৪৪ বছর পর স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ হওয়া এক বীর প্রতীকের সমাধির সন্ধান পেয়েছে তাঁর পরিবার। সিলেটে ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রশিদ আলী বীরপ্রতিক একাত্তরে চুয়াডাঙ্গা এলাকায় এক সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। এতোদিন তাঁর পরিবারের লোকজন জানতোই না কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছে রশিদ আলীকে।
চুয়াল্লিশ বছর ধরে পরিবারের সদস্যরা খুঁজে ফিরেছেন পরিবারের এই শ্রেষ্ট সন্তানটির সমাধিস্থল। অবশেষে সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা এলাকার জীবননগর উপজেলার উতলি ইউনিয়নের ধোফাখালী হাট এলাকায় রশিদ আলীর সমাধিস্থর খুঁজে পায় পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্র ঘেঁটে ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে এ সমাধিস্থলের সন্ধান বের করেন শহীদ বীরপ্রতিকের ভাতুস্পুত্র ছায়েদুল ইসলাম খালেদ।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী তরুণ ছায়েদুল ইসলাম খালেদের জন্ম স্বাধীনতার পাঁচ বছর পরে, নিজের চাচার কোনো ছবি পর্যন্ত দেখেননি তিনি। বাবার মার মুখে চাচার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছেন। আর বড় হয়েছেন চাচার কোথায় শুয়ে আছেন তা জানার আফসোস শুনতে শুনতে। সেই থেকেই বীর চাচার সমাধিস্থর খোঁজার সন্ধানে নামেন খালেদ। অবশেষে গত মাসের শেষের দিকে খুঁজে পান কাঙ্খিত সমাধি। চুয়াল্লিশ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে পরিবারটির।
শহীদ রশীদ আলীর একমাত্র ছোটো ভাই খুরশিদ আলী বলেন, দীর্ঘ দিন খোঁজাখোজি করেও আমরা বড় ভাইয়ের সমাধির কোনো সন্ধান পাননি। কোথায় তাকে কবর দেওয়া হয়েছে কিংবা আদৌ কবরস্থ করা হয়েছে কী না তা জানতাম না। কেবল জানতাম চুয়াডাঙ্গা এলাকায় যুদ্ধ কেতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন তিনি অবেশেষ তাঁর সমাধিস্থল খুঁজে পেলাম। চুয়াল।লিশ বছর পর চাচার সমাধিস্থল খোঁজে বের করা প্রসঙ্গে ছায়েদুল ইসলাম খালেদ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘ছোট বেলায় বিজয় দিবসে শহীদ মিনারে যখন ফুল নিয়ে যেতাম তখন আমার বাবাকে খুব উদাস মনে বসে থাকতে দেখতাম। তখন আমার মনে হত তিনি হয়ত কারো জন্য অপেক্ষা করছেন।
তখন বাবাকে জিজ্ঞেস করলে আমার চাচার কথার বলতেন। ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। বাবা উনার ভাইয়ের কবর দেখার জন্য খুব আক্ষেপ করতেন।
সেই থেকেই আমার চেষ্টা শুরু চাচার কবর সনাক্তের জন্য। কিন্তু সময়, সামর্থ্য আর অভিজ্ঞতার কারণে অনেক দিন তা সম্ভব হয়ে উঠে নি। গত দুই বছর থেকে বই পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করে, যেখানে শহীদ হয়েছেন সেখানকার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকাবাসীর সাথে যোগাযোগ করে চাচার কবর সনাক্ত করতে সম্ভব হই।’
তিনি জানান, ‘পাকিস্তান পরাজয়ের দলিল “হামিদুর রহমান কমিশন” এবং চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইটি তাঁর চাচার কবর সনাক্তকরণে খুব সহায়ক ছিল।’
শহীদ রশিদ আলী বীর প্রতীক ১৯৩১ সালের ১০ মে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জের উপজেলার মাইজগাঁও জন্ম গ্রহণ করেন ৷ বাবা প্রয়াত মনসুর আলী ও মা প্রয়াত করিমুন্নিসা ৷ ভাই বোন তিন জনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়, তার একমাত্র ছোট ভাই হাজী খুরশিদ আলী আর একমাত্র ছোট বোন প্রয়াত কমলা বেগম ৷ খুরশিদ আলীর পরিবার এখনো সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে বাস করেন। শহীদ রশিদ আলী বীর প্রতীক ১৯৫০ সালে তত্কালীন ইপিআর ৪ নম্বর উইংয়ের একজন সৈনিক হিসাবে যোগদান করেন ৷ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল আবু ওসমান চৌধরীর নেতৃতত্বে সশস্র যুদ্ধ শুরু নামেন রশিদ আলী। বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন তিনি। একজন অভিজ্ঞ ইপিআর সদস্য হিসাবে তিনি চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত এলাকায় তরুণ মুমুক্তিযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণও দিতেন ৷
৭ আগস্ট ১৯৭১ ৷ ৮ নম্বর সেক্টর সাবকমান্ডার সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার উতলি ইউনিয়নে এক সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে সুবেদার রশিদ আলীসহ পাঁচ জন শহীদ হন। অসামান্য বীরত্বের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পর তাকে শহীদ খেতাব দেওয়া হয়। শহীদ রশীদ আলী বীর প্রতীকসহ পাঁচ শহীদকে চুয়াডাঙ্গার ধোফাখালী হাট সীমান্ত এলাকায় সমাধিস্থ করা হয়।