চামড়ায় চরম বিপর্যয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে গত বারের চেয়েও এবার কম দামে চামড়া কেনার ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্যানারি মালিকরা। ফলে পাড়া-মহল্লা থেকে কম দামে চামড়া সংগ্রহ করেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আড়তে এসে সে অনুযায়ীও দাম পাননি তারা। শেষ পর্যন্ত পানির দরে চামড়া বিক্রি করে মাথায় হাত পড়েছে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর। অন্যদিকে নির্ধারিত দাম না পেয়ে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে কয়েক হাজার গরু ও ছাগলের চামড়া। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেও ১৫ হাজার পিস চামড়া ডাম্পিং করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এবারো চরম নৈরাজ্যের মুখে পড়েছে কুরবানিকেন্দ্রিক চামড়া বাণিজ্য।

এ নৈরাজ্যের প্রধান ৪টি কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে চামড়া থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া, করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হ্রাস, ট্যানারি মালিকদের অর্থ সংকটের অজুহাত এবং সমন্বয়হীনতা। এছাড়া কুরবানির মাত্র ২ দিন আগে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণা দেয়ায় আগ্রহী অনেকেই চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিতে পারেননি। ফলে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের বাইরে কারো কাছে চামড়া বেচার সুযোগ ছিল না। এতে করে কুরবানির চামড়ার দাম আরো কমে যায়।

জানা গেছে, গত বছরের বিরূপ অভিজ্ঞতায় এবার করোনা মহামারির মধ্যে চাহিদা কম থাকবে এমন আশঙ্কা ছিল মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। আর এ কারণে কুরবানির দিন পাড়া-মহল্লায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দেখা যায়নি। মাদ্রাসা ও মসজিদের ছাত্ররা কিছু চামড়া নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করেছে। এছাড়া অনেকে মসজিদ বা মাদ্রাসায় গিয়ে চামড়া দিয়ে এসেছে। তবে মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী পানির দামে ২০০-৩০০ টাকায় এসব চামড়া কিনে নিয়েছে।

প্রতি বছরের মতো সরকার এবারো কুরবানির পশুর চামড়ার নির্ধারিত দাম বেঁধে দিলেও বাস্তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর চেয়ে অনেক কম দামেই বিকিকিনি হয়েছে। শনিবার ঈদের দিন ও রবিবার ঈদের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়ও, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এক বছর আগেও এসব চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় হাতবদল হয়েছে। এবার যত বড় চামড়াই হোক কেন কুরবানিদাতা কিংবা সংগ্রহকারী ৬০০ টাকার বেশি দাম পাননি। এ বছর সরকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকায় নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ আড়তদাররা মাঝারি মানের (২২ ফুট আয়তন) একটি চামড়া ট্যানারিতে বিক্রি করবেন ৭৮০-৯০০ টাকায়। গত বছর এসব চামড়া বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকায়। এ বছর একই মানের চামড়াই কুরবানিদাতাদের কাছ থেকে

কেনা হয়েছে গড়ে ৩০০-৪০০ টাকা দরে। দরপতনের সুযোগে দালাল, ফড়িয়া, বেপারি, আড়তদার এমনকি এই খাতের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ট্যানারিগুলোর মুনাফা বাড়ার পথ উন্মুক্ত হলেও কেউ দায় নিতে রাজি নয়। দেশে চামড়ার চাহিদার বেশিরভাগ অংশই পূরণ হয় কুরবানির ঈদে জবাই হওয়া পশু থেকে। এবার ৭০ লাখ গরু জবাই হবে বলে ধারণা করা হলেও ৫০ লাখের বেশি হয়নি বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। ছাগল ২০ লাখ জবাই হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, কুরবানির চামড়া ৩ হাত হয়ে ট্যানারিতে পৌঁছে। কুরবানিদাতার কাছ থেকে তা কিনে নেন মৌসুমি ব্যবসায়ী, যাদের ফড়িয়া বলা হয়। তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কেনেন আড়তদাররা। সেই চামড়া লবণ মাখিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর বিক্রি করা হয় ট্যানারিতে, যেখানে তৈরি হয় চামড়াজাত নানা পণ্য। গত বছর ফড়িয়ারা যে দরে চামড়া কিনেছিলেন, বিক্রি করতে গিয়ে লাভ তো দূরের কথা কেনা দামও পাননি। তখন অনেকে চামড়া রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলেন কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলেন। এবার করোনা ভাইরাস মহামারিতে চামড়ার সরকারি দরও কমে যাওয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনায় বিনিয়োগে উৎসাহ হারান। ফলে অনেক স্থানে কুরবানির চামড়ার ক্রেতাই পাওয়া যাচ্ছিল না।

আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আপ্তাব আলী জানান, প্রতিটি চামড়ার মধ্যে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা চালান দিতে হয়। সেই হিসাব ধরে মাঝারি মানের চামড়াগুলো ৬০০ টাকা করে কেনা হয়েছে। এর থেকে বেশি দিয়ে কিনতে গেলে সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী আড়তের লভ্যাংশ থাকে না। এখন কেউ যদি মাঠ পর্যায়ে ৩০০-৪০০ টাকায় চামড়া কেনে, সেটা ভিন্ন হিসাব। দেখা গেছে ৩০০ টাকায় কিনে অনেকে আড়তে ৬০০ টাকা করে বিক্রি করছেন, অর্থাৎ অতি মুনাফা করছেন।

আড়তদারদের পাশাপাশি কিছু ট্যানারিও প্রতিনিধি পাঠিয়ে সরাসরি চামড়া কিনেছেন। রবিবার বেলা ৩টার দিকে মিরপুর রোডের ধানমন্ডি এলাকায় দেখা যায়, সাভার-আমিনবাজারের বিভিন্ন ট্যানারির প্রতিনিধিরা ৪০০-৫০০ টাকায় ২০ থেকে ৩০ বর্গফুট আয়তনের চামড়া কিনে নিচ্ছেন। নিজেকে ঢাকা ট্যানারির প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে শামসুল আলম নামের একজন ক্রেতা বলেন, রবিবার সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা করে তারা চামড়া কিনেছেন। শনিবার গড়ে ৫০০ টাকা করে চামড়া কেনা হয়েছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে চামড়া কেনাবেচা তদারিক করেন। ওই প্রতিনিধিদলের সদস্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নারায়ণ সরকার বলেন, সাভারে নির্ধারিত দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। ট্যানারিগুলো ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, ট্যানারির বাইরে চামড়ার দাম কম হওয়ার বিষয়টি তারা অবগত নন। তবে ট্যানারি ও আড়তে নির্ধারিত দামে চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে।

অন্যদিকে চামড়া কিনতে ট্যানারি মালিকদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। এ খাতের বিতরণকৃত ঋণের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি। আর এ কারণে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অনীহা রয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, চামড়া কিনতে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করে জনতা ব্যাংক। তবে এবার ব্যাংকটি চামড়া কিনতে কোনো ঋণ দেয়নি। আমরা আশা করছি, অফিস খোলার দু-একদিনের মধ্যে ব্যাংকটি টাকা দেবে। যেসব ট্যানারি ঋণ পাবে না, তারা চামড়া কিনতে পারবে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর