জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব ফেলবে সিটি নির্বাচন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বরিশাল মহানগর ও সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে সংসদের বরিশাল-৫ আসন, যা দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তাই আসনটির দিকে সব রাজনৈতিক দলেরই নজর থাকে। ভোটের পরিসংখ্যান বলছে, আসনটি বিএনপির ঘাঁটি। শুধু সংসদ নির্বাচনে নয়, সিটি ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনেও জয়ের ধারা বিএনপির দিকে। মাঝে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও ব্যক্তি ইমেজ কাজে লাগিয়ে মেয়র পদে জয় ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরন।

কিন্তু ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে জনপ্রিয় মেয়র হিরনকে হারিয়ে ‘জনবিচ্ছিন্ন’ আহসান হাবিব কামালের বিজয় প্রমাণ করেছে বিএনপির অবস্থান শক্ত। টানা দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মর্যাদার আসনটি ধরে রাখতে চায়। তবে এ মুহূর্তে দলের নেতাদের চোখ আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নের দিকে। সংসদ নির্বাচনে দলটির ফলাফল নির্ভর করবে কে দল থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন তার ওপর। অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে বিজয়ের ধারা বজায় রাখতে।

সব কিছুই বিএনপির পক্ষে : জাতীয় সংসদের ১২৩ নম্বর নির্বাচনী এলাকাটিতে বিএনপি বরাবরই বড় ব্যবধানে জয়লাভ করে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আবদুর রহমান বিশ্বাস স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি হলে উপনির্বাচনে মজিবর রহমান সরোয়ার প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের দুই সংসদে রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের ছেলে নাসিম বিশ্বাস নির্বাচিত হন।

১৯৯৮ সালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আবার সরোয়ার নির্বাচিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন তিনি এবং পরে মেয়রও হন। ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরোয়ার কারাগারে থাকায় সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। তবে বিএনপির দুই নেতা আহসান হাবিব কামাল ও এবায়েদুল হক চান সিটি নির্বাচনে অংশ নেন। তখন ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু মেয়র পদে বিএনপির সমর্থন পেয়ে মাত্র ৪৮০ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরন।

২০০৮ সালের নির্বাচনেও চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হন মজিবর রহমান সরোয়ার। ‘হঠাৎ’ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদ ফারুক শামিম ভোট পাওয়ার দিক থেকে দলের অবস্থান অনেকটাই পাল্টাতে পেরেছিলেন। তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরনের কারিশমার কারণেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামিম মাত্র ছয় হাজার ভোটে হারেন। অবশ্য ‘ভিন্নধারার রাজনীতির’ প্রচলন করেও মেয়র হিরন পরবর্তী সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

আওয়ামী লীগ : নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই শহরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যাতায়াত বাড়ে আর পরাজয়ের পর শহর ছাড়েন। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা না থাকায় ‘হঠাৎ’ মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা বিপাকে পড়েন। কর্মীদের তেমন একটা সহযোগিতা পান না তাঁরা। সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া হিরন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন। ১৯৭৩ সালের পর এটা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বিজয়। ওই বছরই তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ নির্বাচিত হন।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, জেবুন্নেসার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাবে স্বামীর অনুসারীদের বেশির ভাগই তাঁকে ছেড়ে এখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে ভিড় জমিয়েছে। একসময় হাসানাতকে গুরু মানলেও মেয়র নির্বাচিত হয়েই হিরন পাল্টে যান। দুজনের মধ্যে তৈরি হওয়া সেই দূরত্ব ও প্রকাশ্য দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটিয়েছেন জেবুন্নেসা। তবে এর নেপথ্যে রয়েছে আগামী নির্বাচনে জেবুন্নেসার দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা।

জেবুন্নেসা আফরোজ বলেন, ‘হিরন যখন মেয়র তখন বেশির ভাগ সময়ই আমি ঢাকায় থাকতাম। কাজে কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাঁকে কখনো হাসানাত আবদুল্লাহর বিরোধিতা করতে দেখিনি, বরং তাঁকে তিনি অভিভাবক ভাবতেন। হাসানাত আবদুল্লাহ শুধু আমার নয়, এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অভিভাবক। তাঁর পরামর্শ নিয়েই আমি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করি।’

আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন প্রশ্নে জেবুন্নেসা আফরোজ বলেন, ‘এই চার বছরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমার একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও আমি এখন প্রতিষ্ঠিত। মনোনয়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় বিবেচনা করবেন।’

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম এর আগে একাধিকবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েও জিততে পারেননি। এমনকি বরিশালের বাইরে তাঁর জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জে নির্বাচন করেও হেরেছেন। তবু হাল না ছেড়ে জাতীয় দিবসগুলোতে বরিশালে আসছেন, কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর মতো প্রায়ই বরিশালে আসেন ২০০৮ সালের দলীয় প্রার্থী সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাহিদ ফারুক শামিম। সিটির পাশাপাশি তিনি সংসদেও মনোনয়ন চাচ্ছেন।

জাহিদ ফারুক শামিম বলেন, ‘২০০৮ সালে দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছি। মাত্র ছয় হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছি। মনোনয়ন পেলে আগামী নির্বাচনে আসনটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে পারব।’

মাহবুব উদ্দিন বলেন, ‘বরিশালের সাধারণ মানুষ আমাকে চেনে-জানে। তারা চায়, আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করি। তা ছাড়া আমি নিয়মিত এলাকা ও এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা-ই মাথা পেতে নেব।’

আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রার্থীর ধারাবাহিকতার ছন্দ পতনের কারণে প্রতিবারই আসনটি হাতছাড়া হচ্ছে। সিটি নির্বাচনের প্রার্থীর ওপর নির্ভর করছে এ আসনে সংসদ নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী কে হবেন। বিগত যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে আসন্ন সিটি ও সংসদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

দুটির যেকোনো একটি নির্বাচনের জয় আওয়ামী লীগের ঝুলিতে আসার আভাস দিয়ে বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন পেলেই ফলাফল পাল্টে যাবে। সেই ফলাফল প্রভাব ফেলবে জাতীয় নির্বাচনে।’

এদিকে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকেই চাইছে, সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তরুণ ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন রিপন প্রার্থী হোন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এই সন্তান প্রার্থী হলে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি বরিশাল-৫ আসনটি দখল করা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হতে পারে বলে মনে করছে তারা। ২০০৬ সাল থেকে তিনি এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে নিজ এলাকায় সহায়তামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহযোগিতা করে আসছেন।

নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কি না জানতে চাইলে রিপন বলেন, ‘নির্বাচন তো এখনো এক বছর বাকি। তবে এমপি হয়ে টাকা কামানোর চিরচেনা পথে হাঁটার ইচ্ছা আমার নেই। আল্লাহ যে সম্পদ দিয়েছেন, তাতে এলাকাবাসীর হক রয়েছে বলেই জনকল্যাণে যুক্ত হয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, ‘সদর আসনে স্থানীয় প্রার্থী নেই বহুদিন। এলাকাবাসী চাইলে বৃহত্তর পরিসরে মানুষের সেবা করা যেতে পারে। যে অবস্থায়ই থাকি, আমাদের সংস্থার কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।’

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টুও এ আসনে মনোনয়ন চাইছেন। তিনি দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

মনোনয়ন প্রসঙ্গে সাইদুর বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা চাইলে নির্বাচন করব। তবে সব কিছুই নির্ভর করে দলীয় সভানেত্রী এবং আমার রাজনৈতিক অভিভাবক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ওপর।’

‘ক্লিন ইমেজে’র রাজনীতিবিদ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলালও মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য কাজ করছি। আমার রাজনৈতিক অভিভাবক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও দলীয় সভানেত্রী যা সিদ্ধান্ত দেবেন, তা-ই আমি মাথা পেতে নেব।’

বিএনপি : সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকাটি বেশ বড়। তবে দলের যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারই মনোনয়ন পাবেন—এটা মোটামুটি নিশ্চিত বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন হওয়ায় সরোয়ার দলীয় মহলে বলছেন, তিনি সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। আবার এও বলছেন, নেত্রী চাইলে প্রার্থী হবেন।

মেয়র ও সংসদ দুটি নির্বাচনই করতে চাইছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বিলকিস জাহান শিরিন। সিটি নির্বাচনের মনোনয়ন দৌড়ে শিরিন এগিয়ে গেলে রাজনৈতিক মাঠ দখলে রাখতে সরোয়ারও সিটি নির্বাচনে আসতে পারেন বলে দলীয় সূত্র আভাস দিয়েছে। মেয়র পদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চান। বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামাল সিটি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাচ্ছেন। সরোয়ারও তাঁর পক্ষে। কামালের পক্ষ নিলে নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ সংসদ নির্বাচনে সরোয়ারের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। কোন্দলের কারণে সিটি ও সংসদ নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে যেতে পারে, তা মাথায় রেখেই খুব সতর্ক বিএনপি।

বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ‘সিটি নির্বাচনের আগে যদি সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে এ নির্বাচনে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। এর আগেও চেয়েছি। সিদ্ধান্ত দেবেন দেশনেত্রী।’

সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে চান এবায়েদুল হক চান। কিন্তু সংসদ নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচন যদি আগে হয়, তাহলে সেই নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। সিদ্ধান্ত   নেবে দল। তবে সরোয়ারের প্রতিপক্ষ আমি নই।’

মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে দলের স্বার্থে আমি সব কিছুই করতে বাধ্য। মনোনয়ন নিয়ে এখন নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও ধানের শীষের পক্ষেই কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। আসনটি বিএনপির, আগামী দিনেও এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : বরিশাল সদর আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একক প্রার্থী দেবে। এ আসনে দলীয় প্রার্থী হতে পারেন চরমোনাই পীরের ভাই ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির মুফতি মো. ফয়জুল করিম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর