হাওর বার্তা ডেস্কঃ অনেক দিন ধরেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বলে আসছিলেন, এবার জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনেই লড়বে এবং কাউকে ক্ষমতায় আনতে নয়, বরং নিজেরা ক্ষমতায় আসতেই নির্বাচন করবেন। কিন্তু রাজনীতির টুকটাক খোঁজখবর যারা রাখেন, তারাও জানেন, এরশাদের এই হুঙ্কার আসলে ফাঁকা আওয়াজ। বিএনপি নির্বাচনে না আসলে হয়তো গৃহপালিত বিরোধী দল হওয়ার জন্য ৩০০ আসনে আপসের প্রতিদ্বীতা করার সুযোগ পেতো জাপা। কিন্তু নির্বাচনে চলে আসায় এরশাদের সে খায়েশ পূরণের সুযোগ নেই। এখন আওয়ামী লীগ দয়া করে যে কটি আসন দেবে, মহাজোটের হয়ে তাতেই লড়তে হবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের। প্রথমে এরশাদ চেয়েছিলেন ১০০ আসন, সেটা কমতে কমতে ৮০, ৭০ থেকে ৬০-এ নেমেছিল।
কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ৪০টির বেশি আসন দেবে বলে মনে হয় না। অথচ অন্য সব দলের মতো ৩০০ আসনেই মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। মনোনয়নপ্রত্যাশী ২ হাজার ৮৬৫ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি ২০০ আসনে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়। গত সোম ও মঙ্গলবার দলের বনানীর কার্যালয় থেকে চেয়ারম্যান তাদের হাতে মনোনয়নের চিঠি তুলে দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রার্থীরা গিয়ে এরশাদকে পাননি। মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম দিন একঝলক এলেও দ্বিতীয় দিনে তাকে পাওয়াও কষ্টকর ছিল।
সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরশাদের বারিধারার বাসা আর বনানীর অফিসে ঘুরে ঘুরে তাকে না পেয়ে ক্লান্ত। এর মধ্যেই জানা গেল, এরশাদ অসুস্থ। সিএমএইচে ভর্তি। এরশাদের যা বয়স, অসুস্থ তিনি হতেই পারেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে তার সিএমএইচে ভর্তি হওয়াটা সন্দেহ সৃষ্টি করে। কারণ গত নির্বাচনের আগেও অনিচ্ছুক এরশাদকে সিএমএইচে আটকে রেখে নির্বাচন করিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, এরশাদের এবারের অসুস্থতা গতবারের মতো নয়। এখানেই মজা এরশাদের অসুস্থতার বিষয়ে ডেইলি আপডেট দেন ওবায়দুল কাদের।
বনানী কার্যালয়ের সামনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ক্ষোভের উত্তাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে, এরশাদ এবার পালিয়েছেন। মনোনয়ন চ‚ড়ান্ত হওয়ার আগে মনে হয় তাকে আর জনসমক্ষে দেখা যাবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়া মানেই এমপি হয়ে যাওয়া ছিল। এবারও সেই স্বপ্নে বিভোর জাতীয় পার্টির নেতারা মনোনয়ন পেতে মরিয়া ছিলেন। কিন্তু এরশাদ যে তাদের স্বপ্ন চুরি করে এভাবে পালিয়ে যাবেন, সেটা বুঝতে তাদের একটু দেরি হয়ে যায়। যখন বুঝেছেন, ততক্ষণে পাখি উড়াল দিয়েছে। কাউকে না পেয়ে তারা অফিসের সামনে গণমাধ্যমের সামনে উগড়ে দিচ্ছেন ক্ষোভের অনল। তারা সরাসরিই এরশাদ আর রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন।
একজন তো বলেই ফেললেন, ‘এরশাদের কত টাকা লাগবে?’ আরেক নেতা অভিশাপ দিলেন, ‘জাতীয় পার্টি ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে।’ হিসাবটা সহজ। মহাজোটের মনোনয়ন পাবেন বড়জোর ৪০ জন। বাকি ১৬০ জনের কী হবে? তারা কিসের বিনিময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জানি না। কিন্তু সেই বিনিময়টা তো এখন তারা ফেরত চাইতেই পারেন।
অবশ্য এসব তো খুচরা বাণিজ্য। এরশাদের বড় বাণিজ্য ঢাকা-১ আসন। এ আসনের বর্তমান সাংসদ সালমা ইসলাম যমুনা গ্রুপের মালিক নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী। তাই এ আসনের জন্য মরিয়া জাতীয় পার্টি। এরশাদ এবার আরেকটি বড় দাও মারতে চেয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসন নিয়ে। তিনি নিজে সেখানে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের বর্তমান সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী। কিন্তু বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। বসুন্ধরা গাজীকে সরাতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগে ভালো বিকল্প না পেয়ে এরশাদকে দিয়ে বসুন্ধরা গাজীকে সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু এই জুয়াটায় এরশাদ সফল হতে পারেননি।
মনোনয়ন বাণিজ্য যে শুধু জাতীয় পার্টিতেই হয়েছে, তা নয়। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাণিজ্যের খবর ছিল অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। তবে জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়ন পুরোটাই শেখ হাসিনা নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে বাণিজ্যের সুযোগ ছিল না। তবে অনেক দিন ধরে শুনে আসা গোপন জরিপের কোনো প্রতিফলন ছিল না আওয়ামী লীগের মনোনয়নে। প্রতিফলন ছিল না তৃণমূলের মতামতেরও। ১০ বছর ধরে যাদের অপকর্মে ম্লান হয়েছে সরকারের অনেক অর্জন, তাদের প্রায় সবার নামই আছে মনোনয়ন তালিকায়।
অতি বিতর্কের কারণে বাদ পড়া দুজনও আসলে বাদ পড়েননি। দলীয় নেতা খুনের দায়ে কারাগারে থাকা আমানুর রহমান খান রানার আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তার বাবা আর ইয়াবা চোরাচালানে জড়িত সন্দেহে দেশজুড়ে সমালোচিত বদির আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তার স্ত্রী। ৭টি জরিপ, তৃণমূলের মতামত তাহলে কই গেল? যিনি বিশ্বব্যাংককে টেক্কা দিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে পারেন, তিনি কেন মনোনয়ন প্রশ্নে আরেকটু ঝুঁকি নিলেন না, আমি জানি না।
তবে বিএনপি যেভাবে উদার হস্তে মনোনয়ন বিলিয়েছে, তাতে বাণিজ্যের গন্ধ রাজনীতি না বোঝা শিশুও পাবে। ৩০০ আসনে ৮০০ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া কোনো সুস্থ রাজনৈতিক দলের লক্ষণ হতে পারে না। কোনো কোনো আসনে বিএনপি দুইজন, এমনকি তিনজনকেও মনোনয়ন দিয়েছে। বিএনপি বলছে, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। যদি বা ঋণখেলাপি বা অন্য কোনো অজুহাতে তাদের নিয়মিত কোনো প্রার্থী অযোগ্য হয়ে যান, তখনও যাতে সে আসন ফাঁকা হয়ে না যায়, সে জন্যই একাধিক প্রার্থীর এ কৌশল। কিন্তু এ কৌশলের ফাঁক গলে যে আরো কত অপকৌশল ঢুকে গেছে সে খবর কি রেখেছেন বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা? লন্ডন কানেকশনের সুবাদে অনেক সিনিয়র পলিটিশিয়ানকে ল্যাং মেরে অনেক অচেনা ব্যবসায়ী মনোনয়ন পেয়েছে, এই গল্প গুলশানের ইট-বালুও জানে। কিন্তু লন্ডনের সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছে গুলশান অফিসের ক্লার্করা, এমন অডিওও ফাঁস হয়েছে। কয়েক কোটি টাকা দিয়েও মনোনয়ন পাননি, এমন গল্পও অবিশ্বাস্য নয়। তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে, মানে ওভার ট্রাম্প করে কেউ মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছে হয়তো।
অনেকেই নাকি এসে বলেছে, আমি নির্বাচন করবো না, খালি একটা মনোনয়ন দেন, বাধিয়ে রাখবো। কী হাস্যকর আবদার এবং সেই আবদার রাখা হয়েছে। বিএনপির গুলশান অফিস যেন খাজা বাবার দরবার। কেউ ফিরে না খালি হাতে। ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি দল মনোনয়ন নিয়ে এমন ছেলেখেলা খেলতে পারে, নিজে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। আমি ভেবেছি, বিএনপি আন্দোলনের ব্যাপারে, নির্বাচনের ব্যাপারে, খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে অনেক সিরিয়াস। কিন্তু এ যে দেখছি, পুরো প্রহসন মঞ্চস্থ হচ্ছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন বাণিজ্যের যে নগ্ন ও উদগ্র প্রকাশ দেখলাম, তাতে তো মনে হচ্ছে আড়াই বছর পরপর নির্বাচন হলে আর সংসদের আসন ৬০০ হলে তারা খুশি হবেন। হারি আর জিতি বাণিজ্য তো ডাবল হবে।
প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