দেশে শিল্পায়নে সুদহার এক অঙ্কের বিকল্প নেই সাক্ষাৎকারে সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান বলেছেন, ব্যাংক ঋণে সুদের হার ৯ এবং আমানতে ৬ শতাংশ (সিঙ্গেল ডিজিট) একযোগে সব ব্যাংক কার্যকর করলে দেশে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। যদিও সরকারের প্রথম সারির চারটি ব্যাংক সে কাজটি ইতিমধ্যে সেরে ফেলেছে। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে এলে সিঙ্গেল ডিজিটের ঘোষণা পূর্ণতা পাবে। এতে নতুন নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সৃষ্টি হবে অনেক নতুন উদ্যোক্তা। ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে চাকরির বাজারও প্রশস্ত হবে। এতে কমে আসবে শিক্ষিত বেকারের হার। তাই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এবং শিল্পায়নে বিনিয়োগের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে বিশেষ নজর দেয়া উচিত। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের নাজুক পরিস্থিতি আর্থিক খাতে খারাপ বার্তা দিচ্ছে।

সম্প্রতি যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সোনালী ব্যাংকের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেন তিনি।

আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় বড় অনিয়ম মানুষকে হতাশ করছে। এছাড়া হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক এবং বর্তমানে জনতা ব্যাংকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে মানুষ আশা দেখে আবার হতাশ হচ্ছেন। বিশেষ করে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মানুষের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এটা খুব খারাপ খবর। সে কারণে বারবার আস্থা হারিয়ে ফেলছেন সাধারণ মানুষ। এ থেকে উত্তরণে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সর্বত্র সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই।

সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বেশকিছু কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। এর মধ্যে জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা উপলক্ষে সোনালী ব্যাংকের প্রধান ফটকে বড় মাপের একটি ঘড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রধান কার্যালয়ের মূল দরজায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হবে। ব্যাংকের খামসহ সব ধরনের কাগজপত্রে ‘মুজিববর্ষ ২০২০’ লাগানো থাকবে। সারা দেশ থেকে স্বীকৃত কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদেরকে সোনার মেডেল থেকে শুরু করে আর্থিক অনুদান দেয়া হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার নির্মাণে অর্থায়ন করা হবে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি গাড়ি হস্তান্তর করেছি। সোনালী ব্যাংকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মরত এবং অনেকে অবসর নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাদের সবাইকে সম্মাননা প্রদান করব- যার মূল্যমান কোনোভাবেই ২৫ হাজার টাকার নিচে নয়। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্কুল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবনী সম্পর্কে কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হবে এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হবে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন চলতি বছরের ১৭ মার্চ সোনালী ব্যাংকে কোরআনখানির আয়োজন করা হবে। সোনালী ব্যাংকের কোটপিনে ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনি উম্মোচিত ছবি থাকবে। মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে চলতি বছরে ব্যাংকের সব সেবা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছি। এছাড়া সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত এলে সেদিকেও গুরুত্বসহকারে নজর দেয়া হবে।

তিনি বলেন, গুণগত সেবা দিয়ে চলতি বছর ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ স্থানে যেতে চায় সোনালী ব্যাংক। খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক অঙ্কে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে এ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় বাড়ানোরও বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছি।

আতাউর রহমান প্রধান বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার সময় সোনালী ব্যাংকের মোট লাভের পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র চার মাসেই ব্যাংকের লাভের অঙ্ক ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। শুধু মুনাফা অর্জনের চিন্তা থেকে নয়, সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালন করেই এ পর্যায়ে পৌঁছেছি। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংকের ৩৭টি সেবায় সরকার থেকে কোনো ধরনের ফি বা কমিশন গ্রহণ করা হয় না। যেখানে ব্যাংকের ৩৩ শতাংশ জনবল কাজ করে। সোনালী ব্যাংক সরকারের সবগুলো কাজই বাস্তবায়ন করে। তাই ব্যাংকটিকে ডিসিপ্লিনের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দরকার। মুজিববর্ষে ব্যাংকে নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করা হবে।

ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক নিচে নামিয়ে এনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সোনালীর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিতরণকৃত ঋণের ১৯ শতাংশ- যা কিছু দিন আগেও ছিল ২৯ শতাংশের কাছাকাছি। এক বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মতো খেলাপি ঋণ কমে এসেছে। চলতি বছর ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এক অঙ্কে না নামলেও ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছি। এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ থেকে এখন পর্যন্ত বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করতে পেরেছি। প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার করা হবে। লোকসানি শাখা ৯৩ থেকে ২৭টিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মুজিববর্ষে লোকসানি শাখার সংখ্যা ১০টার নিচে নামিয়ে আনতে চাই। এ বছর আরও ১৫টি নতুন শাখা উদ্বোধন করব। শাখার পাশাপাশি উপশাখা খোলার ওপর জোর দেয়া হবে। নতুন শাখাগুলো প্রথমেই লাভে আসতে পারে না। ইতিমধ্যেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স পেয়েছে সোনালী ব্যাংক। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবার পরিধি আরও বাড়াতে চাই। এজন্য ইতিমধ্যেই একজন প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে আরও বেশি সচেতনতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে জানিয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ঋণের অঙ্ক ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এ বছর ব্যাংকের অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও বা এডিআর দাঁড়াবে ৬০-৬২ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। সোনালী ব্যাংকে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে ২০২০ সালে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সবগুলো দেশের সঙ্গে কাজ করছে সোনালী ব্যাংক।

আতাউর রহমান বলেন, সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৫টি শাখা অটোমেশনের আওতায় এসেছে। মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিভাবে টাকা আনা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। এটা কার্যকর হলে রেমিটেন্স আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পাবে। এ বছর যেসব প্রবাসী সর্বোচ্চ রেমিটেন্স পাঠাবেন তাদের পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নিয়েছি।

তিনি বলেন, আগে সোনালী ব্যাংকের শাখায় শাখায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির অনুমতি ছিল না। কিন্তু এ বছর নতুন উদ্যোগ হিসেবে ব্যাংকের সব শাখায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হবে এবং জানুয়ারির মধ্যেই ট্রাভেল ট্যাক্স অনলাইনের মাধ্যমে প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হবে। মোট কোথা মুজিববর্ষে সোনালী ব্যাংক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর