আমাদের গ্রাম্য ডাক্তার ছিল ‘ঢেঁকি’

সেই শৈশবের কথা। আমাদের রান্নাঘরে একটি ঢেঁকি ছিল। মা-দাদীর কাছ থেকে শুনেছি, এটি চল্লিশের দশকে তৈরি করেছিলেন আমার দাদা, তাঁর বাবার (আমার বড় বাপ) লাগানো কাঁঠাল গাছের কাঠ দিয়ে। দেখতে চকচক করতো। আমাদের মা-চাচী-ফুফুরা এই ঢেঁকি দিয়েই ধান বেনে চাল করতেন, তৈরি করতেন মৌসুমী পিঠা। সেই ঢেঁকি এতই প্রিয় ছিল যে প্রতিবেশিরাও ধান বানতে আমাদের বাড়িতে আসতেন। প্রসঙ্গত, ওই ঢেঁকি শুধু ধান বান্নার কাজেই ব্যবহৃত হতো না। সেটি একজন ডাক্তারের ভুমিকাও পালন করতো। আমাদের পরিবারের সদস্যদের সারাবছর বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতো। এমন কি পাড়া প্রতিবেশীদেরও । ফলে আমাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য কোনোদিন হাসপাতালে যেতে দেখেনি। শুধু ডাক্তার বাবুর ভুমিকাই পালন করতো না, আমাদের বিনোদনও দিত। পাঠকরা হয়তো বলতে পারেন, সেটা আবার কেমন কথা! ঢেঁকি আবার ডাক্তার হয় কিভাবে, বিনোদন দেয় কী করে! সুপ্রিয় পাঠক, এটা অনেকের কাছে রূপকথার গল্প মনে হতে পারে।কিন্তু সেটা কোনো রূপকথা নয়, বাস্তবেই তা ছিল। সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে কথা, প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তখন আমরা দেখতাম, আমাদের গ্রামে ঘরে ঘরে ঢেঁকি ছিল। এগুলো সাধারণত রান্না ঘরেই পাতা হতো। আমাদের মা-চাচীরা কমবেশি সারা বছরই বিশেষ করে বোরো, আমন ও আউস এই তিন মওসুমে দিনরাতে ঢেঁকিতে ধান বানতেন আর সারাবছরের জন্য সংরক্ষণ করতেন। এমন কি আমন মৌসুমে মৌসুমী পিঠার আমন্ত্রণে খালা-ফুফু ও অন্যান্য স্বজনরা বেড়াতে আসতেন। বিয়ে কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান থাকলে তো কোনো কথাই নেই, মামাতো- ফুফাতো, চাচাতো বোনেরা তো দলবেঁধে গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী গীত গাইতে গাইতে ঢেঁকিতে ধান ছাটাই আর পিঠা-চিড়া তৈরি করতেন। সারারাত রান্নাঘরে ঢেঁকির শব্দ আর কৌতুক-হাঁসির গল্পে বোন-ভাবীদের অট্টহাসিতে কী আনন্দ!কখনও কখনও তাদের এই আনন্দ-হাসির শব্দে গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। ঘুম থেকে উঠে সোজা রান্নাঘরে যেতাম এবং তাদের সাথে যোগ দিতাম। ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত এ আনন্দ চলতো। কখনও কখনও দেখতাম, উঠতি বয়সী মামাতো- ফুফাতো, চাচাতো বোনেরা ঢেঁকিতে ধান বানতে বানতে আর কৌতুক-গীতের অট্টহাসিতে ঘেমে একাকার হয়ে যেত। মাথার ঘাম গাল বেয়ে পড়তো, ঘামে শরীরের কাপড় ভিজে যেত। সে দৃশ্য সত্যিই অপরূপ। “ও বউ ধান বানে রে ঢেঁকিতে পা দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া , ও বউ ধান বানে রে” গ্রামীণ এই ঐতিহ্যবাহী লোকজ গানটি আর তেমন শোনা যায় না। আজকাল চোখে পড়ে না আর ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে গ্রামীণ বউদের এই গান গাওয়ার দৃশ্য। কালের পরিবর্তনে গ্রাম-বাংলা থেকে এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন ঢেঁকির কদর গ্রাম-বাংলার কৃষকদের বাড়ি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা কিছু কৃষকদের বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখনও চোখে পড়ে। কিন্তু তাও জরাজির্ণ। চলছে না এর কোন কার্যক্রম। কিন্তু আধুনিকতার ছুঁয়ায় আসলে সেই ঢেঁকির আবেদন শেষ হয়ে গেছে? ছোটকালে স্কুলজীবনে বাংলা বইয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম ‌‘লাল চাল আর সাদা চাল’। পড়েছিলাম- ঢেঁকি ছাটা চালরে অনেক গুণের কথা। এই ঢেঁকি নিয়ে কবি- সাহিত্যিকরাও লিখেছেন। ঢেঁকির গুণে প্রবাদ রচনা করেছেন গুণিজনেরা- ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে।’ কবিরাজি ও ঔষধি চিকিৎসকদের ভাষাতেও- লাল চাল প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি, সাদা, তৈলাক্ত ও শক্ত লাল চাল। এ ধরনের চাল কেবল জিহ্বার রুচিই বাড়ায় না, বাড়ায় হজমি শক্তিও। একইসঙ্গে দূর করে প্রদাহও। লাল চাল গ্রহণে শারীরিক সক্ষমতা ও সৌন্দর্য, বীর্যের মান বৃদ্ধি পায়, স্বর সুন্দর হয় এবং তীব্র তৃষ্ণা ও জ্বর দূর হয়। আধুনিক গবেষকদের মতে, চালের উপর যে লাল আবরণ থাকে তা শুধু স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি নয়, তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। এছাড়া ঢেঁকিতে পাড় দিলে মেয়েদের এক ধরনের কায়িক পরিশ্রম হয়, যা স্বাস্থের‌্য জন্য ব্যয়ামের একটি অংশ এবং উপকারিও বটে। সাদা চালের ভাতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। বিপরীতে লাল চাল খাওয়ায় এ ঝুঁকি কমে যায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক এ ব্যাপারে গবেষণা করে এ ফল পেয়েছেন। গবেষকরা বলেছেন, খাদ্য তালিকায় লাল চালসহ আটার রুটিজাতীয় খাবার ও যব থাকলে তাতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে। ‘হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ’-এর কয়েকজন গবেষক তাদের গবেষণাপত্রে বলেছেন যে, প্রতি সপ্তাহে পাঁচ বেলা বা তারও বেশিবার সাদা চালের ভাত খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ১৭ শতাংশ বাড়তে পারে।অন্যদিকে ১১ শতাংশ ঝুঁকি কমে সপ্তাহে দুই বেলা বা তারও বেশিবার লাল চালের ভাত খেলে। গবেষণা দলের প্রধান ড. কুই সান বলেন, সাদা চাল রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বাদামি চালে আঁশের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এটি থেকে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ নিঃসরিত হয়। গবেষকদের ধারণা, সাদা চালের পরিবর্তে বাদামি চালসহ আটার রুটি, যব বা এর তৈরি খাবার এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঝুঁকি কমায়। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আধুনিকতা বলে কথা। বর্তমান সময়ে ধান, চালের আঁটা ও চিড়া ভাঙানোর জন্য বৈদ্যুতিক মিল হওয়ায় সহজেই কম সময়ে কম খরচে করছেন। তাই এখন আর গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী সেই ঢেঁকি নেই। আগের মতো গ্রামবাংলার বউদের আর কষ্ট করে ধান বানতে হয় না, চিড়া- পিঠা তৈরি করা লাগছে না, কি আরাম! তবে এখনো গ্রামের দু’একটি কৃষকদের বাড়িতে হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি দেখা যায়। কিছু দিন পরে আর দেখা যাবে কীনা তা বলা মুশিকল। হয়তো কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে গ্রাম-বাংলার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ঢেঁকি। এমন এক সময় আসবে যখন আগামী প্রজন্মের কাছে এই ঢেঁকি শুধুই কাল্পনিক জগতের এক কল্পকাহিনীর গল্প মনে হবে। শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে হয়তাে এখনই তা।ঢেঁকিতে বানা ধানের চাউলের ভাত, খিচুড়ী, খিড়- পায়েশ ও চিড়া কি যে স্বাদ-উপকারী, তাও এইযুগের ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প! তারা তো ভাতের রঙ একটু লালচে দেখলে না সিটকায়, পিঠা-চিড়া তো তাদের কাছে সেকেলের খাবার! তাই তো গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে যেমনটি নেই ঐতিহ্যবাহী সেই ঢেঁকি, তেমনি নেই গ্রামবাংলার গৃহবধূদের মাঝে সেই আনন্দও। নেই সেই সুঠাম-সুস্থ দেহের কৃষক-বধূ। যারা শত বছর বয়সেও পরম আনন্দে জীবন কাটাতো। ১০-১২ সন্তানের জন্ম দিয়েও গৃহবধূরা থাকত সুস্থ-সবল চাকচিক্য। আজ এ সবই অতীত। এখন শহরের আধুনিকতার ছুঁয়ায় সাদা চাল খেয়ে শহরের মতো গ্রামবাংলার কৃষাণ-বধূরাও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কুড়িতে বুড়া-বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন। তাই আজ সেই ছোটকালের কথা বারবার মনে পড়ছে আমাদের বাড়ির সেই ‘ঢেঁকি’ ডাক্তারের কথা। ওহ্’ ফিরে আসি, আমাদের বড়বাপের লাগানো গাছ দিয়ে দাদার তৈরি সেই ঢেঁকির কথায়। ওই ঢেঁকির ছাটাই চাল, পিঠা-চিড়া খেয়েই আমরা নয় ভাইবোন বড় হয়েছি। যতদূর মনে পড়ে তাতে, সর্দি-জ্বর ছাড়া আমাদের কোনো দিন আধুনিক চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়নি। ফলে ওই ঢেঁকির প্রতি আমাদের সবারই এক ধরনের অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল। ঢেঁকিটি দীর্ঘসময় আমাদের রান্নাঘরেই ছিল। কিন্তু নব্বয়ের দশকের গোড়ার দিকে আমাদের পরিবার যখন শহরে চলে আসে তখন এক প্রতিবেশির আবদারে বাবা ১৫০টাকায় ঢেঁকিটি বিক্রি করে দেন। এতে মা অনেক মন খারাপ করেছিলেন। তবে এবার ঈদে বাড়ি গিয়ে আমাদের রান্নাঘরে সেই পুরানো ঢেঁকি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই ৬৫ বছর বয়সী আমার বৃদ্ধা মা বললেন- এটি এক হাজার টাকা দিয়ে ফেরত এনেছি। এটি আমার শ্বশুরের রেখে যাওয়া স্মৃতি, এটি দিয়েই তোদের বড় করেছি। ফলে এটি অন্যের ঘরে দেখলে আমার মন কাঁদে, তাই ফেরত এনেছি। কথাগুলো শুনে আমি কিছু বলার সাহস পায়নি, শুধু মনে মনে চিন্তা করলাম- এই ঢেঁকির প্রতি আগেকার গ্রামবাংলার গৃহবধূদের কত অকৃত্রিম ভালাবাসা ছিল, এ যেন ঢেঁকির প্রতি সন্তানের ভালবাসা! তাই সবশেষে বলবো, একদিন ঘুম ভাঙ্গত যে ঢেঁকির ধুমধাম শব্দে তা আজ আর শোনা যায় না। গ্রামবাংলার মহিলারা এক সময় ঢেঁকি পারের তালে তালে গান গাইতো। ঢেঁকির তালে তালে গান-গীতের সুর তুলতো। বিয়ের কনেকে গাঁয়ে গলুদ মাখাতে পাড়ার মহিলারা একত্রে হয়ে বিয়ের গীত গাইতো। আর তা শূনে মনের দুঃখ কষ্ট দুর করতো বাড়ীর বা বাড়ীর পাশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ। ঢেঁকি পারের শব্দে মনের ক্লান্তি দুর করে আবার কাজে মন দিত কৃষক। গ্রামের মহিলারা একসময় কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে বাড়ীর উঠানে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে যখন সারাদেশে মাতোয়ারা ঠিক তখন গ্রামের মহিলারা নতুন ধানে পিঠা তৈরীতে মনোনিবেশ করতো। ঢেঁবি ছাটা চাউলের ভাত-পিঠা গ্রামের কৃষকের প্রাণের চাওয়া ছিল। ঢেঁকিতে করা চাউলের গুড়া দিয়ে তৈরী হয়েছে মন মাতানো সব পিঠা। ভাপাপুলি, মেরা, রুটি, পাটিসাপটা, বিবিখানা, নূনমরিচ, তেলের পিঠা, ছই, চিতাই, পাটিসাপটা পিঠাসহ নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার। সেই দিনের সেই সময়গুলো আজ শুধুই স্বপ্ন। আজ আমাদের গ্রাম থেকে সেই ঢেঁকি উঠে গেছে। এখন বলা চলে ঢেঁকি শিল্পটি প্রায়ই বিলুপ্তির পথ ধরেছে। যার কারনে গ্রাম বাংলার মহিলারা হারিয়েছে তাদের প্রাণচাঞ্চল্যতা। গ্রামের মানুষের সেই প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে, ভাল থাকতে হলে গ্রামের কৃষক-বধূদেরকে আবার আগের দিনে ফিরে যেতে হবে। আর সেই ঢেঁকিই আধূনিকতার ছুঁয়াকে হার মানাবে। লেখক: গবেষক ও কলামলেখক । ই-মেইল:sarderanis@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর