ঢাকা ০১:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরআনে বর্ণিত একটি দ্বীনের দাওয়াত

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:৩১:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ নভেম্বর ২০১৭
  • ৩৯৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ লোকটি পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। নাম তাঁর হাবিব ইবনে ইসমাঈল। তিনি থাকতেন সিরিয়ার ইন্তাকিয়ার শহরতলিতে। শহরটি সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যের জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ইন্তাকিয়াবাসী ছিল পাপাচারে লিপ্ত। হাবিব নিজেও ছিলেন পাপাচারে লিপ্ত। তিনি বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হাবিব ছিলেন কুষ্ঠরোগী। ভীষণ অসুস্থতা তাঁর। তারপরও খেটেই খেতেন তিনি। রোগ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে মনে-প্রাণে উপাসনা করতেন কাল্পনিক উপাস্য দেবদেবীদের। তিনি বিশ্বাস করতেন, কাল্পনিক দেবদেবীরাই তাঁকে রোগ থেকে আরোগ্য প্রদান করতে সক্ষম। তারাই পারে সবকিছু করতে। এভাবেই শিরকি কর্মকা-, অসুস্থতা আর কাঠের কাজ করে তাঁর দিনগুলো কাটছিল। তাঁর মনে কোনো শান্তি ছিল না। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিরকি পাপের ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
মহান আল্লাহ তায়ালা হাবিব এবং তাঁর সম্প্রদায় ইন্তাকিয়াবাসীদের সতর্ক করার ইচ্ছা করলেন। তিনি প্রথমে দুইজন রাসুল প্রেরণ করলেন। রাসুলদ্বয়ের নাম ছিল ‘সাদিক ও সদুক’। ঘটনাক্রমে রাসুলদ্বয় ইন্তাকিয়া শহরের উপকণ্ঠের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন। তাই সর্বপ্রথম তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো হাবিব ইবনে ইসমাঈল নাজ্জারের সঙ্গে। রাসুলদ্বয় তাঁকে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করার এবং এক আল্লাহর উপাসনা করার দাওয়াত দিলেন। তখন হাবিব বললেন, ‘আপনাদের দাবি যে সত্য, তার কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন আছে কি ?’ রাসুলদ্বয় বললেন, ‘আছে।’ তখন তিনি স্বীয় কুষ্ঠরোগের কথা তাঁদের বললেন। অতঃপর হাবিব তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি আমার এ ব্যাধি দূর করে দিতে পারবেন ?’ রাসুলদ্বয় বললেন, ‘হ্যাঁ ! আমরা আমাদের পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া করব। তিনি তোমাকে রোগমুক্ত করবেন।’ হাবিব রাসুলদ্বয়ের কথা শুনে খুব অবাক হলেন। বললেন, ‘আশ্চর্যের কথা ! আমি সত্তর বছর ধরে দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করছি। কিন্তু কোনোই উপকার পাইনি। অথচ আপনাদের পরওয়ারদিগার কীভাবে এক মুহূর্তে আমার অবস্থা পাল্টে দেবেন ?’ রাসুলদ্বয় বললেন, ‘আমাদের রব সর্বশক্তিমান। তুমি যাদের উপাস্য হিসেবে স্থির করেছ, তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই। তারা কারও উপকার বা অপকার করতে পারে না। পারবেও না।’
এসব কথা শুনে হাবিব মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন। অতঃপর রাসুলদ্বয় তাঁর জন্য দোয়া করলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করে দিলেন। ফলে তাঁর ঈমান আরও দৃঢ়তর হয়ে গেল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘সারা দিন যা উপার্জন করব, তার অর্ধেক আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে দেব।’
