ঢাকা ১০:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ময়মনসিংহ তিন মাসে হাওয়া সহস্রাধিক গাছ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৬:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৫
  • ৪৩৪ বার

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের মাটির সড়কের মূল্যবান গাছ গত তিন মাস ধরে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। সহস্রাধিক গাছ এরই মধ্যে কাটা হয়েছে। গাছ কাটছেন গারো নেত্রী রেবেকা মানকিন। তিনি এলাকায় সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের আত্মীয় পরিচয় দেন। প্রমোদ ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি)।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত তিন-চার মাস আগে হঠাৎ করে উপজেলার সদর ও পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কের দুই পাশের গাছ কাটা শুরু হয়। মেহগনি, শিশু, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হয়। হঠাৎ গাছ কাটার দৃশ্য দেখে স্থানীয় লোকজন এ বিষয়ে খোঁজ নেন। তাঁরা জানতে পারেন রেবেকা মানকিনের লোকজন গাছগুলো কাটছে। স্থানীয় লোকজন এ বিষয়ে রেবেকা মানকিনকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, সরকারের নির্দেশে এবং নিয়ম মেনে এ গাছগুলো কাটছেন। স্থানীয় এমপির আত্মীয় হিসেবে পরিচিত হওয়ায় এবং তাঁর নাম-পরিচয় ব্যবহার করায় স্থানীয়রা বিষয়টি নিয়ে আর এগোয়নি। বলতে গেলে প্রশাসনের জ্ঞাতসারে গত তিন মাসে সহস্রাধিক গাছ বিভিন্ন এলাকা থেকে কেটে নিয়ে যান রেবেকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৫ বছর বা তারও আগে ধোবাউড়া ওয়ার্ল্ড ভিশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) উপজেলার বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপণ করে। অনেক স্থানে বৃক্ষ রোপণের সময় গারো নারীরা যুক্ত ছিলেন। বন বিভাগের নিয়মানুযায়ী এসব গাছ পরিপক্ক হলে তা বিক্রি করে আয় হওয়া টাকা উপকারভোগী, জমির মালিক, ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভাগাভাগি করে নেবে। এসব গাছ কবে কাটা হবে, এর মূল্য কত হবে, কারা গাছ বিক্রি করবে তা নির্ধারণ করবে উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটি। কিন্তু ধোবাউড়ায় এসব সড়কের গাছ কাটার বিষয়ে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে রেবেকা মানকিন প্রকাশ্যে গাছ কাটা শুরু করেন। এখনো তা অব্যাহত আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

ধোবাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশের সড়কের সব গাছ সম্প্রতি কেটে ফেলা হয়েছে। এসব গাছ কাটার ব্যাপারে এলাকার জনপ্রতিনিধি হয়েও আমি কিছুই জানি না। গাছ কাটা নিয়ে এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ।’

আরেক ইউপি সদস্য লোকমান হোসেন বলেন, ‘এলাকার হাজংপাড়া থেকে সাপমারী বাজার পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কের অন্তত এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে।’

পোড়াকান্দুলিয়া ইউপির সদস্য জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমার এলাকার দুধনই থেকে কাশিনাথপুর পর্যন্ত সড়কে প্রায় ৪০০-৫০০ গাছ কাটা হয়েছে।’

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে সড়কগুলো দেখভাল করে উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ। এ ছাড়া উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা প্রকৌশলী।

ধোবাউড়া উপজেলা প্রকৌশলী বাবলু মিয়া বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে ওই নারী (রেবেকা মানকিন) এসব গাছ কাটার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তিনি গাছ কাটার পক্ষে কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। তাই তাঁকে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি।’ তিনি এ ব্যাপারে লিখিতভাবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়ে ছিলেন। তবে এখন গাছ কাটার বিষয়টি তিনি অবহিত নন।

