হাওর বার্তা ডেস্কঃ নভেল করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চীনা পণ্য আমদানি প্রায় বন্ধই রয়েছে। ফলে কমছে রাজস্ব আদায়। এক মাস আগেও যেখানে প্রতি মাসে চীন থেকে চার হাজারেরও বেশি কন্টেইনার আসত চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে, সেখানে গত এক মাসের বেশি সময়ে কন্টেইনার এসেছে মাত্র ৩৯৭টি। গত বছরের শেষের দিকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এবং বিক্রি আপাতত বন্ধ রয়েছে। এতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যের প্রায় ৯০ ভাগই আসে চীন থেকে। চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। আমদানি বন্ধ থাকায় কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, সংকট তৈরি হবে আমদানি করা অনেক পণ্যেরও। এসব কারণে কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নামবে, বাড়বে রাজস্ব ঘাটতি। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্যের কোম্পানিগুলো আমদানিনির্ভর। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে দেশে পণ্য তৈরি করে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি থেকে যেমন সরকার ভ্যাট আদায় করে, তেমনি শিল্পের কাঁচামাল ছাড়া অন্যান্য পণ্য আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি আদায় করা হয়। এসবের ওপরই নির্ভর করে সরকারের রাজস্ব আদায়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর মাসে দেশের সবচেয়ে বড় কাস্টম হাউসে কন্টেইনার এসেছে পাঁচ হাজার ২০০টি। ডিসেম্বর মাসে করোনার আবির্ভাবের পর থেকে মূলত কমতে থাকে কন্টেইনার আসা। ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার এসেছিল চার হাজার ২০০টি। আর ১ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কন্টেইনার এসেছে মাত্র ৩৯৭টি। অর্থাৎ এক মাস নয় দিনের ব্যবধানে কন্টেইনার আমদানি কমেছে তিন হাজার ৮০৩টি। এতে কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ও কমেছে। কারণ কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ের অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে বিদেশ থেকে কন্টেইনারের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, কাস্টম হাউসগুলোর রাজস্ব আসে বিদেশ থেকে আমদানি করা কন্টেইনার ভিত্তি করে। কন্টেইনার কমতে থাকলে কাস্টমসের রাজস্ব আদায় তলানিতে গিয়ে ঠেকবে সাধারণত দেশে যেসব পণ্য সমুদ্রপথে আমদানি হয় এর শতকরা ৭০-৮০ ভাগ চীননির্ভর। কারণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটাল মেশিনারিজ থেকে শুরু করে চীনা অনেক পরিপূর্ণ পণ্য (ফিনিশ গুডস) দেশে আসে। এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক অনেক চীনা পণ্যের দাম প্রায় শতভাগ বেড়ে গেছে বলেও জানান তারা।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের অধিকাংশ অফিস ও ব্যাংক বন্ধ। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। চীন থেকে আমদানি করা কাঁচামাল সময়মতো পাবেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান রপ্তানিকারকরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে এখন অধিকাংশ অফিস ও ব্যাংক বন্ধ। ফলে হাজারো চেষ্টা করেও চীনে কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি যে, অন্য কোনো দেশেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। কারণ বিকল্প কোনো দেশই আমরা পাচ্ছি না। চীন বাদ দিয়ে ভারতের দিকে যাব, সেই ভারতও চীনের ওপর নির্ভরশীল। তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুরে পণ্যের জন্য অর্ডার দিলেও কাজ হচ্ছে না। কারণ তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুরও চীনের ওপর নির্ভরশীল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চীন থেকে সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, তৈরি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে, যা মোট আমদানির ২৬ শতাংশেরও বেশি। করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যাংকগুলো এখন চীনে কোনো এলসি খুলছে না। এরই মধ্যে শিপমেন্ট শ্লথ হয়েছে। বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৪১৩ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার জন্য কাঁচামাল আমদানি হয়েছে এক হাজার ২১৭ কোটি মার্কিন ডলারের। আমদানি হওয়া এই কাঁচামালের বড় অংশই চীন থেকে আসে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, চীনের করোনা ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। অর্থনৈতিকভাবে চীনের পর যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই সারিতে বাংলাদেশের নাম তৃতীয়। তাই এসব বিষয় নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরামে কার্যকর উদ্যোগের বিষয়টি অতীব জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি গাজী গোলাম মর্তুজা ভোরের কাগজকে বলেন, সাধারণ চীনা নববর্ষ উপলক্ষে ছুটি থাকে। এই ছুটির আগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে স্টক করে রাখেন। এই সময়ে ব্যবসায়ে একটা শ্লথগতি থাকে কিন্তু তাতে আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তিনি বলেন, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো বিভিন্ন পণ্য ভিন্ন ভিন্ন শহরে হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে চীনের সবকটা প্রদেশে এখন পর্যন্ত ওইভাবে করোনার প্রভাব পড়েনি। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বন্দর সিটিগুলোতে কীভাবে আমাদের আমদানি করা পণ্য আসবে। আমরা সার্বিক বিষয়ে চীন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।