হাওর বার্তা ডেস্কঃ ৭ নভেম্বর উপলক্ষে বিবিসির প্রতিনিধি আকবর হোসেন ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সে সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে তখন মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, যিনি পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটি লিফলেট তাঁর হাতে পৌঁছায়। সে লিফলেটে লেখা ছিল, ‘সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। এ থেকে আমি বুঝলাম, রাতে কিছু একটা হবেই হবে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমত, নিজেকে বেঁচে থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে।’
সে সময় কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তাঁর ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন, যিনি পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর রাত পর্যন্ত অসংখ্য সভা হয়েছে।…কর্নেল তাহের পরিকল্পনা করেছিলেন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সৈন্যরা অস্ত্র হাতে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে। তিনি সৈন্যদের বলেছিলেন, প্রত্যেকে কয়েকটি অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসবে। আর বাইরে অপেক্ষমাণ আমাদের শ্রমিক ও ছাত্ররা সশস্ত্র হবে। এভাবেই সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন কর্নেল তাহের।’
৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হলেও বেলা ১১টার দিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে তাঁর দুই সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারসহ হত্যা করা হয়।
খালেদ মোশাররফ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ একটি বইতে তুলে ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, যিনি পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। ‘৭ নভেম্বর রাত ১২টার পর ঢাকা সেনানিবাস থেকে যখন সিপাহি বিপ্লবের সূচনা হয়, তখন খালেদ মোশাররফ ও অন্যরা বঙ্গভবনেই ছিলেন। এসব সংবাদ শুনে খালেদ মোশাররফ কর্নেল হুদার মাধ্যমে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নওয়াজেশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নওয়াজেশের ইউনিটে তাদের আসার জন্য বলে। কিন্তু সেটা পরে রটে যায় যে তারা আরিচা হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে একটি বেসামরিক গাড়িতে যাওয়ার পথে আসাদ গেটের নিকট তাদের গাড়ি বিকল হয়ে পড়লে তারা নিকটস্থ একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাপড় বদলিয়ে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের দিকে হেঁটে অধিনায়কের অফিসে পৌঁছায়। ভোরের দিকে জিয়াউর রহমান খালেদ মোশাররফের অবস্থান জানার পর তার সঙ্গে কথা বলে এবং দুজনের মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে জিয়াউর রহমান নওয়াজেশকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেন। এ কথা মরহুম নওয়াজেশ নিজেই আমাকে বলেছিলেন। নওয়াজেশ সকালে তাদের জন্য নাশতার বন্দোবস্ত করে এবং তার বর্ণনা মতে এ সময় খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত স্বাভাবিক ও শান্ত ছিলেন। তবে কর্নেল হুদা ও হায়দার কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠলে খালেদ মোশাররফ তাদেরকে স্বাভাবিক সুরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলেন। ইতিমধ্যে সেনানিবাস থেকে কিছু বিপ্লবী সৈনিক ১০ ইস্ট বেঙ্গলের লাইনে এসে সেখানকার সৈনিকদের বিপ্লবের সপক্ষে উত্তেজিত করতে থাকে এবং খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীদের হস্তান্তরের জন্য অধিনায়কের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। নওয়াজেশ উত্তেজিত সৈনিকদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এর কিছুক্ষণ পরে কিছুসংখ্যক সৈনিক অধিনায়কের অফিসের দরজা একপ্রকার ভেঙে তিনজনকেই বাইরে মাঠে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে।’ (‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’)
১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক আদালতে যে বিচারের মাধ্যমে কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেই বিচারকে ২০১১ সালে উচ্চ আদালত অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের অপহৃত মর্যাদাও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এ রায়ের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরের কথিত সিপাহি বিপ্লব সৃষ্ট বিতর্কের অবসান হয়েছে বলা যাবে না।
আদালতের রায়ে সে সময়ে বিচারপ্রার্থীরা সন্তোষ প্রকাশ করলেও আরেক পক্ষ তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। স্বীকার করতে হবে, তাহেরের বিচার-প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ, সংক্ষিপ্ত এবং গোপন। তার চেয়েও বিচারে দুটি গুরুতর বিচ্যুতি ছিল। এক. ঘটনার সময় তাহের সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না। অতএব সামরিক বিধি তাঁর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। দুই. যে আইনে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন। ২১ জুলাই তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার পর ৩০ জুলাই আইনটি সংশোধন করা হয়। আমরা এ ধরনের প্রহসনমূলক বিচারের নিন্দা করি। সেই সঙ্গে এও মনে করি যে তাহেরের বিচারের সঙ্গে ৭ নভেম্বরের কথিত বিপ্লবের কোনো সম্পর্ক নেই।
আদালত তাহেরকে বিচার থেকে খালাস দিলেও ৭ নভেম্বরকে কিন্তু খালাস দেননি। কী ঘটেছিল সেদিন ? কারা ঘটিয়েছিলেন ? কর্নেল তাহের এবং জাসদের পক্ষ থেকে একে সিপাহি-জনতার বিপ্লব আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিএনপি পালন করে জাতীয় সংহতি দিবস। আজ তাহেরের অনুসারী ও জিয়ার অনুসারীরা যেমন মুখোমুখি, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর তাঁরা তা ছিলেন না। তথ্য-প্রমাণে দেখতে পাই, সেদিন সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি ঘটেছিল দুই পক্ষের অভিন্ন শত্রু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে।
কেন? তাঁরা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক। তাঁরা ছিলেন তাদের ভাষায় ‘সম্প্রসারণবাদী রুশ এবং আধিপত্যবাদী ভারতের’ মিত্র। ৭ নভেম্বরের নায়কেরা ১৫ আগস্টের ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বললেও অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেননি। কিন্তু সেই অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে যখন খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটালেন, তখনই আরেকটি বিপ্লবের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। অন্যদের সাক্ষ্য আমলে না নিয়ে দেখা যাক কর্নেল আবু তাহের নিজে এ সম্পর্কে কী বলেছেন। আমরা আদালতের দেওয়া তাঁর জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘ওই দিন (৩ নভেম্বর) বহু সেনাসদস্য, এনসিও এবং বেসিও আমার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে এলেন। তাঁরা আমাকে জানালেন, ভারত খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে এবং বাকশালের সমর্থকেরা আবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।’
এরপর তিনি বলছেন, ‘৩ নভেম্বরের পর জাতি কী ভয়ংকর ও নৈরাজ্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা কারোই অজানা নয়। আমাদের জাতীয় সম্মান ও সার্বভৌমত্ব কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সময় জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ভারত খালেদ মোশাররফকে মদদ দিচ্ছিল।’
৩ নভেম্বরের পর সেনানিবাসের ভেতরে ও বাইরে কেউ একটি গুলি ছুড়েছে, কিংবা কেউ কারও হাতে নিহত হয়েছে—এ দাবি কেউ করতে পারবেন না। তাহলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হলো কীভাবে ?
১৫ আগস্ট রশীদ-ফারুক চক্র সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও দেশে কোনো ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন না ৭ নভেম্বরের কুশীলবরা। তাঁদের সঙ্গে ফারুক-রশীদ চক্রের একেবারে যোগাযোগ ছিল না, তা-ও বলা যাবে না। কর্নেল রশীদের একজন প্রতিনিধি ফোনে মুজিব হত্যার খবর দিয়ে তাহেরকে বাংলাদেশ বেতার ভবনে যেতে বলেন। তাহেরের ভাষ্য: ‘আমি তখন রেডিও চালিয়ে দিয়ে জানতে পেলাম শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছেন। এ খবর শুনে আমি যথেষ্ট আঘাত পাই। আমার মনে হলো, এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।…১৭ আগস্ট পরিষ্কার হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এ ঘটনার নেপথ্য নায়ক।’ (অসমাপ্ত বিপ্লব, লরেন্স লিফশুলজ, ঢাকা, বাংলা ভাষান্তর)
অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘মোশতাক সরকার জনগণকে মুজিব সরকারের চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প উপহার দিতে পারেনি। পরিবর্তন হয়েছিল শুধু রুশ-ভারতের প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হয়ে দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে ঝুঁকে পড়েছিল। সত্যিকার অর্থে দেশ বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়েছিল।’ (সূত্র: ওই)
দেশ যখন বেসামরিক একনায়কতন্ত্রের কবলে ছিল, তখন সেই সরকারের পতন ঘটাতে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ডাক দিল তাহেরের দল। কিন্তু সামরিক একনায়কতন্ত্রের আমলে কিছুই করলেন না, কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন এবং পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষা করলেন। তারা সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চললেন। তাঁকে পরামর্শ দিলেন খালেদ মোশাররফকে কোনো দায়িত্ব না দেওয়ার। (সূত্র: ওই)
মুজিব হত্যায় কর্নেল তাহের ও জাসদের কী ভূমিকা ছিল, তা আজও রহস্যাবৃত। এ ব্যাপারে মার্কিন সাংবাদিক ও তাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু লরেন্স লিফশুলজ লিখেছেন, ‘মুজিব উৎখাতের কয়েক মাস আগে থেকে জাসদ এক গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সাবেক সৈনিক সমবায়ে গঠিত বিপ্লবী গণবাহিনী ও কার্যরত সৈনিকদের গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা-জাসদের এই দুই সশস্ত্র শাখা নিয়ে গোপন সামরিক অধিনায়ক তাহেরের নেতৃত্বে এই প্রস্তুতি চলছিল।’ (অসমাপ্ত বিপ্লবী, লিফশুলজ, পৃষ্ঠা ১৯, বাংলা সংস্করণ)
জনগণকে বাদ দিয়ে সেনানিবাসকেন্দ্রিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির দ্বিতীয় নজির পৃথিবীতে নেই, সামরিক অভ্যুত্থানের অসংখ্য নজির আছে। বাংলাদেশেও পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর একটি প্রাণঘাতী সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, কোনো বিপ্লব নয়। কর্নেল তাহের খালেদ মোশাররফকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করলেও খন্দকার মোশতাকের নিয়োগপ্রাপ্ত বিমানবাহিনী প্রধান এম জি তোয়াবের ব্যাপারে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার পর তিনি ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন, তাতে অন্যদের মধ্যে এম জি তাওয়াব ও মাহবুব আলম চাষীও ছিলেন।
এর আগে ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর প্রতিদিন রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী নেতাদের সঙ্গে তাহেরের বৈঠক হতো। এসব বৈঠকে খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, দলমত-নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তিদান, রাজনীতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়।
লক্ষ করুন, জাসদ ও তাহের গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করতে চেয়েছেন বাকশালকে বাদ দিয়ে। বাকশাল মানে সাবেক আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি। এই সংগঠনগুলো তখনো দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করত। তাদের জনসমর্থন ছিল। কিন্তু তাহের ও তাঁর অনুসারীদের কাছে তারা জাতীয় শত্রু, এমনকি মোশতাক-ফারুক-রশীদ চক্রের চেয়ে বিপজ্জনক।
এর মধ্যে ২ নভেম্বর রাতে জেলখানায় যে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে হত্যা করা হলো, সে সম্পর্কে তাহের ও জাসদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কিত একটি উদ্দেশ্যমূলক খবর সেনানিবাসের পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ করতে সাহায্য করে। বিবিসি সংবাদদাতা আতিকুল আলম দাবি করেন যে জেলখানা থেকে তিনি (তাজউদ্দীন আহমদ) ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চেয়ে যে চিঠি দিয়েছেন, সেই চিঠির কপি তিনি দেখেছেন। পরবর্তীকালে তিনি সেই চিঠি আতিকুল আলম দেখাতে পারেননি। সেই গোলমেলে পরিস্থিতিতে এ ধরনের উড়ো খবর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় খালেদ মোশাররফকে জীবন দিতে হয়েছে প্রতিপক্ষের হাতে। তাঁকে রুশ-ভারতের দালাল ও ক্রীড়নক হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়েছিল, এরই বা কী যুক্তি ছিল ?
৭ নভেম্বরের ঘটনাকে সিপাহি-জনতার বিপ্লব বলে দাবি করেছেন কর্নেল তাহের, তাঁর সমর্থকেরা। পঁচাত্তরে জিয়াউর রহমানেরও দাবি ছিল অভিন্ন। তাহলে বিপ্লবটা গেল কোথায় ? জিয়াউর রহমান বুর্জোয়া সামরিক-ব্যবস্থার প্রতিনিধি। তাহের গণবাহিনীর প্রবক্তা। একজন সর্বহারা রাজ আরেকজন বুর্জোয়া-ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছেন। তারপরও এই দুই শক্তির সম্মিলন ঘটল কীভাবে? সম্মিলন ঘটার অভিন্ন লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে আওয়ামী বাকশালীদের তাড়ানো। এই আওয়ামী বাকশালীদের যে অংশ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কাতারবন্দী হয়েছে, তাদের ব্যাপারে ৭ নভেম্বরের কুশীলবদের তেমন আপত্তি নেই—আপত্তি হলো যাঁরা সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, যাঁরা সংবিধান ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আদালত বলেছেন, এই সময় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। সঠিক ইতিহাস ও সত্যের খাতিরে এ বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটি খতিয়ে দেখতেই পূর্ণাঙ্গ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে তা যাচাই করতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হোক। আদালতের এ রায় শিরোধার্য। কিন্তু গত ছয় বছরেও কোনো কমিটি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
জিয়াউর রহমানকে হত্যার অপরাধে ১৩ জন সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি হয়েছে। তাহেরের গোপন বিচারকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করে তাঁর মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু খালেদ মোশাররফের হত্যার বিচার হবে না কেন ? তাঁর ঘাতকেরা কেন বিচারের বাইরে থাকবে ? বিচার না হওয়া মানে হত্যাকে বৈধতা দেওয়া। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো ২১ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকেও বৈধতা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরকে সেনা কর্মকর্তা হত্যা দিবস হিসেবে মামলা করে। কিন্তু তারা সেই হত্যার কুশীলবদের বিচারের মুখোমুখি করছে না। ইতিহাসের দায়বদ্ধতা ও সত্যানুসন্ধানের জন্যও সেটি অত্যন্ত জরুরি।
খালেদ মোশাররফ কখনই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ছয় মেজরের বাড়াবাড়ি রোধ এবং সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে রুশ-ভারত দূরের কথা, দেশেরও কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অনেকের মনে থাকার কথা, খালেদ মোশাররফ যে তিন দিন ক্ষমতায় ছিলেন, ছায়াসঙ্গীর মতো ছিলেন সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান ও শাহাদত চৌধুরী। তাঁরা কেউ ভারত বা রুশপন্থী ছিলেন না।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন কর্নেল শাফায়েত জামিল। এর আগে শাফায়েত জামিল জিয়ার কাছেও চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি রাজি হননি। খালেদ মোশাররফ রাজি হয়েছিলেন। শাফয়েত জামিলের সাক্ষ্য: ‘৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা, ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার, সংবিধানবহির্ভূত অবৈধ সরকারের অবসান এবং একজন নিরপেক্ষ সৈনিকের অধীনে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা।’
৬ নভেম্বরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাসভবনে যাওয়া যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছি, তখন ব্রিগেড মেজর হাফিজ আমাকে বলল, স্যার, একটা জরুরি কথা আছে। হাফিজ জানাল, একজন প্রবীণ জেসিও বলেছে, ওই দিন রাত ১২টায় সিপাহিরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ ও সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটা করবে। খালেদ ও আমাকে মেরে ফেলার নির্দেশও সৈনিকদের দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জিওসিটি।’ [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর]
এরপরও খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের জীবন দিতে হয়েছে রুশ-ভারতের দালাল হিসেবে। এর কারণ দেশপ্রেমের সোল এজেন্সি নিয়ে ৭ নভেম্বরের কুশীলবেরা ভেবেছেন, যাঁরা তাঁদের সঙ্গে নেই, তাঁরাই দেশ ও জনগণের শত্রু। দুর্ভাগ্য যে এই শত্রুতত্ত্ব শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকেই। তখন যাঁরাই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করতেন, তাঁদের স্বাধীনতাবিরোধী, গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। আবার পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায়ের পর আওয়ামীবিরোধীরা একই রাজনৈতিক অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। গণতন্ত্রকে সঠিক পথে ও সবার জন্য চলতে দিতে হলে ইতিহাসের দুর্ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।
সোহরাব হাসান