ঢাকা ০৩:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলপাইয়ের দেশে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১৬:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০১৫
  • ৫০৯ বার

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দহলা খাগড়াবাড়ী মৌজা। কিছুদিন আগে ছিল ভারতের ছিটমহল। এখন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়ছে। ছিটমহল বিনিময়ের পর এ অঞ্চল এখন মিশে গেছে ঘন সবুজ, নদী আর মুক্ত বাতাসের রূপসী বাংলাদেশের সঙ্গে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের এই সমারোহে অসংখ্য গাছগাছালি। আম, জাম, কাঁঠাল তো আছেই, সবচেয়ে বেশি আছে দুরন্ত কিশোরীর ঝাঁকড়া চুলের মতো লিচুগাছের সারি। আর আছে জলপাইগাছ। একটা দুটো করে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই। সীমান্ত থেকে দেবীগঞ্জের দিকে আসার সময় যত বেশি ভেতরে চোখ যায় তত বেশি চোখে পড়ে জলপাইগাছ। এক-দুই-চার-দশ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে জলপাইগাছের সংখ্যা।

রাস্তার ধারে ধারে জলপাইগাছ

সেখানে শীতের সামান্য আগে আগে, সকালের মিষ্টি সোনাঝরা রোদে সোনালি ধানের ওপর হীরার ঝলকানি শিশির আর সবুজ গাছ-গাছালিতে প্রকৃতি ঢেলেছে তার রূপের ডালা। মধুর সে গানের মতো, ‘ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি…।’ অপরূপ এ দৃশ্যের মোহনীয় তুলির আঁচড়টি কেটেছে সবুজ, লাল আর চিত্রাল পাতার জলপাইগাছ। ধরে আছে থোকায় থোকায় ডাঁসা সবুজ জলপাই। তাকাতেই জিভে জল আসে। একটা দুটো নয়, পুরো উপজেলায় রয়েছে হাজার হাজার জলপাইগাছ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে।

বাবুল মিয়া ব্যবসা করেন। বছর তিনেক আগে শখের বশে লাগিয়েছেন আশিটি জলপাই চারা। এখন বড় হয়েছে। ফল এসেছে ছাব্বিশটিতে। প্রতিটি গাছে প্রায় এক শ কেজি। নিজেদের জন্য রেখে বাকি গাছগুলোর ফল বিক্রি করেছেন। ‘এবার তো প্রথম ধরেছে, বিক্রির টাকা দিয়ে একটা ফ্রিজ কিনেছি।’-জানালেন বাবুল।

গাছের ফল বিক্রি করার জন্য দেবীগঞ্জে গড়ে উঠেছে জলপাই হাট। শুধু একটি ফল, জলপাইয়ের জন্য আর কতটুকুই জায়গা দরকার! কিন্তু বাজার দেখে চোখ কপালে উঠল। বিশাল বাজার। ট্রাক, পিক-আপ আর ভ্যানগাড়িতে উঠানো-নামানো হচ্ছে জলপাই। ছোট ছোট টিলার মতো স্তুপে স্তুপে আছে জলপাই। পাইকার আনোয়ার হোসেন জানান, ‘এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ জলপাই কেনাবেচা হয়। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে অগ্রহায়ণের শেষ পর্যন্ত তিন মাস জলপাইয়ের মৌসুম। এখান থেকে চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের সব জায়গায় জলপাই যায়। স্কয়ার, প্রাণ-এর মতো বড় বড় কম্পানি এখান থেকে জলপাই সংগ্রহ করে।’

এখানকার জলপাই আকারে বেশ বড়। কিছু কিছু তো প্রায় আমড়ার মতো। আকারভেদে প্রতি কেজি পাঁচ থেকে ২৫ টাকা। জলপাই হাটে কথা হয় দেবীগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি হাজি গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকার মাটি ও পরিবেশ জলপাই উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। অনেক মানুষ আছে, যারা জলপাই দিয়েই জীবন বদলে ফেলেছে। এইটা তো অনেকটা বাড়তি ফসলের মতো। বাড়িতে তো অনেক গাছই থাকে, সেখানে যদি কয়েকটা জলপাইগাছ থাকে, তাহলে নিজেরা খেয়ে বিক্রিও করা যায়। আর এ জন্যই আমাদের দেবীগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে জলপাইগাছ রয়েছে। পাশাপাশি অনেকে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করেছে এবং সফল হয়েছে। কোনো বছর ফল না এলেও পরের বছর আসে। আবার এক গাছে ফল না এলেও অন্য গাছে আসে। আবার ফল না এলেও গাছ তো বড় হচ্ছে, কাঠ হচ্ছে। এই গাছের কাঠও কিন্তু ভালো।’

বাজার ঘুরে দেখা গেল ফেলে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য জলপাই। ফেলে দেওয়া জলপাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা হাটে। হাটের বাইরে দেখা গেল একজন ময়লার বদলে জলপাই ফেলছে। তার নাম ফজলে রাব্বানী। বাজার পরিষ্কারের কাজ করে। জানাল, প্রতিদিন শত শত কেজি জলপাই নষ্ট হয়।

