রাজধানী ঢাকা থেকে ১১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কিশোরগঞ্জ জেলার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের নাম রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ। গত ১৩ অক্টোবর দুপুর দেড়টায় করিমগঞ্জ থানার জাফরাবাদে অবস্থিত এ মেডিকেল কলেজটি পরিদর্শনে যান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)`র সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
সূত্রে জানা যায়, মেডিকেল কলেজটি পরিদর্শনকালে পরিদর্শক দলের সদস্যরা একজন রোগীরও দেখা পাননি। তবে তারা একটি কক্ষে ৭টি স্টিলের বেডে চাদর বিছিয়ে রাখা দেখতে পান। এছাড়া একটি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ, ল্যাবরেটরিসহ যে আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা মেডিকেলে খুঁজে পাননি পরিদর্শকরা।
তারা আরো জানান, অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষাদানের জন্য নিজস্ব হাসপাতাল থাকা অত্যাবশ্যক। অথচ ওই মেডিকেল কলেজে দুই বছর আগে থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করে একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হলেও এখন পর্যন্ত হাসপাতাল স্থাপিত হয়নি। একাডেমিক ভবনে নামকাওয়াস্তে রোগীর সেবা চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমডিসির একাধিক কর্মকর্তা চরম হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, রাষ্ট্রপতির নামে স্থাপিত মেডিকেল কলেজটির এমন হাল দেখতে হবে তা তারা কল্পনাও করেননি। আগামী ২৯ অক্টোবর বিএমডিসির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পরিদর্শন প্রতিবেদন পেশ করা হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তারা। বিএমডিসির অনুমোদন পাওয়ার জন্য আবেদন সাপেক্ষে ওই মেডিকেল কলেজ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তারা।
বিএমডিসি সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন নীতিমালা অনুসারে- যে কোনো মেডিকেল কলেজ স্থাপনের কমপক্ষে দুই বছর আগে থেকে বাধ্যতামূলকভাবে হাসপাতাল চালু থাকতে হবে। কলেজে প্রতি আসনের বিপরীতে ৫ জন রোগী থাকতে হবে অর্থাৎ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জন হলে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর উপস্থিতি নিশ্চিত থাকতে হবে।
যে কোনো মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির নামে স্থাপিত এ মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হয়নি!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই বছর আগে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদনপ্রাপ্ত এ মেডিকেল কলেজে ৫০ আসনে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন দেয়া হয়। প্রথম ব্যাচে ৩২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ৫০ আসনের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় হাসপাতাল, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ ও ল্যাবরেটরি সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও পরের বছরই আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৬০ শয্যা করা হয়। দ্বিতীয় বছর মোট ৪৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
তবে মেডিকেল কলেজটির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন এটি একটি আদর্শ মেডিকেল কলেজ! সেখানে বলা আছে -৭ একর জমির ওপর স্থাপিত এ মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্য ‘উই এইম টু ট্রিট নট অনলি বডি বাট অলসো সোল’। স্থানীয় ফ্যাকাল্টির সংখ্যা ২০। কলেজে ১ জন অধ্যক্ষ, ১ জন উপাধ্যক্ষ, এনাটমি বিভাগে ৭ জন, ফিজিওলজি বিভাগে ৫ জন, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ৫ জন, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে ২ জন ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ২ জন এবং পার্ট টাইম হিসাবে ৫ জন ফ্যাকাল্টি মেম্বার রয়েছে। সর্বমোট জনবল রয়েছে ৫৫ জন।
ওয়েবসাইটে একাডেমিক ভবন ৩৫ হাজার বর্গফুট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুটের ২টি লেকচার গ্যালারি, ৪ হাজার বর্গফুটের শবচ্ছেদ (ডিসেকশন) হল, ১২শ’ বর্গফুটের ফিজিওলজি ল্যাবরেটরি, ১৫শ’ বর্গফুটের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি, ২ হাজার বর্গফুটের এনাটমি যাদুঘর ও ৭ হাজার বর্গফুটের লাইব্রেরি রয়েছে। প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় শতকরা ৯৩ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
একাধিক চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, সব শুনে মনে হচ্ছে- ‘কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’। তারা বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের বেশিরভাগেরই একই দশা। নীতিমালা অনুসরণ না করেই বিগত দুই-তিন বছরে প্রায় দুই ডজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন পেয়েছে বলে জানান তারা।
পরিদর্শনের বিষয়ে জানতে বিএমডিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ নিজেদের নাম পরিচয় প্রকাশ কিংবা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সার্বিক অভিযোগ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এ এন এম নওশাদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ৭ বেডের হাসপাতালের তথ্য সম্পূর্ণ কাল্পনিক, মিথ্যা ও বানোয়াট। তিনি জানান, একাডেমিক ভবনেই তাদের ১৫০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। একাডেমিক ভবন ছাড়াও শহরে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল রয়েছে।
কিন্তু পরিদর্শক দলের সদস্যরা ক্যাম্পাসের বাইরের হাসপাতালকে হিসাবে নিতে চাননি- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিদর্শক দলের সদস্যরা মেডিকেল কলেজ পরিদর্শনের সময় বেশ কিছু রোগী দেখেছেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নতুন মেডিকেল কলেজ তাই হাসপাতালে রোগী কম।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সদ্য পিআরএলে যাওয়া পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষাও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল হান্নানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যতদূর মনে পড়ে ক্যাম্পাসেই তাদের বিশাল হাসপাতাল রয়েছে। তিনি বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে বলেন, কলেজটি স্যারের এলাকার। তিনি একাধিকবার সেখানে গিয়েছেন, তিনি ভালো বলতে পারবেন।