ঢাকা ০৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্ডারে দুর্নীতির কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আব্রাম না থাকলে তাকে আমার যোগ্য বলেও মনে করতাম না ওমরাহ শেষে গ্রামে ফিরে খেজুর-জমজমের পানি বিতরণ করল শিশু রিফাত বিদেশে প্রশিক্ষণে ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তি নয়, জুনিয়রদের অগ্রাধিকার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মতামত জরিপ জানুয়ারিতে বুয়েট শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে বিয়ের আগে পরস্পরকে যে প্রশ্নগুলো করা জরুরি

বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সব নাতি-পুতি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫৮:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৭
  • ৪১৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাবা-মা হিসেবে আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য থাকে, ছেলে-মেয়ে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়, পরিবার ও সমাজের মুখ উজ্জ্বল করে। অনেক বিত্তশালী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা বিপথে যায়, আবার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা এমন কিছু করে ফেলে, যা শুধু তাদের পরিবারেরই মুখ উজ্জ্বল করে না, পুরো সমাজেই ইতিবাচক আবহ তৈরি করে। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিবারগুলো অনেক ক্ষেত্রে সন্তানদের সঠিকভাবে পড়ালেখা করাতে পারে না। ছেলে-মেয়ে মানুষ হওয়ার বদলে দানব- দৈত্য হয়।

আবার অনেক রাজনৈতিক পরিবার আছে যাদের ছেলে-মেয়েদের সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শুধু নিজের ক্ষেত্রে নয়, পুরো একটি জাতিকে পূর্বসূরিদের মতো নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই একটি পরিবার বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর নাতি-নাতনিরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি একেকজন বিশাল জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করে চলেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষা অর্জন করতে হয়, তার যেন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধুর নাতি-নাতনিরা।

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে জাতিসংঘ অধিবেশনে উনার মিডিয়া কাভারেজ দেয়ার কাজে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল মিডিয়া টিমের সদস্য হিসেবে সেই প্রথম আমার মার্কিন মুল্লুকে গমন। এক ধরনের ঘোর, বিশেষ অনুভূতি আর উত্তেজনায় দেহ-মন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার মত দশা। ভাগ্যিস প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের মধ্যে আমার সাংবাদিকতার গুরু, আমাদের ইউএনবির চিফ অব করেসপনডেন্ট (সিওসি) শামীম আহমদ ছিলেন। শামীম ভাই কোন মানের সাংবাদিক, সেটা নিশ্চয় তাঁর সহকর্মী আর পরিচিতজনেরা জানেন। বারাক ওবামা একটা ডিনার পার্টিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর গ্লাসে নিজে জগ থেকে পানি ঢেলে সম্মান দেখিয়েছিলেন। শামীম ভাই তাঁর সোর্সের কাছ থেকে সে কথা জেনে একটা রিপোর্ট লিখেছিলেন যা ডেইলি স্টার স্কেচসহ প্রকাশ করেছিল।


যাই হোক, যে কদিন ছিলাম, তার একদিন সকাল ১০/১১ টার দিকে হবে। আমি, শামীম ভাই আর তৎকালীন একজন ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি নকীব উদ্দিন মান্নু ভাই জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সম্মেলন স্থলের বাইরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলাম। হঠাৎ দেখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন এসএসএফ এর ডিজি মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদিনকে সাথে নিয়ে হেঁটে আসছেন। মুহূর্তেই সামনে এসে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। আমার কম বয়স, প্রেস উইংয়ে কেবল জয়েন করেছি। কোনমতে সালাম দিয়ে সোজা রোবটের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম।

শামীম ভাই বললেন, ‘আপা স্লামালিকুম’। প্রধানমন্ত্রী শামীম ভাইকে বললেন, ‘গত মঙ্গলবার বিকেলে পুতুল (কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) একটা সেমিনারে অটিজম নিয়ে বক্তৃতা দিবে, এর উপর একটা স্টোরি করবা’। শামীম ভাই বললেন, ‘জী আপা’। মান্নু ভাইকে কিছু বললেন না। শামীম ভাইয়ের সাথে দু একটা কথা বলে শেখ হাসিনা চলে গেলেন।

যাইহোক,  প্রধানমন্ত্রীর কাভারেজ দেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সে সেমিনারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যায় ফিরে শামীম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করা যায় ?’। শামীম ভাই বললেন, ‘তুমি মান্নুর সাথে কথা বল, ও হল ডিপিএস’। আমি মান্নু ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম। মান্নু ভাই পরে আমার সাথে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এর এপয়েন্টমেন্ট করে দিলেন আর বললেন, সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক রিপোর্ট করতে। প্রশ্নগুলো টাইপ করে লিখে নিয়ে যেতে বললেন।

আমি পরের দিন সময়মত গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের স্যুইটে গেলাম। এসএসএফ এর লেডি অফিসার ভেতরে গিয়ে আমার কথা বললে আমাকে বৈঠকখানায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হল। একটু পর সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আসলেন। তিনি জানতে চাইলেন, প্রশ্নগুলো কাগজে টাইপ করে নিয়ে গিয়েছি কি না ? আমি উনার হাতে দিলাম। উনি দেখে বললেন, উত্তরগুলো লিখে উনি আমার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। আমি ‘জী আচ্ছা’ বলে সালাম দিয়ে চলে আসলাম। পরে উত্তরগুলো পেয়ে একটা স্টোরি করেছিলাম যা ডেইলিস্টারসহ অন্য অনেক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কোন নাতি বা নাতিনের সাথে সে আমার প্রথম সরাসরি যোগাযোগ।

বাংলাদেশেও তিনবার সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের কথা একদম সামনাসামনি শোনার সুযোগ হয়েছে। দুইবার গণভবনে, চ্যানেল আই আর ডেইলিস্টারের সাথে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আরেকবার ঢাকা সেনানিবাসে অটিস্টিক শিশুদের স্কুল প্রয়াসে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সফরে আমাকে ট্যাগ করে দেয়া হয়েছিল গণভবন থেকে।

শেখ হাসিনার মেয়ের অটিজম নিয়ে কাজ করার দরকার কি ? কিংবা আমাদের দুর্বল মগজে এও মনে হতে পারে, এত বড় ফ্যামিলির মেয়ে (পুতুলের জামাই বাড়িও শান-শওকত আর ঐতিহ্যে বেশ বড়) অন্য কিছু করতে পারতেন। কিছুই না করেও তো আরাম আয়েশে ঘুরে-ফিরে, শপিং করে , খানাপিনা করে বিলাসে গা ভাসিয়ে দিন গুজরান করতে পারতেন। আমাদের লোভী মন এমন ভাবতেই পারে। কিন্তু দেখেন অটিজম নিয়ে সারাদেশে কি এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন পুতুল। যার বাচ্চা অটিস্টিক, তিনি জানেন একজন পুতুল কি এক মহান কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। বাচ্চাদের মন ও মগজ নিয়ে কাজ করেন পুতুল। তিনি একজন বিশেষজ্ঞ চাইল্ড সাইকোলজিস্ট। বঙ্গবন্ধু প্রথম মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন। নানার আদর বঞ্চিত পুতুল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন অটিস্টিক বাবুদের প্রাণ ও মন বাঁচাবেন বলে। একদিন হয়তো সত্যিই আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়ব।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বড় ভাই, বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয় বোনের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি পরিচিত এবং আলোচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়ের জন্ম। নানা ভাই বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দী। সে কঠিন সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোল আলো করে জয়ের আগমন।

ছোট মামা শেখ রাসেলের সাথে জয়ের ছোটবেলার ছবি দেখলে খালি মনে হয়, রাসেল আজ বেঁচে থাকলে মামা-ভাগ্নের কত ঘটনা, ছবি আর কথার সাক্ষী আমরা হতাম। জয়কে কত কষ্ট আর ঝুঁকির মধ্যেও বড় করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন মা শেখ হাসিনা। ছেলে হয়ে জয় আজ প্রধানমন্ত্রী মায়ের আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা! একের পর এক প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানবীয় যোগাযোগের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছেন জয়। যোগাযোগকে তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ইতোমধ্যেই দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে সফলভাবে সক্ষম হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা, শেখ হাসিনার একমাত্র বোন শেখ রেহানাও দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে এমনই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন যে, কে কার চেয়ে বেশি যোগ্য সেটি নিয়ে বরং বিতর্ক হতে পারে। শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। বিদেশে পড়াশুনা করে কী সাবলীল ভাবেই না সুন্দর বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মিছিলে শরিক হয়ে গেছেন ! প্রাযুক্তিক ও রাজনৈতিক জ্ঞানের সম্মিলনে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এক প্রজন্ম তৈরিতে কাজ করছেন তিনি। আমাদের চেনা জগতের অজান্তেই তৈরি করছেন এমন এক জনশক্তি যারা ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিআরআই এর তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে বড় বড় গবেষণা কাজ করে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর দুই নাতিন টিউলিপ সিদ্দিক আর রুপন্তি সিদ্দিক (শেখ রেহানার দুই মেয়ে)। টিউলিপ সিদ্দিক তো নিজেই নিজের বিশেষ পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রিটেনের লেবার পার্টি থেকে দুইবারের নির্বাচিত এমপি হয়েছেন। যে অঞ্চল থেকে তিনি এমপি, সেখানকার একটু খবর নিলে অবাক হবেন। সেখানে নেটিভ ব্রিটিশদের বসবাস অনেক। নাক উঁচু ব্রিটিশদের জনসমর্থন নিয়ে, সাদা চামড়ার প্রতিদ্বন্দ্বীদের টানা দুইবার হারাতে কী পরিমাণ মেধাবী আর যোগ্য হতে হয়, সেটা একবার ভেবে দেখেছেন কি ?

বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার ছোট মেয়ে রুপন্তি সিদ্দিককে কাছ থেকে দেখার ও তাঁর কথা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল লন্ডনে। ২০১০ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে একবার এশিয়ান স্টুডেন্টদের এক সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অক্সফোর্ডে পড়তেন তখন রূপন্তি।

অথচ বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পুরোপুরি শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে প্রায় শতভাগ সফল হয়ে গিয়েছিল খুনিরা। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায়, আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁরা বেঁচেছিলেন বলেই নতুন করে বাঁচতে শিখেছে বাংলাদেশ।

পাকিস্তান আমলে ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েও বঙ্গবন্ধু যতটুকু পেরেছেন পরিবারকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এখানে পারিবারিক কাণ্ডারি হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের সাথে সামান্য সম্পর্ক বজায় রেখে চললে, গাড়ি-বাড়ি, বিলাসিতার অভাব হত না। কিন্তু দেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করেননি তাঁরা। যে জন্য আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন দেখে দেখে মেধাবী মানুষের কাছে। মেয়েরাও মেধাবী, জামাইরাও মেধাবী। মেধাবীরা মিলে জন্ম দিয়েছেন আরও মেধাবী সব ছেলে-মেয়েদের। এই মেধাবী, দেশদরদী, সৎ, নিষ্ঠাবান, সৃজনশীল পরিবারের সদস্যরা সোনার বাংলা নির্মাণে নিজেদের সব সামর্থ্য ব্যবহারে সফল হোক, এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল

বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সব নাতি-পুতি

আপডেট টাইম : ১২:৫৮:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাবা-মা হিসেবে আমাদের সকলেরই উদ্দেশ্য থাকে, ছেলে-মেয়ে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়, পরিবার ও সমাজের মুখ উজ্জ্বল করে। অনেক বিত্তশালী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা বিপথে যায়, আবার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা এমন কিছু করে ফেলে, যা শুধু তাদের পরিবারেরই মুখ উজ্জ্বল করে না, পুরো সমাজেই ইতিবাচক আবহ তৈরি করে। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিবারগুলো অনেক ক্ষেত্রে সন্তানদের সঠিকভাবে পড়ালেখা করাতে পারে না। ছেলে-মেয়ে মানুষ হওয়ার বদলে দানব- দৈত্য হয়।

আবার অনেক রাজনৈতিক পরিবার আছে যাদের ছেলে-মেয়েদের সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শুধু নিজের ক্ষেত্রে নয়, পুরো একটি জাতিকে পূর্বসূরিদের মতো নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই একটি পরিবার বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর নাতি-নাতনিরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি একেকজন বিশাল জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করে চলেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষা অর্জন করতে হয়, তার যেন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধুর নাতি-নাতনিরা।

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে জাতিসংঘ অধিবেশনে উনার মিডিয়া কাভারেজ দেয়ার কাজে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল মিডিয়া টিমের সদস্য হিসেবে সেই প্রথম আমার মার্কিন মুল্লুকে গমন। এক ধরনের ঘোর, বিশেষ অনুভূতি আর উত্তেজনায় দেহ-মন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার মত দশা। ভাগ্যিস প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের মধ্যে আমার সাংবাদিকতার গুরু, আমাদের ইউএনবির চিফ অব করেসপনডেন্ট (সিওসি) শামীম আহমদ ছিলেন। শামীম ভাই কোন মানের সাংবাদিক, সেটা নিশ্চয় তাঁর সহকর্মী আর পরিচিতজনেরা জানেন। বারাক ওবামা একটা ডিনার পার্টিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর গ্লাসে নিজে জগ থেকে পানি ঢেলে সম্মান দেখিয়েছিলেন। শামীম ভাই তাঁর সোর্সের কাছ থেকে সে কথা জেনে একটা রিপোর্ট লিখেছিলেন যা ডেইলি স্টার স্কেচসহ প্রকাশ করেছিল।


যাই হোক, যে কদিন ছিলাম, তার একদিন সকাল ১০/১১ টার দিকে হবে। আমি, শামীম ভাই আর তৎকালীন একজন ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি নকীব উদ্দিন মান্নু ভাই জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সম্মেলন স্থলের বাইরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলাম। হঠাৎ দেখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন এসএসএফ এর ডিজি মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদিনকে সাথে নিয়ে হেঁটে আসছেন। মুহূর্তেই সামনে এসে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। আমার কম বয়স, প্রেস উইংয়ে কেবল জয়েন করেছি। কোনমতে সালাম দিয়ে সোজা রোবটের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম।

শামীম ভাই বললেন, ‘আপা স্লামালিকুম’। প্রধানমন্ত্রী শামীম ভাইকে বললেন, ‘গত মঙ্গলবার বিকেলে পুতুল (কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) একটা সেমিনারে অটিজম নিয়ে বক্তৃতা দিবে, এর উপর একটা স্টোরি করবা’। শামীম ভাই বললেন, ‘জী আপা’। মান্নু ভাইকে কিছু বললেন না। শামীম ভাইয়ের সাথে দু একটা কথা বলে শেখ হাসিনা চলে গেলেন।

যাইহোক,  প্রধানমন্ত্রীর কাভারেজ দেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সে সেমিনারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যায় ফিরে শামীম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করা যায় ?’। শামীম ভাই বললেন, ‘তুমি মান্নুর সাথে কথা বল, ও হল ডিপিএস’। আমি মান্নু ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম। মান্নু ভাই পরে আমার সাথে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এর এপয়েন্টমেন্ট করে দিলেন আর বললেন, সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক রিপোর্ট করতে। প্রশ্নগুলো টাইপ করে লিখে নিয়ে যেতে বললেন।

আমি পরের দিন সময়মত গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের স্যুইটে গেলাম। এসএসএফ এর লেডি অফিসার ভেতরে গিয়ে আমার কথা বললে আমাকে বৈঠকখানায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হল। একটু পর সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আসলেন। তিনি জানতে চাইলেন, প্রশ্নগুলো কাগজে টাইপ করে নিয়ে গিয়েছি কি না ? আমি উনার হাতে দিলাম। উনি দেখে বললেন, উত্তরগুলো লিখে উনি আমার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। আমি ‘জী আচ্ছা’ বলে সালাম দিয়ে চলে আসলাম। পরে উত্তরগুলো পেয়ে একটা স্টোরি করেছিলাম যা ডেইলিস্টারসহ অন্য অনেক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর কোন নাতি বা নাতিনের সাথে সে আমার প্রথম সরাসরি যোগাযোগ।

বাংলাদেশেও তিনবার সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের কথা একদম সামনাসামনি শোনার সুযোগ হয়েছে। দুইবার গণভবনে, চ্যানেল আই আর ডেইলিস্টারের সাথে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আরেকবার ঢাকা সেনানিবাসে অটিস্টিক শিশুদের স্কুল প্রয়াসে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সফরে আমাকে ট্যাগ করে দেয়া হয়েছিল গণভবন থেকে।

শেখ হাসিনার মেয়ের অটিজম নিয়ে কাজ করার দরকার কি ? কিংবা আমাদের দুর্বল মগজে এও মনে হতে পারে, এত বড় ফ্যামিলির মেয়ে (পুতুলের জামাই বাড়িও শান-শওকত আর ঐতিহ্যে বেশ বড়) অন্য কিছু করতে পারতেন। কিছুই না করেও তো আরাম আয়েশে ঘুরে-ফিরে, শপিং করে , খানাপিনা করে বিলাসে গা ভাসিয়ে দিন গুজরান করতে পারতেন। আমাদের লোভী মন এমন ভাবতেই পারে। কিন্তু দেখেন অটিজম নিয়ে সারাদেশে কি এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন পুতুল। যার বাচ্চা অটিস্টিক, তিনি জানেন একজন পুতুল কি এক মহান কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। বাচ্চাদের মন ও মগজ নিয়ে কাজ করেন পুতুল। তিনি একজন বিশেষজ্ঞ চাইল্ড সাইকোলজিস্ট। বঙ্গবন্ধু প্রথম মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাষ্ট্র দিয়ে গেছেন। নানার আদর বঞ্চিত পুতুল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন অটিস্টিক বাবুদের প্রাণ ও মন বাঁচাবেন বলে। একদিন হয়তো সত্যিই আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়ব।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বড় ভাই, বঙ্গবন্ধুর নাতি সজীব ওয়াজেদ জয় বোনের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি পরিচিত এবং আলোচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়ের জন্ম। নানা ভাই বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দী। সে কঠিন সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোল আলো করে জয়ের আগমন।

ছোট মামা শেখ রাসেলের সাথে জয়ের ছোটবেলার ছবি দেখলে খালি মনে হয়, রাসেল আজ বেঁচে থাকলে মামা-ভাগ্নের কত ঘটনা, ছবি আর কথার সাক্ষী আমরা হতাম। জয়কে কত কষ্ট আর ঝুঁকির মধ্যেও বড় করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন মা শেখ হাসিনা। ছেলে হয়ে জয় আজ প্রধানমন্ত্রী মায়ের আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা! একের পর এক প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলাদেশের মানবীয় যোগাযোগের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছেন জয়। যোগাযোগকে তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ইতোমধ্যেই দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে সফলভাবে সক্ষম হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা, শেখ হাসিনার একমাত্র বোন শেখ রেহানাও দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে এমনই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন যে, কে কার চেয়ে বেশি যোগ্য সেটি নিয়ে বরং বিতর্ক হতে পারে। শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। বিদেশে পড়াশুনা করে কী সাবলীল ভাবেই না সুন্দর বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মিছিলে শরিক হয়ে গেছেন ! প্রাযুক্তিক ও রাজনৈতিক জ্ঞানের সম্মিলনে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এক প্রজন্ম তৈরিতে কাজ করছেন তিনি। আমাদের চেনা জগতের অজান্তেই তৈরি করছেন এমন এক জনশক্তি যারা ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিআরআই এর তত্ত্বাবধান করছেন তিনি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় নিয়ে বড় বড় গবেষণা কাজ করে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর দুই নাতিন টিউলিপ সিদ্দিক আর রুপন্তি সিদ্দিক (শেখ রেহানার দুই মেয়ে)। টিউলিপ সিদ্দিক তো নিজেই নিজের বিশেষ পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রিটেনের লেবার পার্টি থেকে দুইবারের নির্বাচিত এমপি হয়েছেন। যে অঞ্চল থেকে তিনি এমপি, সেখানকার একটু খবর নিলে অবাক হবেন। সেখানে নেটিভ ব্রিটিশদের বসবাস অনেক। নাক উঁচু ব্রিটিশদের জনসমর্থন নিয়ে, সাদা চামড়ার প্রতিদ্বন্দ্বীদের টানা দুইবার হারাতে কী পরিমাণ মেধাবী আর যোগ্য হতে হয়, সেটা একবার ভেবে দেখেছেন কি ?

বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার ছোট মেয়ে রুপন্তি সিদ্দিককে কাছ থেকে দেখার ও তাঁর কথা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল লন্ডনে। ২০১০ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে একবার এশিয়ান স্টুডেন্টদের এক সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অক্সফোর্ডে পড়তেন তখন রূপন্তি।

অথচ বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পুরোপুরি শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে প্রায় শতভাগ সফল হয়ে গিয়েছিল খুনিরা। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায়, আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁরা বেঁচেছিলেন বলেই নতুন করে বাঁচতে শিখেছে বাংলাদেশ।

পাকিস্তান আমলে ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েও বঙ্গবন্ধু যতটুকু পেরেছেন পরিবারকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এখানে পারিবারিক কাণ্ডারি হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের সাথে সামান্য সম্পর্ক বজায় রেখে চললে, গাড়ি-বাড়ি, বিলাসিতার অভাব হত না। কিন্তু দেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করেননি তাঁরা। যে জন্য আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন দেখে দেখে মেধাবী মানুষের কাছে। মেয়েরাও মেধাবী, জামাইরাও মেধাবী। মেধাবীরা মিলে জন্ম দিয়েছেন আরও মেধাবী সব ছেলে-মেয়েদের। এই মেধাবী, দেশদরদী, সৎ, নিষ্ঠাবান, সৃজনশীল পরিবারের সদস্যরা সোনার বাংলা নির্মাণে নিজেদের সব সামর্থ্য ব্যবহারে সফল হোক, এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়