যেসব জলপাই ফেলে দেওয়া হয়, এগুলো দেখলে মনে হয় ভালো। খুব সামান্য কারণে বড় পাইকাররা চাষিদের কিছু জলপাই বাজেয়াপ্ত করেন। আর সেগুলোর পরিমাণ হয়ে যায় শত শত কেজি। এ প্রসঙ্গে হাজি গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘জলপাইয়ের দাম তো অনেক কম, তাই মায়া থাকে না। আর আমাদের দেশে তো জলপাইয়ের তেমন ব্যবহার নেই। আচার তৈরিতে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া কাঁচা জলপাই মানুষ আর কয়টাই বা খায়?’ জলপাই দিয়ে আর কী করা যায়-জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘জলপাই তেল মানে অলিভ অয়েলের দাম কত? অলিভ অয়েল তো এই জলপাই থেকেই আসে। স্পেনের অলিভ অয়েল তো পৃথিবী বিখ্যাত। স্পেনসহ অনেক উন্নত দেশে অলিভ অয়েল উৎপাদন হলে আমাদের দেশে হবে না কেন? তা ছাড়া আমাদের শরীরের জন্যও তো অলিভ অয়েল অনেক উপকারী। এদিকে দেখার কেউ নেই। এখানে জলপাই থেকে তেল উৎপাদন হলে কৃষকরা ভালো দাম পেত, দেশের লাভ হতো। বিদেশে রপ্তানিও করা যেত।’ বাজারে জলপাইয়ের তেলের (অলিভ অয়েল) দাম বেশ চড়া। উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশেও উৎপাদিত হবে উন্নতমানের অলিভ অয়েল।

দেবীগঞ্জ থেকে চলে আসার সময় শেষ বিকেলের কন্যাসুন্দরী রোদ আছড়ে পড়ছে দেবীগঞ্জের সবুজের সমারোহে। আর রঙিন পাতার ফাঁক গলে সবুজ জলপাইয়ের থোকা বেরিয়ে আছে। এই জলপাই তাকিয়ে কী যেন সংকেত দিচ্ছে। যুদ্ধে শান্তির প্রতীক জলপাইয়ের আবেদন সত্যিই খুব মোহনীয়। আর এই মোহনীয় আবেদন নিয়ে তরতর করে বেড়ে উঠছে আসংখ্য জলপাই গাছ, ভরে উঠছে আমাদের জলপাই গ্রামগুলো।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

জলপাইয়ের দেশে

আপডেট টাইম : ১১:১৬:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০১৫

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দহলা খাগড়াবাড়ী মৌজা। কিছুদিন আগে ছিল ভারতের ছিটমহল। এখন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়ছে। ছিটমহল বিনিময়ের পর এ অঞ্চল এখন মিশে গেছে ঘন সবুজ, নদী আর মুক্ত বাতাসের রূপসী বাংলাদেশের সঙ্গে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজের এই সমারোহে অসংখ্য গাছগাছালি। আম, জাম, কাঁঠাল তো আছেই, সবচেয়ে বেশি আছে দুরন্ত কিশোরীর ঝাঁকড়া চুলের মতো লিচুগাছের সারি। আর আছে জলপাইগাছ। একটা দুটো করে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই। সীমান্ত থেকে দেবীগঞ্জের দিকে আসার সময় যত বেশি ভেতরে চোখ যায় তত বেশি চোখে পড়ে জলপাইগাছ। এক-দুই-চার-দশ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে জলপাইগাছের সংখ্যা।

রাস্তার ধারে ধারে জলপাইগাছ

সেখানে শীতের সামান্য আগে আগে, সকালের মিষ্টি সোনাঝরা রোদে সোনালি ধানের ওপর হীরার ঝলকানি শিশির আর সবুজ গাছ-গাছালিতে প্রকৃতি ঢেলেছে তার রূপের ডালা। মধুর সে গানের মতো, ‘ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি…।’ অপরূপ এ দৃশ্যের মোহনীয় তুলির আঁচড়টি কেটেছে সবুজ, লাল আর চিত্রাল পাতার জলপাইগাছ। ধরে আছে থোকায় থোকায় ডাঁসা সবুজ জলপাই। তাকাতেই জিভে জল আসে। একটা দুটো নয়, পুরো উপজেলায় রয়েছে হাজার হাজার জলপাইগাছ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে।

বাবুল মিয়া ব্যবসা করেন। বছর তিনেক আগে শখের বশে লাগিয়েছেন আশিটি জলপাই চারা। এখন বড় হয়েছে। ফল এসেছে ছাব্বিশটিতে। প্রতিটি গাছে প্রায় এক শ কেজি। নিজেদের জন্য রেখে বাকি গাছগুলোর ফল বিক্রি করেছেন। ‘এবার তো প্রথম ধরেছে, বিক্রির টাকা দিয়ে একটা ফ্রিজ কিনেছি।’-জানালেন বাবুল।

