ঢাকা ১২:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা- শেষ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:১৫:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৫
  • ৫২৫ বার

[মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহারীর একটি বিখ্যাত পংক্তি ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়-হার কারাবালাকি বা’দ।’ মহররম এলেই মনে পড়ে সেই কারবালার কথা। কী ঘটেছিল সে দিন কারবালা প্রান্তরে। আর কী পরিণতি হয়েছিল ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার। পাঠকের জানবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা এটি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ধারাবাহিকভাবে পত্রস্থ করছি এই লেখাটি। এটি নেওয়া হয়েছে ‘হযরত আলী (রা.) জীবন ও খিলাফত’ থেকে। তাহলে পড়ুন সে দিনের এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনা পরম্পরা। এই লেখাটি সমাপ্তি টানা হল ইয়াজিদের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনার মধ্যদিয়ে।বি.স]

(পূর্ব প্রকাশের পর)

মুআবিয়া ইবন আবু সুফিয়ানের জনৈক মুক্ত দাস বর্ণনা করেন, ইয়াজিদের সামনে যখন হুসায়িন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক রাখা হল তখন তাকে আমি কাঁদতে দেখেছি এবং বলতে শুনেছি, ইবন যিয়াদ ও হুসায়িনের মাঝে যদি রক্ত সম্পর্ক থাকতো তাহলে সে এটা করতে পারতো না। (আল- বিদয়া ওয়ান নেহায়া, পৃ.১৭১)

বন্দীদেরকে যখন ইয়াজিদের সামনে উপস্থিত করা হল তখন প্রথমে সে তাঁদের প্রতি রুক্ষ আচরণ করল। পরে আবার কোমল আচরণ প্রদর্শন করে তাদের নিজ হারেমে পাঠিয়ে দিল। অতঃপর তাদেরকে সসম্মানে মদীনা শরীফে পাঠিয়ে দিল।

ইতিহাসে এমন কোনো তথ্য বর্ণিত হয়নি যাতে প্রমাণিত হয় যে, ইবন যিয়াদকে সে তার কৃতকর্মের কারণে বরখাস্ত করেছিল বা কোনো সাজা দিয়েছিল কিংবা অন্তত কোনো রকম তিরস্কার করেছিল। পক্ষান্তরে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের কিছু বর্ণনা এসেছে, যা কোনো মুসলমানের পক্ষে শোভনীয় নয়।

হাররার মর্মন্তুদ ঘটনা এবং ইয়াজিদের মৃত্যু

৬৩ হিজরীতে সংঘটিত হাররার মর্মন্তুদ ঘটনা ইসলামের প্রথম যুগের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের ললাটে এক কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকবে। ইয়াজিদ মুসলিম ইবন ওকবাকে মদীনায় তিন দিনব্যাপী নৈরাজ্য চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল। আল্লামা ইবন কাসীর (র.) বলেন, এই তিন দিনে মদীনায় যে ভয়ঙ্কর ফিতনা-ফাসাদ ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইয়াজিদ এভাবে চেয়েছিল তার রাজত্বের বুনিয়াদ মজবুত করতে এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক শাসন ক্ষমতাকে স্থায়িত্ব দান করতে কিন্তু আল্লাহ তাঁর ইচ্ছার বিপরীত ঘটিয়ে তাকে শায়েস্তা করলেন। ফলে মৃত্যু এসে তার স্বপ্নসাধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল।(প্রাগুক্ত, পৃ.২২২)

রাজত্বভোগ করার জন্য ইয়াজিদ চার বছরের বেশি বেঁচে ছিল না। ৩৪ হিজরীর ১৪ রবিউল আউয়াল সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তার মৃত্যুর মাধ্যমেই আবু সুফিয়ানের পরিবারের খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মারওয়ান ইবনুল হাকাম পরিবারের স্থানান্তরিত হয়। আব্বাসীদের হাতে উমাইয়া রাজত্বের পতন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। সর্ব রাজত্বের একচ্ছত্র মালিক হলেন আল্লাহ, যাকে ইচ্ছা তিনি রাজত্ব দান করেন। এবং যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপদস্থ করেন। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ও শাহাদাতে হুসায়িন সম্পর্কে আহলে সুন্নাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের অনুভূতি।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াতের বিশিষ্ট ইমামগণ শুরু থেকেই ইয়াজিদ ও তার সেনাপতিদের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে এসেছেন এবং ইমাম হুসায়িন ও তাঁর সঙ্গী আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যের শাহাদাতকে ইসলামী ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা রূপে গণ্য করে এসেছেন। এখানে অতি সংক্ষেপে দু’-একটি নমুনা ও উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.)-এর পুত্র সালেহ বলেন, আমি আমার আব্বাকে বললাম, একদল লোক ইয়াজিদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে থাকে। তিনি বললেন, প্রিয় পুত্র! আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস পোষণকারী কোনো মুমিন কি ইয়াজিদকে ভালবাসতে পারে? আমি বললাম, আব্বা তাহলে তাকে অভিশাপ কেন দেন না? তিনি বললেন, প্রিয় পুত্র!তুমি কি তোমার আব্বাকে দেখেছ কখনো কাউকে অভিশাপ দিতে?

(ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৪৮৩)

তাতারী ফিতনাকালে মঙ্গল সেনাপতি ‘বোলাই’ যখন দামেস্কে এসেছিল তখন শায়খুল ইসলাম হাফেজ ইবন তাইমিয়া ও তার মাঝে অনুষ্ঠিত আলোচনার এক পর্যায়ে আল্লামা ইবন তাইমিয়া বলেছিলেন, হুসায়িনকে যে হত্যা করেছে, কিংবা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে বা একে সমর্থন করেছে তাদের সকলের প্রতি আল্লাহর, ফেরেশতাগণের এবং সকল মানুষের লানত। আল্লাহর কাছে তাদের ক্ষুদ্র-বৃহৎ কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। (প্রাগুক্ত,পৃ.৪৮৭)

হুসায়িন(রা.)-কে আল্লাহ সেদিন শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেছিলেন এবং যারা তাকে হত্যা করেছে কিংবা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে বা তা সমর্থন করেছে তাদের সকলকে এর মাধ্যমে আল্লাহ অপদস্ত করেছেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী শহীদগণের উত্তম আদর্শ অনুসরণ করেছেন। কেননা, তিনি ও তাঁর ভ্রাতা হলেন জান্নাতী যুবকদের সরদার। অথচ তাঁরা ইসলামের শান-শওকতের ছায়ায় প্রতিপালিত হয়েছেন। ফলে তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা আল্লাহর পথে হিজরতে ও জিহাদের যে অবর্ণনীয় কষ্টভোগ করেছিলেন তা করার সুযোগ ইমাম ভ্রাতৃদ্বয় পাননি। তাই আল্লাহ তাঁদের মর্যাদা পূর্ণ করার এবং মতরতবা বুলন্দ করার জন্য তাঁদেরকে শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেছেন। তাঁর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি বড় ধরনের বিপদ। আর আল্লাহ তায়ালা মুছিবতের সময় ইন্নালিল্লাহ পড়ার বিধান দিয়ে ইরশাদ করেছেন,

‘ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন তারা যখন কোনো মুছিবতে আক্রান্ত হয় তখন বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্য আর নিঃসন্দেহে আমরা তাঁরই সমীপে প্রত্যাবর্তন করব।’ তাদেরই প্রতি রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে শান্তি ও রহমত। এবং তারাই হল হেদায়েতপ্রাপ্ত।(প্রাগুক্ত, পৃ.৫১১)

ইমাম আহমদ ইবন আবদুল আহাদ সারহান্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র.) তাঁর এক পত্রে বলে, “সৌভাগ্য বঞ্চিত ইয়াজিদ নিঃসন্দেহে ফাসিক সম্প্রদায়ভুক্ত।” তবে তার প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণে বিরত থাকার ভিত্তি হল আহলে সুন্নাত অনুসৃত এই মূলনীতি যে, কাফির হলেও কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে হুট করে অভিসম্পাত করা যাবে না, যতক্ষণ না সুনিশ্চিতভাবে এ কথা জানা যায় যে, কুফরির ওপর তার মওত হয়েছে। যেমন— আবু লাহাব ও তাঁর স্ত্রী। তবে এর অর্থ এ নয় যে, সে অভিসম্পাতের উপযুক্ত নয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিসম্পাত করেন।”

মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল হক দেহলবী (র.) স্বরচিত তাকমীলুল ঈমান কিতাবে বলেন, মোট কথা আমাদের নিকট ইয়াজিদ হল ঘৃণ্যতম ব্যক্তিদের অন্যতম। আল্লাহর তাওফিকবঞ্চিত এ হতভাগা যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা এই উম্মতের আর কেউ করেনি।

ইমাম আহমদ ইবন আবদুর রহিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.) তাঁর সুবিখ্যাত হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থে “অতঃপর গোমরাহীর দিকে আহ্বানকারীদের আত্মপ্রকাশ ঘটবে” শীর্ষক হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সিরিয়াতে গোমরাহীর পথে আহ্বানকারী হল ইয়াজিদ আর ইরাকে হল আল-মোখতার।”

এখানে আমরা মহান সংস্কারক আলিম শায়খ রশীদ আহমদ গাংগোহী (র.)-এর ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য পেশ করার মাধ্যমে এ আলোচনার ইতি টানতে চাই। তিনি তাঁর এক ফতোয়ায় বলেন, তাকে অভিসম্পাত করার জায়েয বা না জায়েয হওয়ার ভিত্তি হল ইতিহাস। তবে নীরবতা অবলম্বন করাই হল অধিক সতর্কতার পরিচায়ক এবং আমাদের জন্য অধিকতর শোভনীয়। কেননা, অভিসম্পাত করা জায়েয হলেও না করলে তা কোনো ক্ষতি নেই। অভিসম্পাত করা ফরজ, ওয়াজিব নয়, এমনকি সুন্নাত মুস্তাহাবও নয়। মুবাহ (ধৈর্য) এর অধিক নয়। এমতাবস্থায় যাকে অভিসম্পাত করা হল সে যদি প্রকৃতপক্ষে অভিশাপের পাত্র না হয়ে থাকে তাহলে (অভিসম্পাতের) গোনাহ হতে দূরে থাকাই তো উত্তম।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা- শেষ

আপডেট টাইম : ১০:১৫:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৫

[মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহারীর একটি বিখ্যাত পংক্তি ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়-হার কারাবালাকি বা’দ।’ মহররম এলেই মনে পড়ে সেই কারবালার কথা। কী ঘটেছিল সে দিন কারবালা প্রান্তরে। আর কী পরিণতি হয়েছিল ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার। পাঠকের জানবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা এটি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ধারাবাহিকভাবে পত্রস্থ করছি এই লেখাটি। এটি নেওয়া হয়েছে ‘হযরত আলী (রা.) জীবন ও খিলাফত’ থেকে। তাহলে পড়ুন সে দিনের এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনা পরম্পরা। এই লেখাটি সমাপ্তি টানা হল ইয়াজিদের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনার মধ্যদিয়ে।বি.স]

(পূর্ব প্রকাশের পর)

মুআবিয়া ইবন আবু সুফিয়ানের জনৈক মুক্ত দাস বর্ণনা করেন, ইয়াজিদের সামনে যখন হুসায়িন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক রাখা হল তখন তাকে আমি কাঁদতে দেখেছি এবং বলতে শুনেছি, ইবন যিয়াদ ও হুসায়িনের মাঝে যদি রক্ত সম্পর্ক থাকতো তাহলে সে এটা করতে পারতো না। (আল- বিদয়া ওয়ান নেহায়া, পৃ.১৭১)

বন্দীদেরকে যখন ইয়াজিদের সামনে উপস্থিত করা হল তখন প্রথমে সে তাঁদের প্রতি রুক্ষ আচরণ করল। পরে আবার কোমল আচরণ প্রদর্শন করে তাদের নিজ হারেমে পাঠিয়ে দিল। অতঃপর তাদেরকে সসম্মানে মদীনা শরীফে পাঠিয়ে দিল।

ইতিহাসে এমন কোনো তথ্য বর্ণিত হয়নি যাতে প্রমাণিত হয় যে, ইবন যিয়াদকে সে তার কৃতকর্মের কারণে বরখাস্ত করেছিল বা কোনো সাজা দিয়েছিল কিংবা অন্তত কোনো রকম তিরস্কার করেছিল। পক্ষান্তরে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের কিছু বর্ণনা এসেছে, যা কোনো মুসলমানের পক্ষে শোভনীয় নয়।

হাররার মর্মন্তুদ ঘটনা এবং ইয়াজিদের মৃত্যু

৬৩ হিজরীতে সংঘটিত হাররার মর্মন্তুদ ঘটনা ইসলামের প্রথম যুগের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের ললাটে এক কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকবে। ইয়াজিদ মুসলিম ইবন ওকবাকে মদীনায় তিন দিনব্যাপী নৈরাজ্য চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল। আল্লামা ইবন কাসীর (র.) বলেন, এই তিন দিনে মদীনায় যে ভয়ঙ্কর ফিতনা-ফাসাদ ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইয়াজিদ এভাবে চেয়েছিল তার রাজত্বের বুনিয়াদ মজবুত করতে এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক শাসন ক্ষমতাকে স্থায়িত্ব দান করতে কিন্তু আল্লাহ তাঁর ইচ্ছার বিপরীত ঘটিয়ে তাকে শায়েস্তা করলেন। ফলে মৃত্যু এসে তার স্বপ্নসাধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল।(প্রাগুক্ত, পৃ.২২২)

রাজত্বভোগ করার জন্য ইয়াজিদ চার বছরের বেশি বেঁচে ছিল না। ৩৪ হিজরীর ১৪ রবিউল আউয়াল সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তার মৃত্যুর মাধ্যমেই আবু সুফিয়ানের পরিবারের খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং মারওয়ান ইবনুল হাকাম পরিবারের স্থানান্তরিত হয়। আব্বাসীদের হাতে উমাইয়া রাজত্বের পতন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। সর্ব রাজত্বের একচ্ছত্র মালিক হলেন আল্লাহ, যাকে ইচ্ছা তিনি রাজত্ব দান করেন। এবং যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপদস্থ করেন। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ও শাহাদাতে হুসায়িন সম্পর্কে আহলে সুন্নাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের অনুভূতি।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াতের বিশিষ্ট ইমামগণ শুরু থেকেই ইয়াজিদ ও তার সেনাপতিদের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে এসেছেন এবং ইমাম হুসায়িন ও তাঁর সঙ্গী আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যের শাহাদাতকে ইসলামী ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা রূপে গণ্য করে এসেছেন। এখানে অতি সংক্ষেপে দু’-একটি নমুনা ও উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.)-এর পুত্র সালেহ বলেন, আমি আমার আব্বাকে বললাম, একদল লোক ইয়াজিদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে থাকে। তিনি বললেন, প্রিয় পুত্র! আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস পোষণকারী কোনো মুমিন কি ইয়াজিদকে ভালবাসতে পারে? আমি বললাম, আব্বা তাহলে তাকে অভিশাপ কেন দেন না? তিনি বললেন, প্রিয় পুত্র!তুমি কি তোমার আব্বাকে দেখেছ কখনো কাউকে অভিশাপ দিতে?

(ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৪৮৩)

তাতারী ফিতনাকালে মঙ্গল সেনাপতি ‘বোলাই’ যখন দামেস্কে এসেছিল তখন শায়খুল ইসলাম হাফেজ ইবন তাইমিয়া ও তার মাঝে অনুষ্ঠিত আলোচনার এক পর্যায়ে আল্লামা ইবন তাইমিয়া বলেছিলেন, হুসায়িনকে যে হত্যা করেছে, কিংবা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে বা একে সমর্থন করেছে তাদের সকলের প্রতি আল্লাহর, ফেরেশতাগণের এবং সকল মানুষের লানত। আল্লাহর কাছে তাদের ক্ষুদ্র-বৃহৎ কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। (প্রাগুক্ত,পৃ.৪৮৭)

