হাওর বার্তা ডেস্কঃ গ্রিন টির (সবুজ চা) আড়ালে দেশেই বিক্রি হচ্ছে নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস (এনপিএস) জাতীয় মাদকদ্রব্য ‘খাট’। সম্প্রতি দেশে নতুন এই মাদকের চালান জব্দের পর এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। যদিও আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া গাঁজাখ্যাত এই মাদকটি বিদেশেই পাচার হচ্ছে বেশি। বাংলাদেশ শুধু রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। কিন্তু আগস্টের শেষ দিন সাড়ে আটশ কেজির চালানের ঘটনায় এক আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারিকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য আসে। তবে দেশের মাদকের তালিকায় এই মাদকটি না থাকায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রিন টির আড়ালে কয়েক বছর ধরে ইথিওপয়ীয় গাঁজা ‘খাট’ দেশে ঢুকছে। একটি-দুটি নয়, দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই কারবারে যুক্ত। এমন ১৯টির ঠিকানা পাওয়া গেছে। অবশ্য এসব ঠিকানার বেশির ভাগই ভুয়া বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা বলছেন, এসব চালান এনে মাদক কারবারিরা অন্য দেশে পাঠাচ্ছে। তবে দেশেও এই মাদক বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘এনপিএস’ বা ‘খাট’ দেশে ব্যাপক হারে ব্যবহারের শঙ্কা করছেন তারা। এরই মধ্যে ইয়াবার বিকল্প হিসেবে অল্প পরিসরে ব্যবহারও শুরু হয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। মাদকদ্রব্য হিসেবে অপরিচিত হওয়ায় এবং সম্প্রতি ইয়াবাসহ প্রচলিত মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরুর কারণে ‘খাট’ কারবার বেড়েছে বলেও ধারণা তাদের। তবে গোয়েন্দারাও তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া ছাড়াও কেনিয়া থেকে আসছে এই মাদকদ্রব্যটি। গত রোববার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্তত ১ হাজার ৮০০ কেজির বিশাল একটি চালান জব্দ করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত দেশে উদ্ধার হওয়া ‘খাট’ নামের এই মাদকদ্রব্যের চালানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। গতকাল আরো ১৪০ কেজি ওজনের ‘এনপিএস’ বা ‘খাট’ জব্দ হয়েছে। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর ১৬০ কেজি এবং ৩১ আগস্ট দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই দফায় ৮৬১ কেজি ‘খাট’ জব্দ হয়েছে। সেই হিসেবে এক সপ্তাহে শাহজালাল বিমানবন্দরে চার অভিযানে প্রায় ২ হাজার ৬৮০ কেজি ‘খাট’ জব্দ হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম সিকদার জানান, দেশে বড় চালান ঢোকার তথ্য আছে। এ ঘটনায় যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে, তা ধরে কাজ চলছে। দেশে এটি ব্যবহার হচ্ছে কি না বা কারা করছে, সেটি নিয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছি।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ৩১ আগস্ট বিমানবন্দরে দেশে প্রথম ‘খাট’ চালান জব্দ করে ডিএনসি। ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ নামের এক ব্যক্তি ঢাকার শান্তিনগরের নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে চালানটি পাঠান। সেদিন বিমানবন্দর ও শান্তিনগর প্লাজা থেকে মোট ৮৬০ কেজি ‘খাথ’সহ নাজিমকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরে তল্লাশি চালিয়ে একই ধরনের ২০ কেজি মাদক জব্দ করেন ডিএনসির গোয়েন্দারা। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর কার্গো ইউনিটের অভ্যন্তরে ‘ফরেইন পোস্ট অফিসের’ মাধ্যমে ১৬০ কেজির একটি চালান জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। ওই চালানটিও ইথিওপিয়ার জিয়াদ মুহাম্মদ ইউসুফ নামে এসেছে। তবে আমদানিকারক এশা এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকার তুরাগের বাউনিয়ার ব্লক-ডি, সড়ক-২, হাউস নম্বর-২৮। ওই ঠিকানায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি। তবে তদন্তে বাবু নামের এক ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, যাকে গ্রেফতারে অভিযানে নেমেছেন গোয়েন্দারা।
এরই মধ্যে গত রোববার কাস্টমস হাউসের সহায়তায় সিআইডি চারটি চালানের ৯৬ কার্টন শনাক্ত করে। এগুলো এশা এন্টারপ্রাইজ, মতি এন্টারপ্রাইজ, আলমগীর এন্টারপ্রাইজ ও আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামে আসে। বেশির ভাগই ইথিওপিয়ার জিয়াদ মুহাম্মদ ইউসুফের কাছ থেকে আনা। তবে কেনিয়া থেকেও আসে কয়েকটি কার্টন। একটি চালান ছয় মাস আগে আসে। মালিকানাসহ অন্য জটিলতার কারণে বিমানবন্দরে আটকে ছিল সেটি। এক সপ্তাহ আগে আসে আরো একটি চালান। বাকি দুই চালান দু-তিন মাসের মধ্যে এসেছে। এগুলো গ্রিন টির মতো প্যাকেটে আনা হয়েছে। সিআইডি এরই মধ্যে গ্রহণকারী বা আমদানিকারকের ঠিকানা যাচাই শুরু করেছে। অন্য সংস্থাগুলোও তদন্ত করছে। তাদের ধারণা, এখন পর্যন্ত ১৯টি ঠিকানা পাওয়া গেলেও আরো বেশিসংখ্যক ব্যক্তি ‘খাট’ বিক্রিতে জড়িত।
ডিএনসির এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ‘এনপিএস’ বা ‘খাট’ গাছটি পপির মতোই। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে এই গাছের পুরোটাই শুকিয়ে গুঁড়া করে মাদক হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তবে মাদকের শ্রেণি অনুযায়ী এটি এনপিএস জাতীয়। এটি বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের প্রচলিত মাদক আইন বা ১৯৭১ সালের ওষুধ আইনে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। যদিও জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি প্রচন্ড রকমের ক্ষতিকর। পণ্যটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ এর ‘খ’ তফসিলে ২ নম্বর ক্রমিকভুক্ত, যা একই আইনের ১৯ (১) টেবিলের ১০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটি মূলত চিবিয়ে বা পানিতে গুলিয়ে চায়ের মতো খাওয়া হয়। খাওয়ার পর ইয়াবার মতোই ক্লান্তি না আসা, ঘুম না হওয়াসহ শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এনপিএস আসক্ত ব্যক্তি মানসিক বৈকল্যে ভোগে। কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলে। বেঁচে থাকা তার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।
বাংলাদেশে নতুন হলেও এই মাদকটি বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্বে মাদক সেবনপ্রবণ ৮০টি দেশ এবং অঞ্চলে জরিপ করে ৭০টিতেই ‘এনপিএসের’ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাদক পাচারের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের মাঝামাঝি অবস্থান হওয়ায় এবং ইয়াবা বিস্তারের কারণে ২০১৫ সালে সংস্থাটি বাংলাদেশকে ‘এনপিএস’ বা ‘খাট’ জাতীয় মাদকটির ব্যাপারে সতর্ক করেছিল।