিট ‘জাগৃতি’র সামনে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত র্যাক আর ফেস্টুনের দিকে তাকিয়ে নির্দয়তার স্বাক্ষর দেখতে, ১ মিনিট নীরবতা পালন করতে, ১টা বই কিনে পড়ে “চেতনার বিপ্লবে বই ” মূলমন্ত্রের জন্য প্রাণ দেয়া মানুষটার আদর্শকে সন্মান জানাবার সময় বড্ড অপ্রতুল, অনেক বেশি বাহুল্য অপচয়!
আর দীপন ভাইকে যারা জানতেন তাঁদের আছে সব ছাপিয়ে এক অজানা আশংকা! কে জানে, বেশি সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে পরবর্তী নিশানা যদি তাকেই হতে হয়! অথচ পরবর্তী নিশানা যেন কাউকেই আর কোনোদিন না হতে হয় তাই এই বর্বরতার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে, এই বিচারহীনতা নিয়মকে রুখতে হবে, নইলেই বরঞ্চ যেকোনো দুর্বোধ্য সমীকরণে যে কারো নামেই হিসেব মেলাতে পারে নিশানার তীর, যখন তখন- এই তীব্র আশংকা কেউ অনুধাবন করছেই না!
ঠিক যেমন যেমন আমি আশংকা করেছিলাম!
এবং এমন ভেবেই ঠিক করেছিলাম, ২০১৬ বইমেলায় আমি কিছুতেই যাব না।
” দুর্বল চিত্তের জন্য নয় ” ব্যানার দেখে ছোট থেকে চোখ ঢাকতেই শিখে গেছি।
কাঁদতে জানি, বিচারের দাবি জানাতে পারিনি।
তাই সবল হয়েই হয়তো আবার একদিন বইমেলায় যাব; যেদিন বইমেলা আরেকবার আমার কাছে ‘প্রাণের মেলা’ই মনে হবে!