হুসায়িন(রা.)-কে আল্লাহ সেদিন শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেছিলেন এবং যারা তাকে হত্যা করেছে কিংবা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে বা তা সমর্থন করেছে তাদের সকলকে এর মাধ্যমে আল্লাহ অপদস্ত করেছেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী শহীদগণের উত্তম আদর্শ অনুসরণ করেছেন। কেননা, তিনি ও তাঁর ভ্রাতা হলেন জান্নাতী যুবকদের সরদার। অথচ তাঁরা ইসলামের শান-শওকতের ছায়ায় প্রতিপালিত হয়েছেন। ফলে তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা আল্লাহর পথে হিজরতে ও জিহাদের যে অবর্ণনীয় কষ্টভোগ করেছিলেন তা করার সুযোগ ইমাম ভ্রাতৃদ্বয় পাননি। তাই আল্লাহ তাঁদের মর্যাদা পূর্ণ করার এবং মতরতবা বুলন্দ করার জন্য তাঁদেরকে শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেছেন। তাঁর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি বড় ধরনের বিপদ। আর আল্লাহ তায়ালা মুছিবতের সময় ইন্নালিল্লাহ পড়ার বিধান দিয়ে ইরশাদ করেছেন,

‘ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন তারা যখন কোনো মুছিবতে আক্রান্ত হয় তখন বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর জন্য আর নিঃসন্দেহে আমরা তাঁরই সমীপে প্রত্যাবর্তন করব।’ তাদেরই প্রতি রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে শান্তি ও রহমত। এবং তারাই হল হেদায়েতপ্রাপ্ত।(প্রাগুক্ত, পৃ.৫১১)

ইমাম আহমদ ইবন আবদুল আহাদ সারহান্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র.) তাঁর এক পত্রে বলে, “সৌভাগ্য বঞ্চিত ইয়াজিদ নিঃসন্দেহে ফাসিক সম্প্রদায়ভুক্ত।” তবে তার প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণে বিরত থাকার ভিত্তি হল আহলে সুন্নাত অনুসৃত এই মূলনীতি যে, কাফির হলেও কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে হুট করে অভিসম্পাত করা যাবে না, যতক্ষণ না সুনিশ্চিতভাবে এ কথা জানা যায় যে, কুফরির ওপর তার মওত হয়েছে। যেমন— আবু লাহাব ও তাঁর স্ত্রী। তবে এর অর্থ এ নয় যে, সে অভিসম্পাতের উপযুক্ত নয়। কেননা, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে অভিসম্পাত করেন।”

মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল হক দেহলবী (র.) স্বরচিত তাকমীলুল ঈমান কিতাবে বলেন, মোট কথা আমাদের নিকট ইয়াজিদ হল ঘৃণ্যতম ব্যক্তিদের অন্যতম। আল্লাহর তাওফিকবঞ্চিত এ হতভাগা যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা এই উম্মতের আর কেউ করেনি।

ইমাম আহমদ ইবন আবদুর রহিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (র.) তাঁর সুবিখ্যাত হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থে “অতঃপর গোমরাহীর দিকে আহ্বানকারীদের আত্মপ্রকাশ ঘটবে” শীর্ষক হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সিরিয়াতে গোমরাহীর পথে আহ্বানকারী হল ইয়াজিদ আর ইরাকে হল আল-মোখতার।”

এখানে আমরা মহান সংস্কারক আলিম শায়খ রশীদ আহমদ গাংগোহী (র.)-এর ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য পেশ করার মাধ্যমে এ আলোচনার ইতি টানতে চাই। তিনি তাঁর এক ফতোয়ায় বলেন, তাকে অভিসম্পাত করার জায়েয বা না জায়েয হওয়ার ভিত্তি হল ইতিহাস। তবে নীরবতা অবলম্বন করাই হল অধিক সতর্কতার পরিচায়ক এবং আমাদের জন্য অধিকতর শোভনীয়। কেননা, অভিসম্পাত করা জায়েয হলেও না করলে তা কোনো ক্ষতি নেই। অভিসম্পাত করা ফরজ, ওয়াজিব নয়, এমনকি সুন্নাত মুস্তাহাবও নয়। মুবাহ (ধৈর্য) এর অধিক নয়। এমতাবস্থায় যাকে অভিসম্পাত করা হল সে যদি প্রকৃতপক্ষে অভিশাপের পাত্র না হয়ে থাকে তাহলে (অভিসম্পাতের) গোনাহ হতে দূরে থাকাই তো উত্তম।