ঢাকা ০৭:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্ডারে দুর্নীতির কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আব্রাম না থাকলে তাকে আমার যোগ্য বলেও মনে করতাম না ওমরাহ শেষে গ্রামে ফিরে খেজুর-জমজমের পানি বিতরণ করল শিশু রিফাত বিদেশে প্রশিক্ষণে ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তি নয়, জুনিয়রদের অগ্রাধিকার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মতামত জরিপ জানুয়ারিতে বুয়েট শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে বিয়ের আগে পরস্পরকে যে প্রশ্নগুলো করা জরুরি

রোহিঙ্গা সমস্যা ও অকার্যকর সার্ক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:২৫:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৭
  • ৩১৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কোনো আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের মূলত দুটি উদ্দেশ্য থাকে। পারস্পরিক সহায়তা এবং কোনো সদস্যদেশ বিপদে পড়লে অন্যান্য দেশের এগিয়ে আসা। এটি আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানের ক্ষেত্রে দেখেছি।

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ এখন গভীর সংকটে। কিন্তু এ ব্যাপারে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা—সার্কের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সার্কের নীতিমালায় দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিয়ে আলোচনার সুযোগ না থাকলেও কোনো সদস্যদেশ বিপদে পড়লে তাকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যখন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম সোচ্চার, তখন এই ফোরামে আলোচনা না হওয়ার কারণ সার্কের অকার্যকরতা।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানের আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে একটি ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ওই সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এরপর সার্কের আরও চারটি দেশ বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান সম্মেলনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ সম্মেলনে না যাওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছিল, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। বাকিরা বলেছে, পাকিস্তান এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটাচ্ছে, যা সার্ক সনদের লঙ্ঘন, কাজেই যাব না সম্মেলনে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তার দেশে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করে। সেই থেকে সার্কের কার্যক্রম প্রায় অচল।

অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ভারতের হিন্দু পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিমসটেকের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সার্ক হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা এবং তা আগের মতোই আছে। বঙ্গোপসাগরের চারপাশের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গঠিত বিমসটেকের আমিও একজন প্রতিষ্ঠাতা, যেহেতু ১৯৯৭ সালে আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। নরেন্দ্র মোদি সংস্থাটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং এ জন্য আমি তঁার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি একটি সংস্থাকে অপর একটি সংস্থার বিকল্প হিসেবে দেখি না।’

বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সার্কের প্রয়োজন রয়েছে। মিয়ানমারে এখন যা ঘটেছে, তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ। সার্কের সদস্যদেশগুলো যৌথভাবে এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত, যদি সার্ক কার্যকর থাকত।

 ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশনের (সার্ক) যাত্রা শুরুই হয়েছিল সদস্যদেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন এবং সদস্যদেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে। সার্কের সহযোগিতা কার্যক্রম হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি, খাদ্য, পরিবেশ, পর্যটন, আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস এবং মাদক, মানব পাচার, দমনসহ অনেক প্রটোকল ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। মুক্তবাজার সম্প্রসারণে ‘সাফটা’ চুক্তি হয়েছে। কিন্তু তারপরও সার্ক কার্যকর সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

সার্কের সনদ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা প্রতিবছর এক বা একাধিক শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হবেন। গত ৩২ বছরে ৩২টি শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১৮টি। প্রথম তিন বছর ঠিকভাবে সম্মেলন হয়েছে। ১৯৮৯ সালে পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনী (আইপিকেএফ) পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ হয়েছে—এই অজুহাত তুলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে অস্বীকৃতি জানায় কলম্বো। পরের বছর ১৯৯০ সালে পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে। এরপর ১৯৯১ সালে ষষ্ঠ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়টা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ছিল তীব্র বৈরিতাপূর্ণ। কারগিল যুদ্ধ ও ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি সে সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে এক মঞ্চে উঠতে চাননি। যদিও ২০০২ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সময় এই দুই নেতার বিখ্যাত ‘করমর্দন’ পত্রপত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়েছিল। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদে আয়োজিত সম্মেলনে বাজপেয়ি যোগ দেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় সার্কের ১৩তম সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। সার্কের নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো একটি সদস্যরাষ্ট্র অংশ না নিলে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় না।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, সার্ক সম্মেলন স্থগিত হওয়ার পেছনে ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যখন সার্কে যোগ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনুরোধ জানানো হয়, তখন এ নিয়ে দেশটির ভেতরে বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়। কারণ, পাকিস্তান নিজেকে পশ্চিম এশিয়ার এবং ইসলামি দেশ হিসেবে বিবেচনা করত, আরব বিশ্বের সঙ্গে যার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। পরে অবশ্য দেশটি সার্কে যোগ দিতে রাজি হয়। হয়তো পাকিস্তান মনে করেছিল, এই আঞ্চলিক জোটের মধ্য থেকে তারা এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা থেকে ভারতকে প্রতিহত করবে। আর সেটা যখন পারেনি, তখন তারা সার্কের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাধা দিয়েছে।

সম্প্রতি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মোটরযান চলাচল চুক্তি করার প্রস্তাব যখন এল, তখন পাকিস্তান বলল, তারা এর মধ্যে নেই। পরে অবশ্য ভুটানও এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান সড়ক চুক্তি পাকিস্তানের বাগড়ায় হতে পারেনি। আবার সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে পাকিস্তান। এ ছাড়া সার্ক শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বরাবরই করে আসছে পাকিস্তান।

একটা বিষয় পরিষ্কার যে যত দিন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বজায় থাকবে, এই আঞ্চলিক জোট তত দিন কিছুতেই মসৃণভাবে এগোতে পারবে না। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে শুধু ভারতেরই নয়, সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সমস্যা রয়েছে। যেমন জঙ্গি ইস্যুতে ও সীমান্ত নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধ রয়েছে। কোনো জোটের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব থাকে, আস্থার সংকট থাকে, তাহলে সে জোট কখনো সাফল্যের মুখ দেখবে না। সার্কের মূলনীতিগুলোর একটি হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো এ সংস্থায় তোলা হবে না। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সার্কের এই নীতি সংস্থাটিকে এগোতে দেয়নি।

ভারত এখন আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য এ অঞ্চলের আরেকটি উপ-আঞ্চলিক জোট বিমসটেকের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, পাকিস্তান যার সদস্য নয়। ভারত ২০০১ সালে গঠন করা সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন প্রোগ্রামকে (সাসেক) চাঙা করতেও তৎপর হয়েছে। এর সদস্য হলো ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সংহতি গড়ে তুলে নিজের অবস্থান সংহত করতে চাইছে পাকিস্তান।

দুই বড় সদস্যদেশের কৌশলের মারপ্যাচে সার্ক এখন একটি মুমূর্ষু সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সার্ক যদি একটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশকে আজ এভাবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না।

সম্প্রতি ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসির সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানের সহযোগিতা চেয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন সত্ত্বেও এই অনুরোধকে আমরা ইতিবাচক বলেই মনে করি।

কিন্তু পাকিস্তান রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে কতখানি সহায়তা করবে, সে সন্দেহ থেকেই যায়। নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হয়েও ভারত যে এ সংকট সমাধানে খুব একটা কিছু করছে, তা নয়। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর মধ্যেই সীমিত রয়েছে এর সহযোগিতামূলক কার্যক্রম। এ কারণেই সার্কের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও সামনে আসছে।

গত বছর সার্কের শীর্ষ সম্মেলন না হলেও গত ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্ক এপিনেট ফোরামের বৈঠক। তবে এতে পাকিস্তান অংশ নেয়নি। চলতি অক্টোবর মাসের ৪ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্ক স্পিকার সম্মেলন ও সাংসদদের সম্মেলন। এতে অবশ্য পাকিস্তান যোগ দিয়েছে। সার্ক মহাসচিব নিয়োগ নিয়ে যে জটিলতা ছিল, তা এ বছর কেটেছে। গত মার্চে সার্কের নতুন মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে পাকিস্তানের কূটনীতিক আমজাদ হোসেন সিয়ালকে। এসব ছোটখাটো উদ্যোগ আমাদের মনে ক্ষীণ আশা জাগায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এই আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটবে কি না, সেটি নির্ভর করছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর।

রোকেয়া রহমান

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল

রোহিঙ্গা সমস্যা ও অকার্যকর সার্ক

আপডেট টাইম : ০৪:২৫:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কোনো আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের মূলত দুটি উদ্দেশ্য থাকে। পারস্পরিক সহায়তা এবং কোনো সদস্যদেশ বিপদে পড়লে অন্যান্য দেশের এগিয়ে আসা। এটি আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানের ক্ষেত্রে দেখেছি।

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ এখন গভীর সংকটে। কিন্তু এ ব্যাপারে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা—সার্কের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সার্কের নীতিমালায় দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিয়ে আলোচনার সুযোগ না থাকলেও কোনো সদস্যদেশ বিপদে পড়লে তাকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে যখন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম সোচ্চার, তখন এই ফোরামে আলোচনা না হওয়ার কারণ সার্কের অকার্যকরতা।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানের আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরিতে একটি ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত ওই সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এরপর সার্কের আরও চারটি দেশ বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান সম্মেলনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ সম্মেলনে না যাওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছিল, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। বাকিরা বলেছে, পাকিস্তান এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটাচ্ছে, যা সার্ক সনদের লঙ্ঘন, কাজেই যাব না সম্মেলনে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান তার দেশে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করে। সেই থেকে সার্কের কার্যক্রম প্রায় অচল।

অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ভারতের হিন্দু পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিমসটেকের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সার্ক হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা এবং তা আগের মতোই আছে। বঙ্গোপসাগরের চারপাশের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গঠিত বিমসটেকের আমিও একজন প্রতিষ্ঠাতা, যেহেতু ১৯৯৭ সালে আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। নরেন্দ্র মোদি সংস্থাটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং এ জন্য আমি তঁার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি একটি সংস্থাকে অপর একটি সংস্থার বিকল্প হিসেবে দেখি না।’

বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সার্কের প্রয়োজন রয়েছে। মিয়ানমারে এখন যা ঘটেছে, তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ। সার্কের সদস্যদেশগুলো যৌথভাবে এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত, যদি সার্ক কার্যকর থাকত।

 ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশনের (সার্ক) যাত্রা শুরুই হয়েছিল সদস্যদেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার দ্রুত উন্নয়ন এবং সদস্যদেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে। সার্কের সহযোগিতা কার্যক্রম হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি, খাদ্য, পরিবেশ, পর্যটন, আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস এবং মাদক, মানব পাচার, দমনসহ অনেক প্রটোকল ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। মুক্তবাজার সম্প্রসারণে ‘সাফটা’ চুক্তি হয়েছে। কিন্তু তারপরও সার্ক কার্যকর সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

সার্কের সনদ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা প্রতিবছর এক বা একাধিক শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হবেন। গত ৩২ বছরে ৩২টি শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ১৮টি। প্রথম তিন বছর ঠিকভাবে সম্মেলন হয়েছে। ১৯৮৯ সালে পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনী (আইপিকেএফ) পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ হয়েছে—এই অজুহাত তুলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে অস্বীকৃতি জানায় কলম্বো। পরের বছর ১৯৯০ সালে পঞ্চম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে। এরপর ১৯৯১ সালে ষষ্ঠ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়টা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ছিল তীব্র বৈরিতাপূর্ণ। কারগিল যুদ্ধ ও ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি সে সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে এক মঞ্চে উঠতে চাননি। যদিও ২০০২ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সময় এই দুই নেতার বিখ্যাত ‘করমর্দন’ পত্রপত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়েছিল। ২০০৪ সালে ইসলামাবাদে আয়োজিত সম্মেলনে বাজপেয়ি যোগ দেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় সার্কের ১৩তম সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করলে সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। সার্কের নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো একটি সদস্যরাষ্ট্র অংশ না নিলে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় না।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, সার্ক সম্মেলন স্থগিত হওয়ার পেছনে ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যখন সার্কে যোগ দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনুরোধ জানানো হয়, তখন এ নিয়ে দেশটির ভেতরে বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়। কারণ, পাকিস্তান নিজেকে পশ্চিম এশিয়ার এবং ইসলামি দেশ হিসেবে বিবেচনা করত, আরব বিশ্বের সঙ্গে যার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। পরে অবশ্য দেশটি সার্কে যোগ দিতে রাজি হয়। হয়তো পাকিস্তান মনে করেছিল, এই আঞ্চলিক জোটের মধ্য থেকে তারা এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা থেকে ভারতকে প্রতিহত করবে। আর সেটা যখন পারেনি, তখন তারা সার্কের বিভিন্ন কার্যক্রমে বাধা দিয়েছে।

