হাওরে মানুষ হাহাকার, কাজের খোঁজে শহরমুখী

কিশোরগঞ্জের হাওরের মিঠামইন উপজেলার গোপদিঘী গ্রামের প্রান্তিক কৃষক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া (৫৫)। স্ত্রী শিউলী আক্তার, তিন মেয়ে মিশু, তৃষ্ণা ও নিশা এবং এক ছেলে রাজনকে নিয়ে তার সংসার। গত বোরো মওসুমে নিজের আড়াই একর জমি চাষাবাদ করেছিলেন তিনি। হাতে টাকা না থাকায় চাষাবাদের খরচ মেটাতে ঋণের জন্য দ্বারস্থ হন এক মহাজনের কাছে। বৈশাখে জমির ধান কাটার পর যে পরিমাণ ধান তিনি পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই চলে যায় ধান কাটার খরচ ও মহাজনের ঋণ পরিশোধে। অগত্যা ঘরে তালা ঝুলিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কাজের খোঁজে পাড়ি জমান গাজীপুরের গার্মেন্টপল্লীতে। অথচ এক সময়ের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার গোলায় ওঠতো কয়েক হাজার মণ ধান। হাওরে প্রায় প্রতি বছরের আগাম বন্যায় তছনছ তার সেইসব সুখের দিন। কৃষক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ গোপদিঘীর কৃষক সন্দেশ বীরের। অবস্থাসম্পন্ন এই কৃষক পরিবারটি বছরে দু’বার জাঁকজমকের সঙ্গে বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন করতো। কিন্তু আগাম বন্যায় বার বার ফসলের মার খেয়ে সন্দেশ বীর পরিণত হয়েছেন প্রান্তিক কৃষকে। গত বোরো মওসুমে সাড়ে তিন একর জমি আবাদ করে ১৫০ মণের মতো ধান পেলেও ধানের দাম কম হওয়ায় উৎপাদন খরচই তুলতে পারেন নি। লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরে তালা মেরে স্ত্রী মিনতি বর্মণ, দুই ছেলে বিজয় ও দুর্জয় এবং একমাত্র কন্যা রিক্তাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন সন্দেশ বীর। ভাগ্যান্বেষণে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন রাজধানীর মীরপুরে। পার্শ্ববর্তী গোপদিঘী সাধুহাটি গ্রামের বয়োবৃদ্ধ কৃষক জজ মিয়া (৬৫)ও একই অবস্থা। একমাত্র ছেলে মাজহারুল এবং তিন মেয়ে রিতু, ববিতা ও শিলার মধ্যে বড় মেয়ে শিলাকে ধার-দেনা করে কোন রকমে পাত্রস্থ করেছেন। গত বোরো মওসুমে তিনি দেড় একরের মতো জমি চাষ করে লোকসান গুনেছেন। জীবিকার তাগিদে স্ত্রী পিয়ারা বেগম, দুই মেয়ে ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তিনিও ঘরে তালা ঝুলিয়ে ছেড়েছেন নিজ গ্রাম। কাজের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছেন গাজীপুরের গার্মেন্টসপল্লীতে। জজ মিয়ার মতোই অবস্থা প্রতিবেশী মোক্তার হোসেন (৫৫)-এর। মুক্তার হোসেনের নিজের কোন জমিজমা নেই। স্ত্রী মাজেদা আক্তার, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বোরো মওসুমে অন্যের ২/৩ একর জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন তিনি। মহাজনী বা এনজিও ঋণ নিয়ে চাষাবাদের খরচ মেটাতে হয় তাকে। বৈশাখে যে পরিমাণ ধান পান, ঋণ পরিশোধ করাই তাতে দুষ্কর হয়ে ওঠে। এছাড়া, বর্ষা মওসুম শুরু হলে অর্থাৎ আষাঢ় মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত কোন কাজ মিলে না হাওরে। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই সপরিবারে ঘর ছাড়তে হয়েছে তাকে। ঘরে তালা ঝুলিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনিও পাড়ি জমিয়েছেন গাজীপুরের গার্মেন্টসপল্লীতে। সরজমিন গোপদিঘী গ্রামের বিভিন্ন পাড়া ঘুরে এ ধরনের অন্তত ৪০টি পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যারা কাজের সন্ধানে ঘরে তালা লাগিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল গোপদিঘী গ্রামই নয় হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি গ্রামের অবস্থা একই রকম। হাওরের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কিন্তু সারা বছর কৃষি কাজ থাকে না। একমাত্র বোরো ফসল ছাড়া হাওরে আর কোন ফসল হয় না। বছরের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বোরো চাষাবাদ শুরু হয়। সে ফসল ঘরে ওঠে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। এরপর বেকার হয়ে পড়েন লাখো কৃষক ও কৃষি শ্রমিক। আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত বর্ষার ছয় মাস সেখানে কোন কাজ থাকে না। কর্মহীন এই সময়টাতে হাওরের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তীব্র আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। কৃষিনির্ভর হাওর এলাকায় কৃষিভিত্তিক কোন শিল্প-কারখানাও গড়ে ওঠেনি। হাওরের কৃষি নির্ভর ৮০/৮৫ ভাগ মানুষের বাইরে বাকি ১৫/২০ ভাগের পেশা ব্যবসা, চাকরি ও মাছ ধরা। কিন্তু প্রভাবশালী মহল ও অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাপটে প্রকৃত জেলেরা হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে পারে না। ফলে জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে তাদের নিজ বাড়ি ছাড়তে হয়। হাওরের কৃষি শ্রমিক, জেলে সমপ্রদায় ও নিম্ন আয়ের দেড় থেকে দু’লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বর্তমানে শ্রম বিক্রি করছেন। ধান কাটা মওসুমে তাদের অধিকাংশ আবার ফিরে আসেন নিজ নিজ এলাকায়।
স্থানীয়রা জানান, হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা মূলত একফসলি এলাকা। এখানকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। এখানকার উৎপাদিত ধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে হাওরপাড়ের কৃষককে পরবর্তী বোরো ধান না ওঠা পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকেরা মূলত ধার-দেনা ও মহাজনের কাছ থেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়ে জমি চাষ করে থাকেন। ধান তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তাদেরকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ বছর ধানের দাম কম হওয়ায় কেবল ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকই নন, এ এলাকার বড় ও সামর্থ্যবান কৃষকও বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকে উৎপাদিত ধান দিয়ে ঋণই পরিশোধ করতে পারেন নি। তাদের অনেকেই এখন মহাজনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রকট দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও জীবনধারণের জন্য তাদের কোন কাজ মিলছে না। অকাল বন্যা, ভাঙন, মওসুমি বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত তাদের জীবন। জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে হাওরের মানুষ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। কাজের খোঁজে ঢাকা শহরের নূরের চালা, কচুক্ষেত, ধামালকোট, ইব্রাহীমপুর, কাফরুল, মীরপুর, গাজীপুরের সালনা, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, পাগলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আশুগঞ্জ, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানাপ্রান্তে তারা পাড়ি জমিয়েছেন। মিঠামইনের ঘাগড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ কৃষক মোনাফ মিয়া জানান, তার ছেলে আমিরুল ইসলাম হাঁটুরিয়া নদীর হাওরে তিন একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলো। হাঁটুরিয়া নদী শুকিয়ে সেচ সংকটের কারণে পুরো জমিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন রকমে দুই একরের মতো জমি কেটে আনলেও তাতে ২০ মণের মতো সে ধান পায়। অথচ জমি চাষাবাদ করতে মহাজনের নিকট থেকে সে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলো। এখন মহাজনের ঋণের ভয়ে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অগত্যা স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমিরুল কাজের খোঁজে চট্টগ্রামের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়।
হাওরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এমন বেদনার্ত ছবিই দেখা গেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা আর প্রকট দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে চলছে হাওরপাড়ের মানুষের জীবন। মওসুমি বেকারত্ব কেড়ে নিয়েছে হাওরবাসীর মুখের হাসি। দু’মুঠো ভাত আর একটু আশ্রয়ের খোঁজে তারা ছাড়ছেন প্রিয় গৃহকোণ। চরম দুঃসময় ভাবিয়ে তুলছে এক সময়ের এই সমৃদ্ধ জনপদের বাসিন্দাদের। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বদলে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের জীবনধারা। লোকসানে পঙ্গু কৃষকের জীবিকার পাশাপাশি আগামী বোরো আবাদও বাধাগ্রস্ত হবে, এমন উৎকণ্ঠার বেদনার্ত উচ্চারণই এখন হাওরের কৃষকের কণ্ঠে।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ২০ বছরে হাওরের নিজগ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা হয়েছেন প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ। মিঠামইন উপজেলার ঢাকী গ্রামের বাসিন্দা হিরু মিয়া প্রায় ২০ বছর আগে স্ত্রী-সন্তানসহ নিজ গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঢাকার নূরের চালায়। জীবন-জীবিকার তাগিদে আরও বেশ কয়েকটি জায়গা বদলিয়ে তিনি এখন গাজীপুরের সালনায় বসবাস করছেন। দু’বছর-তিনবছরে গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের দেখতে আসলেও একেবারে গ্রামে ফিরতে সাহস পান না। একই অবস্থা সিলেটের ভোলাগঞ্জে থাকা ইটনার আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হাশিমসহ একটু সচ্ছলতার মুখ দেখা মানুষগুলোর। কিন্তু যারা সেভাবে অন্যত্র থিতু হতে পারেন না, তারা কৃষি জমিতে শ্রম দেয়ার সময় গ্রামে ফিরেন। কাজ শেষে আবার বেরিয়ে পড়েন অন্যত্র কাজের খোঁজে। এভাবেই চলছে হাওরের অধিকাংশ মানুষের যাযাবর জীবন। দীর্ঘদিন যাবৎ হাওরের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন কৃষি প্রকৌশলী ড. নিয়াজ পাশা। বর্ষার কর্মহীনতা ও হাওরের কর্মসংস্থান বিষয়ে তিনি বলেন, হাওরে পরিকল্পিতভাবে সমন্বিত গ্রাম সৃজিত করে এতে সারা বছর মাছ চাষ উপযোগী পুকুর, পুকুরের পাড়ে ফলদ বৃক্ষরোপণ, হাঁস-মুরগি, গরু-মহিষের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশাল কর্মযজ্ঞের সৃষ্টি করা সম্ভব। বর্ষার ভাসমান পানিতে সহজে মাছ চাষ পদ্ধতি আবিষ্কার ও বিকল্প কৃষি ব্যবস্থার উদ্ভাবন যেমন মাচায় শসা চাষ, ভাসমান সবজি চাষ ইত্যাদি করতে হবে। এতে করে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়া, হাওরের কৃষকদের ধানচাষের পাশাপাশি বিকল্প শস্য উৎপাদনে আগ্রহী ও অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। হাওরে সস্তা শ্রম ও শিল্পবান্ধব অনুকূল পরিবেশ রয়েছে উল্লেখ করে ড. নিয়াজ পাশা বলেন, হাওরে ইপিজেড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান হতে পারে। এর মাধ্যমে হাওরের লোকজন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলেই মনে করেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের মতে, হাওর এলাকার সম্পদ এবং সম্ভাবনাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে পারলে এটি দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনাময় অঞ্চলে পরিণত হবে। এছাড়া, হাওরে কর্মসংস্থানের যে পর্যাপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে কাজে লাগাতে পারলে তাদের মওসুমি বেকারত্ব থেকে মুক্তি মিলবে। এসবের মাধ্যমে হাওরবাসীরও তাদের বর্তমান দুঃসহ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর