হাওর বার্তা ডেস্কঃ নারীরা এক সময় উপেক্ষিত ছিলেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ধরে নেওয়া হতো, তাঁরা অন্তঃপুরবাসিনী হবেন। করবেন ঘরসংসারের কাজ। আর বাইরের জগতের লড়াই শুধু পুরুষের জন্য। সে ক্ষেত্রেও নারীরা অনুপ্রেরণার উৎস বলে বিবেচিত হতেন স্বজনদের কাছে। এ প্রসঙ্গে কবি নজরুল ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন, তাঁর চক্ষে পুরুষ-রমণীতে কোনো ভেদাভেদ নেই। তিনি আরও লিখলেন: ‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’
আর এই কবিতা শেষ করলেন তিনি এটা লিখে: ‘সেদিন সুদূর নয়—যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয় !’
সে চিত্রই তো আমাদের সামনে। তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দায়িত্বপূর্ণ কাজে আসছেন নারীরা। আর সেই কাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন যোগ্যতার সঙ্গে। পাশাপাশি সামাল দিচ্ছেন নিজের সংসারজীবন। এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে নজর কাড়ছেন বেশ কিছু নারী। শুধু স্থানীয় পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমেও।
এমন একটা চিত্র দেখা গেল ঢাকার একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকে অতি গুরুত্ব দিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে। দেশের হাওরবেষ্টিত একটি জেলা কিশোরগঞ্জ। আয়তনও বিশাল। উপজেলার সংখ্যা ১৩টি। কোনো কোনোটি তো ভাসছে হাওরেই। এই উপজেলাগুলোর মাঝে ৮টির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নারী। এখানে তাঁদের কর্মকালও কারও দুই বছরাধিক, আবার কারও কয়েক মাস। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে এককালে নারীদের প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হতো না। ১৯৮৩ সালে ভাঙে সেই অচলায়তন। তাঁরাও প্রতিযোগিতা করে ক্রমান্বয়ে আসছেন এ ক্যাডারে। কেউ সচিবও হয়েছেন। জেলা প্রশাসক হয়েছেন বেশ কিছু। আর ইউএনও তো এখন অনেক। প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তরে তাঁরা সরকারকে সামগ্রিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন। যেমনটা এর ওপরের স্তর, জেলায় জেলা প্রশাসক। সুতরাং পদটিতে মর্যাদার পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে গুরুদায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে সাড়া দিতে হয় দিবারাত্রির যেকোনো সময়। এমনকি ছুটির দিনেও। প্রতিবেদনটিতে তাঁদের, স্থানীয় কিছু লোক এবং জনপ্রতিনিধি অনেকের মতামত ছাপা হয়েছে। জেনে ভালো লাগল, এসব ইউএনওর ভালো লাগছে কাজ করতে। জনপ্রতিনিধিরা প্রশংসা করলেন তাঁদের। ধরে নিতে হয়, সবাই এক রকম কাজ করছেন না। আর তা হওয়ার কথাও নয়। তবে তাঁরা এই বৈরী প্রকৃতির জেলাটির প্রত্যন্ত উপজেলায় থেকেও ভালোবেসে ফেলেছেন স্থানীয় মানুষদের। তারাও ভালোবাসছে এই কর্মকর্তাদের। ব্যাপারটা কিন্তু খুব সহজসাধ্য নয়। নিশ্চয়ই তাঁদের বেশ কয়েকজনের কিছু ব্যতিক্রমী ইতিবাচক উদ্যোগের সুফল ভোগ করছে জনগণ।
দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতিটি অঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বহুবিধ অভিযোগ আসে গণমাধ্যমে। নাগরিক পরিষেবা পেতে মানুষের ভোগান্তি জেনে ও দেখে মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে পড়ি। আবার কোনো সাড়া জাগানো ভালো কাজের খবরে পুলকিত হই। কিশোরগঞ্জে ৮ জন নারী ইউএনওর দায়িত্ব পালনকে ইংরেজি দৈনিকটি শিরোনাম দিয়েছে, ‘মহিলারা কিশোরগঞ্জ হাওরের হাল ধরেছেন’। উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। এই প্রশংসা শুধু মেয়ে বলেই কি ? খবরটি বিস্তারিত পড়ে এবং আরও তথ্য নিয়ে জানলাম, সত্যিই তাঁরা আঁধারের রাতে আলো হাতে চলা যাত্রী। এ দেশে সরকারি চাকরি ঠিক রাখতে প্রতিবেদন পাঠিয়ে আর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। তাই করেন অনেকে। জনগণের সঙ্গে সবার থাকে না তেমন সম্পর্ক। নিজের অবস্থান ও মর্যাদা বজায় রেখেও মেলামেশা করা যায় সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে। হওয়া যায় তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার। আর প্রচেষ্টা নেওয়া চলে পরিস্থিতির অনুকূল পরিবর্তনের জন্য। এরূপ আগে কেউ কোথাও করেনি এমন নয় অবশ্যই। অনেক স্থানে অনেক ভালো কাজ করছেন কর্মকর্তারা। তবে একই জেলায় একই সময়ে ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন নারী ইউএনওর পদায়ন, তাঁদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য আর জনগণের সঙ্গে নৈকট্য ও প্রশংসা অর্জনের বিষয়টি বিরল।
এখানে অন্তত কয়েকজনের কিছু কার্যক্রম আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক। ভৈরবের ইউএনও দিলরুবা আহমেদ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন এবারে হাওরের বন্যায় সব ধ্বংসের মুখে তাঁর উপজেলার একমাত্র হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধটি রক্ষা করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষমাহীন নির্লিপ্ততার মুখে তিনি নালিশ করেই বসে থাকেননি; স্থানীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটি নির্ধারিত উচ্চতায় নিয়ে জোরদার করেছেন। ৩টি ইউনিয়নের ২০ হাজার লোকের জমি আছে এই হাওরে। এই দুর্গম স্থানে উপস্থিত ছিলেন নিজে। রক্ষা পেয়েছে ফসল। এ ছাড়া তিনি গ্রাম পুলিশের শূন্য পদগুলো পূরণ করে তাঁদের সাইকেল ও মোবাইল ফোন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। বাল্যবিবাহসহ কোনো অপরাধ সংগঠন বা প্রচেষ্টার কথা জেনে যান ত্বরিত। তিনি সবার নজর কেড়েছেন।
কুলিয়ারচরের ইউএনও ঊর্মি বিনতে সালাম প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে বহুমুখী প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে শ্রেষ্ঠ ইউএনওর সম্মাননা লাভ করেছেন এ বছর। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের তথ্যপ্রযুক্তি হাতে–কলমে শেখার জন্য নিয়েছেন ব্যবস্থা। অধিকতর মেধাবী ৩০০ ছাত্রছাত্রীকে দিয়েছেন বাইসাইকেল। এরপর আসে মিঠামইনের ইউএনও তসলিমা আহমেদ পলির কথা। মহামান্য রাষ্ট্রপতির গ্রামের বাড়ি এখানে। বর্ষায় উপজেলার অভ্যন্তরেও চলতে হয় জলযানে। আর শুষ্ক মৌসুমে রিকশাজাতীয় বাহন। কিন্তু বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে পথঘাট থাকে কর্দমাক্ত। প্রকৃতির এই বৈরিতাও ইউএনওকে দমাতে পারে না। তিনি তখনো ছোটেন।
তাড়াইলের ইউএনও সুলতানা আক্তারের জন্ম ঢাকায়। পড়ালেখা বিলেতে। নারী-পুরুষনির্বিশেষে এই উপজেলার মানুষ সংকটে পড়লেই শরণাপন্ন হন তাঁর। তিনিও সমাধান দিতে সচেষ্ট থাকেন। এই বিশ্বাস ও ভালোবাসায় অভিভূত তিনি। এটা বিরল মর্যাদা। পাকুন্দিয়ার ইউএনও অন্নপূর্ণা দেবনাথ ১৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ইতিমধ্যে ১০০টিতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করছেন। বাকিগুলোও ডিসেম্বরের মধ্যে হবে বলে আশাবাদী। এ জন্য কিন্তু সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। জোড়াতালি দিয়েই নিয়েছেন এই সাহসী উদ্যোগ। স্থানীয় বিত্তশালী জনগণকে ক্রমবর্ধমান হারে সংশ্লিষ্ট করতে সচেষ্ট রয়েছেন। একজন অভাবগ্রস্ত বর্গাচাষির মেয়ের মেডিকেল কলেজে ভর্তির টাকার সংস্থান করেন ইউএনও। বাকি তিনজন বাজিতপুরের সোহানা নাসরিন, করিমগঞ্জের মাহমুদা এবং কটিয়াদির ইসরাত জাহান কেয়ার কর্মকাল এখানে অল্প দিন। আশা করা যায়, তাঁরা পূর্বসূরিদের পথ ধরেই স্বীয় কীর্তির ছাপ রাখবেন।
মেয়েরা যখন চাকরিতে, তখন ঘরের কাজে কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়ে বলে ধারণা রয়েছে। এটা একেবারে অমূলক নয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাঁদের কারও স্বামী সেই কর্মস্থলে থাকেন না। কেউ কাছাকাছি আর কেউ দূরের কোনো কর্মক্ষেত্রে। তবে জননী হিসেবে সন্তান তাঁদের কাছে। একজনের তো শ্বশুর-শাশুড়িও থাকছেন তাঁর সঙ্গে। তবে সবাই ভালোবেসে ফেলেছেন হাওর আর হাওরবাসীকে। আর এই ভালোবাসা পারস্পরিক। এই ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিদীপ্ত ইউএনওদের কাজকর্মে চমৎকৃত সবাই। গণমাধ্যম বিষয়টি সামনে নিয়ে আসায় অন্যরা উদ্বুদ্ধ হতে পারেন এমনটা করতে। প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তরে ইউএনও পদটির দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা অনেক। তবে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা, উন্নয়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সব কাজই করতে হয় তাঁদের।
উপজেলায় অন্য অনেক কর্মকর্তার প্রায়ই অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দুর্গম হাওরাঞ্চলে এই প্রবণতা অনেক বেশি। তবে এর সুযোগ নেই ইউএনও এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার। অবশ্য এই মহিলা ইউনিএনওদের সাফল্যের পেছনে অবদান রয়েছে তাঁদের তদারককারী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের। তাঁদের নির্দেশনা, পরামর্শ ও প্রেরণা সুফল দিয়েছে। এ ইউএনওরা যেসব উপজেলায় কাজ করছেন, সেখানকার অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তা ও নিজ অফিসের কর্মচারীদের সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এগুলো তাঁরাই বলেছেন। তবে বড় কৃতিত্ব সেখানকার সাধারণ মানুষের, যাঁরা আস্থা রাখছেন তাঁদের ইউএনও ওপর। এটাই কর্মকর্তাদের মনোবলের উৎস। যথোচিত প্রশংসা আরও ভালো কাজে উদ্যমী করে তাঁদের। অন্যদিকে বাড়ায় দায়বদ্ধতা। বড় কথা, তাঁরা তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদের মতোই কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উন্নীত হয়েছেন এই পদে। প্রত্যাশা রইল, বৃহত্তর পরিসরেও ভবিষ্যতে তাঁরা এই ধারা অব্যাহত রাখবেন। পুরুষের সঙ্গে নারীদের জয়গান আরও জোরালো করতে থাকবেন সচেষ্ট।
আলী ইমাম মজুমদার