গাছের ফল বিক্রি করার জন্য দেবীগঞ্জে গড়ে উঠেছে জলপাই হাট। শুধু একটি ফল, জলপাইয়ের জন্য আর কতটুকুই জায়গা দরকার! কিন্তু বাজার দেখে চোখ কপালে উঠল। বিশাল বাজার। ট্রাক, পিক-আপ আর ভ্যানগাড়িতে উঠানো-নামানো হচ্ছে জলপাই। ছোট ছোট টিলার মতো স্তুপে স্তুপে আছে জলপাই। পাইকার আনোয়ার হোসেন জানান, ‘এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ জলপাই কেনাবেচা হয়। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে অগ্রহায়ণের শেষ পর্যন্ত তিন মাস জলপাইয়ের মৌসুম। এখান থেকে চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের সব জায়গায় জলপাই যায়। স্কয়ার, প্রাণ-এর মতো বড় বড় কম্পানি এখান থেকে জলপাই সংগ্রহ করে।’

এখানকার জলপাই আকারে বেশ বড়। কিছু কিছু তো প্রায় আমড়ার মতো। আকারভেদে প্রতি কেজি পাঁচ থেকে ২৫ টাকা। জলপাই হাটে কথা হয় দেবীগঞ্জ বাজার বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি হাজি গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকার মাটি ও পরিবেশ জলপাই উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। অনেক মানুষ আছে, যারা জলপাই দিয়েই জীবন বদলে ফেলেছে। এইটা তো অনেকটা বাড়তি ফসলের মতো। বাড়িতে তো অনেক গাছই থাকে, সেখানে যদি কয়েকটা জলপাইগাছ থাকে, তাহলে নিজেরা খেয়ে বিক্রিও করা যায়। আর এ জন্যই আমাদের দেবীগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে জলপাইগাছ রয়েছে। পাশাপাশি অনেকে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করেছে এবং সফল হয়েছে। কোনো বছর ফল না এলেও পরের বছর আসে। আবার এক গাছে ফল না এলেও অন্য গাছে আসে। আবার ফল না এলেও গাছ তো বড় হচ্ছে, কাঠ হচ্ছে। এই গাছের কাঠও কিন্তু ভালো।’

বাজার ঘুরে দেখা গেল ফেলে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য জলপাই। ফেলে দেওয়া জলপাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারা হাটে। হাটের বাইরে দেখা গেল একজন ময়লার বদলে জলপাই ফেলছে। তার নাম ফজলে রাব্বানী। বাজার পরিষ্কারের কাজ করে। জানাল, প্রতিদিন শত শত কেজি জলপাই নষ্ট হয়।

যেসব জলপাই ফেলে দেওয়া হয়, এগুলো দেখলে মনে হয় ভালো। খুব সামান্য কারণে বড় পাইকাররা চাষিদের কিছু জলপাই বাজেয়াপ্ত করেন। আর সেগুলোর পরিমাণ হয়ে যায় শত শত কেজি। এ প্রসঙ্গে হাজি গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘জলপাইয়ের দাম তো অনেক কম, তাই মায়া থাকে না। আর আমাদের দেশে তো জলপাইয়ের তেমন ব্যবহার নেই। আচার তৈরিতে ব্যবহার হয়। এ ছাড়া কাঁচা জলপাই মানুষ আর কয়টাই বা খায়?’ জলপাই দিয়ে আর কী করা যায়-জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘জলপাই তেল মানে অলিভ অয়েলের দাম কত? অলিভ অয়েল তো এই জলপাই থেকেই আসে। স্পেনের অলিভ অয়েল তো পৃথিবী বিখ্যাত। স্পেনসহ অনেক উন্নত দেশে অলিভ অয়েল উৎপাদন হলে আমাদের দেশে হবে না কেন? তা ছাড়া আমাদের শরীরের জন্যও তো অলিভ অয়েল অনেক উপকারী। এদিকে দেখার কেউ নেই। এখানে জলপাই থেকে তেল উৎপাদন হলে কৃষকরা ভালো দাম পেত, দেশের লাভ হতো। বিদেশে রপ্তানিও করা যেত।’ বাজারে জলপাইয়ের তেলের (অলিভ অয়েল) দাম বেশ চড়া। উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশেও উৎপাদিত হবে উন্নতমানের অলিভ অয়েল।

দেবীগঞ্জ থেকে চলে আসার সময় শেষ বিকেলের কন্যাসুন্দরী রোদ আছড়ে পড়ছে দেবীগঞ্জের সবুজের সমারোহে। আর রঙিন পাতার ফাঁক গলে সবুজ জলপাইয়ের থোকা বেরিয়ে আছে। এই জলপাই তাকিয়ে কী যেন সংকেত দিচ্ছে। যুদ্ধে শান্তির প্রতীক জলপাইয়ের আবেদন সত্যিই খুব মোহনীয়। আর এই মোহনীয় আবেদন নিয়ে তরতর করে বেড়ে উঠছে আসংখ্য জলপাই গাছ, ভরে উঠছে আমাদের জলপাই গ্রামগুলো।