সম্প্রতি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মোটরযান চলাচল চুক্তি করার প্রস্তাব যখন এল, তখন পাকিস্তান বলল, তারা এর মধ্যে নেই। পরে অবশ্য ভুটানও এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান সড়ক চুক্তি পাকিস্তানের বাগড়ায় হতে পারেনি। আবার সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে পাকিস্তান। এ ছাড়া সার্ক শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বরাবরই করে আসছে পাকিস্তান।

একটা বিষয় পরিষ্কার যে যত দিন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বজায় থাকবে, এই আঞ্চলিক জোট তত দিন কিছুতেই মসৃণভাবে এগোতে পারবে না। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে শুধু ভারতেরই নয়, সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সমস্যা রয়েছে। যেমন জঙ্গি ইস্যুতে ও সীমান্ত নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধ রয়েছে। কোনো জোটের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব থাকে, আস্থার সংকট থাকে, তাহলে সে জোট কখনো সাফল্যের মুখ দেখবে না। সার্কের মূলনীতিগুলোর একটি হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো এ সংস্থায় তোলা হবে না। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সার্কের এই নীতি সংস্থাটিকে এগোতে দেয়নি।

ভারত এখন আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য এ অঞ্চলের আরেকটি উপ-আঞ্চলিক জোট বিমসটেকের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, পাকিস্তান যার সদস্য নয়। ভারত ২০০১ সালে গঠন করা সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন প্রোগ্রামকে (সাসেক) চাঙা করতেও তৎপর হয়েছে। এর সদস্য হলো ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সংহতি গড়ে তুলে নিজের অবস্থান সংহত করতে চাইছে পাকিস্তান।

দুই বড় সদস্যদেশের কৌশলের মারপ্যাচে সার্ক এখন একটি মুমূর্ষু সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সার্ক যদি একটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশকে আজ এভাবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না।

সম্প্রতি ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসির সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানের সহযোগিতা চেয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন সত্ত্বেও এই অনুরোধকে আমরা ইতিবাচক বলেই মনে করি।

কিন্তু পাকিস্তান রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে কতখানি সহায়তা করবে, সে সন্দেহ থেকেই যায়। নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হয়েও ভারত যে এ সংকট সমাধানে খুব একটা কিছু করছে, তা নয়। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর মধ্যেই সীমিত রয়েছে এর সহযোগিতামূলক কার্যক্রম। এ কারণেই সার্কের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও সামনে আসছে।

গত বছর সার্কের শীর্ষ সম্মেলন না হলেও গত ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্ক এপিনেট ফোরামের বৈঠক। তবে এতে পাকিস্তান অংশ নেয়নি। চলতি অক্টোবর মাসের ৪ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্ক স্পিকার সম্মেলন ও সাংসদদের সম্মেলন। এতে অবশ্য পাকিস্তান যোগ দিয়েছে। সার্ক মহাসচিব নিয়োগ নিয়ে যে জটিলতা ছিল, তা এ বছর কেটেছে। গত মার্চে সার্কের নতুন মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে পাকিস্তানের কূটনীতিক আমজাদ হোসেন সিয়ালকে। এসব ছোটখাটো উদ্যোগ আমাদের মনে ক্ষীণ আশা জাগায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এই আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাটি কার্যকর সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটবে কি না, সেটি নির্ভর করছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর।

রোকেয়া রহমান