রাসুলদ্বয় ইন্তাকিয়াবাসীকে সত্য পথের দাওয়াত দিতেই থাকলেন। তাঁরা দিন-রাত চেষ্টা চালাতে থাকলেন; কিন্তু ইন্তাকিয়াবাসী তাঁদের মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করল। তখন তাঁদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ তায়ালা তৃতীয় আরেকজন রাসুল প্রেরণ করলেন। নাম তাঁর ‘শালুম বা শামউন’। অতঃপর তাঁরা তিনজন রাসুল একসঙ্গে জনপদবাসীদের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। কিন্তু রাসুলদের উপদেশমূলক প্রচার ও শিক্ষার জবাবে জনপদবাসী তাঁদের মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করতেই থাকল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা তো আমাদের মতোই মানুষ। আমরা তোমাদের কথা মানব কেন ? আমাদের প্রতিপালক কারও প্রতি কোনো পয়গাম ও কিতাব নাজিল করেননি। তোমরা নির্জলা মিথ্যা কথা বলছ।’
তাদের উসকানিমূলক কথাবার্তা শুনে রাসুলরা উত্তেজিত হলেন না, ধৈর্য ধারণ করলেন। নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনি দাওয়াত চালিয়েই গেলেন। তাঁরা জনপদবাসীর কথার জবাবে বলতে লাগলেন, ‘আমাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ জানেন, আমরা তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি এবং মহান আল্লাহর পয়গাম সুস্পষ্টভাবে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এখন মানা না-মানা তোমাদের ইচ্ছা।
ইন্তাকিয়াবাসী রাসুলদের কথা অমান্যই করল। পাপ কর্মকা- থেকে বিন্দুমাত্র পিছু হটল না। মহান আল্লাহ তাদের অবাধ্যতার কারণে ইন্তাকিয়া শহরে দুর্ভিক্ষ দিলেন। ইন্তাকিয়াবাসী মহান আল্লাহর সতর্ক সংকেত উপলব্ধি করতেই পারল না। উল্টো তারা রাসুলদের অলুক্ষণে বলতে লাগল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা অশুভ বলেই, আমরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছি।’
শহরবাসী রাসুলদের শত্রু হয়ে গেল। তারা রাসুলদের নানাভাবে কষ্ট দেওয়া শুরু করল। হত্যা করতে মনস্থ করল। এ খবর পৌঁছল হাবিব ইবনে ইসমাঈলের কানে। তিনি খবর শোনামাত্রই সেখানে ছুটে এলেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ করে হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দিলেন।
তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসুলদের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাঁদের, যাঁরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় কামনা করে না এবং তাঁরা নিজেরা সুপথপ্রাপ্তও বটে। তাছাড়া আমার কী এমন ওজর-আপত্তি আছে যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, কেন তাঁর ইবাদত করব না ? আমাদের সবাইকে তো তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। কাজেই তাঁর রাসুলদের অনুসরণ করাই বুদ্ধিমত্তার কাজ। মিথ্যা উপাস্যরা ইবাদত পাওয়ার যোগ্য নয়। আমি আল্লাহকে ছেড়ে অন্য দেবদেবীর উপাস্যরূপে গ্রহণ করব ? অথচ তারা এমন অসহায় যে, করুণাময় মহান আল্লাহ আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে সে উপাস্যদের সুপারিশ আমার কোনো কাজেই আসবে না। আর তারা আমাকে শক্তির জোরে এ কষ্ট থেকে রক্ষাও করতে পারবে না। অর্থাৎ না তারা নিজেরা ক্ষমতার অধিকারী, আর না তারা ক্ষমতার অধিকারীর কাছে সুপারিশের মাধ্যমও হতে পারে। কারণ প্রথমত জড়পদার্থের মধ্যে সুপারিশের যোগ্যতাই নেই। দ্বিতীয়ত, মহান আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতেও পারে না। এমন করলে তো আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হব। আমি রাসুলদের পালনকর্তা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব তোমরাও আমার কথা শোন এবং বিশ্বাস স্থাপন কর।’
এসব অমূল্য কথায় ইন্তাকিয়াবাসী কর্ণপাত করল না। তারা কোনোভাবেই হাবিবের কথা বুঝল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। তারা হাবিবের ওপর চড়াও হলো। তাঁকে লাথি-ঘুষি ও পাথরের পর পাথর মারতে লাগল। তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। তাঁর মৃত্যুর মুহূর্তে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, ‘জান্নাতে প্রবেশ কর।’
তখন হাবিব মনে মনে বলতে লাগলেন, হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানত, আমার পালনকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালা ঈমান ও রাসুলদের অনুসরণ করার জন্য আমাকে ক্ষমা করেছেন। আমাকে আবাসস্থল হিসেবে দিয়েছেন জান্নাত। এ অবস্থা জানলে তারাও বিশ্বাস স্থাপন করত এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও সম্মানিত হতে পারত।’ একপর্যায়ে তিনি শহীদি পবিত্র সুধা পান করলেন।
মহান আল্লাহ ইন্তাকিয়াবাসীর চরম ধৃষ্টতা আর গোড়ামির দরুন বেশ ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি আসমানি আজাব প্রেরণ করার ইচ্ছা করলেন। তিনি ইন্তাকিয়ার পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করার জন্য কোনো ফেরেশতাবাহিনী প্রেরণ করলেন না। কেননা এটার প্রয়োজনও নেই। কারণ মহান আল্লাহর একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট বড়, শক্তিশালী, বীরবাহাদুর এ সম্প্রদায়কে মুহূর্তের মধ্যেই মিসমার করে দেওয়ার জন্য। মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত জিবরাঈল (আ.) কে তাঁর আদেশসহ প্রেরণ করলেন।
তিনি শহরের দরজার দুই বাহু ধরে এমন কঠোর-বিকট আওয়াজ দিলেন, যার প্রবল প্রভাবে সবারই প্রাণবায়ু বের হয়ে গেল। সবাই নিথর হয়ে পড়ল। এক নিমিষেই পুরো ইন্তাকিয়া জনপদটি হয়ে গেল নিস্তব্ধ।

সূত্র : সূরা ইয়াসিন : ১৩-২৯ পর্যন্ত; তাফসিরুল মুঈইয়াসসার, তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন, তাফসিরে আহসানুল বয়ান, তাফসিরে তাওজিহুল কোরআন, তাফসিরে আল কোরআনুল কারিম, তাফসিরে ইবনে কাছীর, সাফওয়াতুত তাফাসির।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কোরআনে বর্ণিত একটি দ্বীনের দাওয়াত

আপডেট টাইম : ০১:৩১:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ লোকটি পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। নাম তাঁর হাবিব ইবনে ইসমাঈল। তিনি থাকতেন সিরিয়ার ইন্তাকিয়ার শহরতলিতে। শহরটি সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যের জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ইন্তাকিয়াবাসী ছিল পাপাচারে লিপ্ত। হাবিব নিজেও ছিলেন পাপাচারে লিপ্ত। তিনি বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হাবিব ছিলেন কুষ্ঠরোগী। ভীষণ অসুস্থতা তাঁর। তারপরও খেটেই খেতেন তিনি। রোগ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে মনে-প্রাণে উপাসনা করতেন কাল্পনিক উপাস্য দেবদেবীদের। তিনি বিশ্বাস করতেন, কাল্পনিক দেবদেবীরাই তাঁকে রোগ থেকে আরোগ্য প্রদান করতে সক্ষম। তারাই পারে সবকিছু করতে। এভাবেই শিরকি কর্মকা-, অসুস্থতা আর কাঠের কাজ করে তাঁর দিনগুলো কাটছিল। তাঁর মনে কোনো শান্তি ছিল না। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিরকি পাপের ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
মহান আল্লাহ তায়ালা হাবিব এবং তাঁর সম্প্রদায় ইন্তাকিয়াবাসীদের সতর্ক করার ইচ্ছা করলেন। তিনি প্রথমে দুইজন রাসুল প্রেরণ করলেন। রাসুলদ্বয়ের নাম ছিল ‘সাদিক ও সদুক’। ঘটনাক্রমে রাসুলদ্বয় ইন্তাকিয়া শহরের উপকণ্ঠের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন। তাই সর্বপ্রথম তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো হাবিব ইবনে ইসমাঈল নাজ্জারের সঙ্গে। রাসুলদ্বয় তাঁকে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করার এবং এক আল্লাহর উপাসনা করার দাওয়াত দিলেন। তখন হাবিব বললেন, ‘আপনাদের দাবি যে সত্য, তার কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন আছে কি ?’ রাসুলদ্বয় বললেন, ‘আছে।’ তখন তিনি স্বীয় কুষ্ঠরোগের কথা তাঁদের বললেন। অতঃপর হাবিব তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি আমার এ ব্যাধি দূর করে দিতে পারবেন ?’ রাসুলদ্বয় বললেন, ‘হ্যাঁ ! আমরা আমাদের পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া করব। তিনি তোমাকে রোগমুক্ত করবেন।’ হাবিব রাসুলদ্বয়ের কথা শুনে খুব অবাক হলেন। বললেন, ‘আশ্চর্যের কথা ! আমি সত্তর বছর ধরে দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করছি। কিন্তু কোনোই উপকার পাইনি। অথচ আপনাদের পরওয়ারদিগার কীভাবে এক মুহূর্তে আমার অবস্থা পাল্টে দেবেন ?’ রাসুলদ্বয় বললেন, ‘আমাদের রব সর্বশক্তিমান। তুমি যাদের উপাস্য হিসেবে স্থির করেছ, তাদের কোনো ক্ষমতাই নেই। তারা কারও উপকার বা অপকার করতে পারে না। পারবেও না।’
এসব কথা শুনে হাবিব মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন। অতঃপর রাসুলদ্বয় তাঁর জন্য দোয়া করলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করে দিলেন। ফলে তাঁর ঈমান আরও দৃঢ়তর হয়ে গেল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘সারা দিন যা উপার্জন করব, তার অর্ধেক আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে দেব।’
রাসুলদ্বয় ইন্তাকিয়াবাসীকে সত্য পথের দাওয়াত দিতেই থাকলেন। তাঁরা দিন-রাত চেষ্টা চালাতে থাকলেন; কিন্তু ইন্তাকিয়াবাসী তাঁদের মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করল। তখন তাঁদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ তায়ালা তৃতীয় আরেকজন রাসুল প্রেরণ করলেন। নাম তাঁর ‘শালুম বা শামউন’। অতঃপর তাঁরা তিনজন রাসুল একসঙ্গে জনপদবাসীদের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। কিন্তু রাসুলদের উপদেশমূলক প্রচার ও শিক্ষার জবাবে জনপদবাসী তাঁদের মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করতেই থাকল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা তো আমাদের মতোই মানুষ। আমরা তোমাদের কথা মানব কেন ? আমাদের প্রতিপালক কারও প্রতি কোনো পয়গাম ও কিতাব নাজিল করেননি। তোমরা নির্জলা মিথ্যা কথা বলছ।’
তাদের উসকানিমূলক কথাবার্তা শুনে রাসুলরা উত্তেজিত হলেন না, ধৈর্য ধারণ করলেন। নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনি দাওয়াত চালিয়েই গেলেন। তাঁরা জনপদবাসীর কথার জবাবে বলতে লাগলেন, ‘আমাদের পালনকর্তা মহান আল্লাহ জানেন, আমরা তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি এবং মহান আল্লাহর পয়গাম সুস্পষ্টভাবে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এখন মানা না-মানা তোমাদের ইচ্ছা।
ইন্তাকিয়াবাসী রাসুলদের কথা অমান্যই করল। পাপ কর্মকা- থেকে বিন্দুমাত্র পিছু হটল না। মহান আল্লাহ তাদের অবাধ্যতার কারণে ইন্তাকিয়া শহরে দুর্ভিক্ষ দিলেন। ইন্তাকিয়াবাসী মহান আল্লাহর সতর্ক সংকেত উপলব্ধি করতেই পারল না। উল্টো তারা রাসুলদের অলুক্ষণে বলতে লাগল। তারা বলতে লাগল, ‘তোমরা অশুভ বলেই, আমরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছি।’
শহরবাসী রাসুলদের শত্রু হয়ে গেল। তারা রাসুলদের নানাভাবে কষ্ট দেওয়া শুরু করল। হত্যা করতে মনস্থ করল। এ খবর পৌঁছল হাবিব ইবনে ইসমাঈলের কানে। তিনি খবর শোনামাত্রই সেখানে ছুটে এলেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ করে হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দিলেন।
তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসুলদের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাঁদের, যাঁরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় কামনা করে না এবং তাঁরা নিজেরা সুপথপ্রাপ্তও বটে। তাছাড়া আমার কী এমন ওজর-আপত্তি আছে যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, কেন তাঁর ইবাদত করব না ? আমাদের সবাইকে তো তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। কাজেই তাঁর রাসুলদের অনুসরণ করাই বুদ্ধিমত্তার কাজ। মিথ্যা উপাস্যরা ইবাদত পাওয়ার যোগ্য নয়। আমি আল্লাহকে ছেড়ে অন্য দেবদেবীর উপাস্যরূপে গ্রহণ করব ? অথচ তারা এমন অসহায় যে, করুণাময় মহান আল্লাহ আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে সে উপাস্যদের সুপারিশ আমার কোনো কাজেই আসবে না। আর তারা আমাকে শক্তির জোরে এ কষ্ট থেকে রক্ষাও করতে পারবে না। অর্থাৎ না তারা নিজেরা ক্ষমতার অধিকারী, আর না তারা ক্ষমতার অধিকারীর কাছে সুপারিশের মাধ্যমও হতে পারে। কারণ প্রথমত জড়পদার্থের মধ্যে সুপারিশের যোগ্যতাই নেই। দ্বিতীয়ত, মহান আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতেও পারে না। এমন করলে তো আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হব। আমি রাসুলদের পালনকর্তা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব তোমরাও আমার কথা শোন এবং বিশ্বাস স্থাপন কর।’
এসব অমূল্য কথায় ইন্তাকিয়াবাসী কর্ণপাত করল না। তারা কোনোভাবেই হাবিবের কথা বুঝল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। তারা হাবিবের ওপর চড়াও হলো। তাঁকে লাথি-ঘুষি ও পাথরের পর পাথর মারতে লাগল। তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। তাঁর মৃত্যুর মুহূর্তে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো, ‘জান্নাতে প্রবেশ কর।’
তখন হাবিব মনে মনে বলতে লাগলেন, হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানত, আমার পালনকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালা ঈমান ও রাসুলদের অনুসরণ করার জন্য আমাকে ক্ষমা করেছেন। আমাকে আবাসস্থল হিসেবে দিয়েছেন জান্নাত। এ অবস্থা জানলে তারাও বিশ্বাস স্থাপন করত এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও সম্মানিত হতে পারত।’ একপর্যায়ে তিনি শহীদি পবিত্র সুধা পান করলেন।
মহান আল্লাহ ইন্তাকিয়াবাসীর চরম ধৃষ্টতা আর গোড়ামির দরুন বেশ ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি আসমানি আজাব প্রেরণ করার ইচ্ছা করলেন। তিনি ইন্তাকিয়ার পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করার জন্য কোনো ফেরেশতাবাহিনী প্রেরণ করলেন না। কেননা এটার প্রয়োজনও নেই। কারণ মহান আল্লাহর একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট বড়, শক্তিশালী, বীরবাহাদুর এ সম্প্রদায়কে মুহূর্তের মধ্যেই মিসমার করে দেওয়ার জন্য। মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত জিবরাঈল (আ.) কে তাঁর আদেশসহ প্রেরণ করলেন।
তিনি শহরের দরজার দুই বাহু ধরে এমন কঠোর-বিকট আওয়াজ দিলেন, যার প্রবল প্রভাবে সবারই প্রাণবায়ু বের হয়ে গেল। সবাই নিথর হয়ে পড়ল। এক নিমিষেই পুরো ইন্তাকিয়া জনপদটি হয়ে গেল নিস্তব্ধ।

সূত্র : সূরা ইয়াসিন : ১৩-২৯ পর্যন্ত; তাফসিরুল মুঈইয়াসসার, তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন, তাফসিরে আহসানুল বয়ান, তাফসিরে তাওজিহুল কোরআন, তাফসিরে আল কোরআনুল কারিম, তাফসিরে ইবনে কাছীর, সাফওয়াতুত তাফাসির।