ধোবাউড়া উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ময়মনসিংহ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা জাকারিয়া আহম্মেদ বলেন, ‘সড়কের গাছ পরিপক্ক হলে তা কাটার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেটি সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বন বিভাগ গাছের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু ধোবাউড়ায় গাছ বিক্রির জন্য কোনো মূল্য নির্ধারণ করে দেইনি। এ জন্য আমাকে প্রশাসন থেকে কেউ কিছু বলেওনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সড়কের গাছ কেটে বিক্রি হলে নিয়মানুযায়ী বিভিন্ন ভাগে জমির মালিক, পরিচর্যাকারী, ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকার রাজস্ব পাবে।’

ওয়ার্ল্ড ভিশন ধোবাউড়া শাখার ব্যবস্থাপক ব্রাউন্সং দারিং বলেন, ‘অনেক বছর আগে এ গাছগুলো ওয়ার্ল্ড ভিশন রোপণ করেছিল। কিন্তু সেই গাছের ওপর আমাদের আর এখন কোনো দাবি নেই। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্যও নেই।’

এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিমন্ত্রীর পরিচিত হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন গাছ কাটার বিষয়টি জেনেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি পুরনো এবং জটিল। সেই এরশাদের আমলে এ গাছগুলো রোপণ করা হয়। কিছু গারো নারী তখন এগুলো তদারকি করতেন। কয়েক বছর ধরে রেবেকা মানকিন এসব গাছ কাটার জন্য আমাদের কাছে আসেন। ওই নারী আগের ইউএনওর কাছেও এসেছিলেন। সম্প্রতি তিনি কিছু গাছ কেটেও ফেলেছেন। আমরা ওই নারীকে আটক করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গারো নেত্রী রেবেকা মানকিনের মুঠোফোন নম্বরে গত সোমবার কল করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর ওই দিন ও গতকাল মঙ্গলবার বারবার কল করে ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

ময়মনসিংহ-১ আসনের এমপি ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের মুঠোফোন নম্বরে সাড়ে ৪টার দিকে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

ময়মনসিংহ তিন মাসে হাওয়া সহস্রাধিক গাছ

আপডেট টাইম : ১২:০৬:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৫

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের মাটির সড়কের মূল্যবান গাছ গত তিন মাস ধরে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে। সহস্রাধিক গাছ এরই মধ্যে কাটা হয়েছে। গাছ কাটছেন গারো নেত্রী রেবেকা মানকিন। তিনি এলাকায় সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের আত্মীয় পরিচয় দেন। প্রমোদ ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি)।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত তিন-চার মাস আগে হঠাৎ করে উপজেলার সদর ও পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কের দুই পাশের গাছ কাটা শুরু হয়। মেহগনি, শিশু, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হয়। হঠাৎ গাছ কাটার দৃশ্য দেখে স্থানীয় লোকজন এ বিষয়ে খোঁজ নেন। তাঁরা জানতে পারেন রেবেকা মানকিনের লোকজন গাছগুলো কাটছে। স্থানীয় লোকজন এ বিষয়ে রেবেকা মানকিনকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, সরকারের নির্দেশে এবং নিয়ম মেনে এ গাছগুলো কাটছেন। স্থানীয় এমপির আত্মীয় হিসেবে পরিচিত হওয়ায় এবং তাঁর নাম-পরিচয় ব্যবহার করায় স্থানীয়রা বিষয়টি নিয়ে আর এগোয়নি। বলতে গেলে প্রশাসনের জ্ঞাতসারে গত তিন মাসে সহস্রাধিক গাছ বিভিন্ন এলাকা থেকে কেটে নিয়ে যান রেবেকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৫ বছর বা তারও আগে ধোবাউড়া ওয়ার্ল্ড ভিশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) উপজেলার বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপণ করে। অনেক স্থানে বৃক্ষ রোপণের সময় গারো নারীরা যুক্ত ছিলেন। বন বিভাগের নিয়মানুযায়ী এসব গাছ পরিপক্ক হলে তা বিক্রি করে আয় হওয়া টাকা উপকারভোগী, জমির মালিক, ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভাগাভাগি করে নেবে। এসব গাছ কবে কাটা হবে, এর মূল্য কত হবে, কারা গাছ বিক্রি করবে তা নির্ধারণ করবে উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটি। কিন্তু ধোবাউড়ায় এসব সড়কের গাছ কাটার বিষয়ে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে রেবেকা মানকিন প্রকাশ্যে গাছ কাটা শুরু করেন। এখনো তা অব্যাহত আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

ধোবাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশের সড়কের সব গাছ সম্প্রতি কেটে ফেলা হয়েছে। এসব গাছ কাটার ব্যাপারে এলাকার জনপ্রতিনিধি হয়েও আমি কিছুই জানি না। গাছ কাটা নিয়ে এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ।’

আরেক ইউপি সদস্য লোকমান হোসেন বলেন, ‘এলাকার হাজংপাড়া থেকে সাপমারী বাজার পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কের অন্তত এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে।’

পোড়াকান্দুলিয়া ইউপির সদস্য জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমার এলাকার দুধনই থেকে কাশিনাথপুর পর্যন্ত সড়কে প্রায় ৪০০-৫০০ গাছ কাটা হয়েছে।’

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে সড়কগুলো দেখভাল করে উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ। এ ছাড়া উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা প্রকৌশলী।

ধোবাউড়া উপজেলা প্রকৌশলী বাবলু মিয়া বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে ওই নারী (রেবেকা মানকিন) এসব গাছ কাটার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তিনি গাছ কাটার পক্ষে কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। তাই তাঁকে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি।’ তিনি এ ব্যাপারে লিখিতভাবে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়ে ছিলেন। তবে এখন গাছ কাটার বিষয়টি তিনি অবহিত নন।

ধোবাউড়া উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ময়মনসিংহ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা জাকারিয়া আহম্মেদ বলেন, ‘সড়কের গাছ পরিপক্ক হলে তা কাটার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেটি সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বন বিভাগ গাছের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু ধোবাউড়ায় গাছ বিক্রির জন্য কোনো মূল্য নির্ধারণ করে দেইনি। এ জন্য আমাকে প্রশাসন থেকে কেউ কিছু বলেওনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘সড়কের গাছ কেটে বিক্রি হলে নিয়মানুযায়ী বিভিন্ন ভাগে জমির মালিক, পরিচর্যাকারী, ইউনিয়ন পরিষদ ও সরকার রাজস্ব পাবে।’

ওয়ার্ল্ড ভিশন ধোবাউড়া শাখার ব্যবস্থাপক ব্রাউন্সং দারিং বলেন, ‘অনেক বছর আগে এ গাছগুলো ওয়ার্ল্ড ভিশন রোপণ করেছিল। কিন্তু সেই গাছের ওপর আমাদের আর এখন কোনো দাবি নেই। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্যও নেই।’

এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিমন্ত্রীর পরিচিত হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন গাছ কাটার বিষয়টি জেনেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি পুরনো এবং জটিল। সেই এরশাদের আমলে এ গাছগুলো রোপণ করা হয়। কিছু গারো নারী তখন এগুলো তদারকি করতেন। কয়েক বছর ধরে রেবেকা মানকিন এসব গাছ কাটার জন্য আমাদের কাছে আসেন। ওই নারী আগের ইউএনওর কাছেও এসেছিলেন। সম্প্রতি তিনি কিছু গাছ কেটেও ফেলেছেন। আমরা ওই নারীকে আটক করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গারো নেত্রী রেবেকা মানকিনের মুঠোফোন নম্বরে গত সোমবার কল করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর ওই দিন ও গতকাল মঙ্গলবার বারবার কল করে ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

ময়মনসিংহ-১ আসনের এমপি ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের মুঠোফোন নম্বরে সাড়ে ৪টার দিকে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।