ঢাকা ১২:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোরগঞ্জ হয়বতনগরের ‘শেষ জমিদার’ বাড়ি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৪৬:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ নভেম্বর ২০১৭
  • ৪০২ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নিভে গেছে রঙিন আলো। ঝাড়বাতি আর ঝালরের বাহারও নেই। কোথাও বাজে না পাখোয়াজ। শোনা যায় না নূপুরের নিক্কণ। বিরাণ প্রান্তরের কোণে একখণ্ড অতীতকে বুকে চেপে নিথর দাঁড়িয়ে রয়েছে হয়বতনগরের জীর্ণ জমিদার মহলের স্মৃতির আঙিনা।

খানিক আগেই হয়বতনগরের পূর্ব সীমার সুপারি ও নারকেল বীথির মাথায় কুয়াশা-মাখা আকাশে উঁকি দিয়েছে অলৌকিক ভোর বেলা। দিন শুরুর মায়াবী প্রথম আলোর স্বর্ণালী আভায় একটু একটু করে জেগেছে কিশোরগঞ্জ শহর। কিন্তু শহরের প্রান্তিক ও প্রাচীন জনপদ হয়বতনগর জেগে ওঠেনি সানাই ও নহবতের সুরে। প্রায়-হানাবাড়ির মতো স্তব্ধ চারপাশ। অতীত এখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে লয়-প্রাপ্ত বাস্তবতায়।

গত (২ নভেম্বর) সকালে আমরা এসেছি মূল কিশোরগঞ্জ শহর থেকে শুকনো নরসুন্দা নদী আর গুরুদয়াল কলেজ পেরিয়ে দক্ষিণপশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তের প্রায়-বিচ্ছিন্ন হয়বতনগর পরগণায়। গ্রাম আর শহরের মিশেলে হয়বতনগরে প্রবেশের মুখে একটি ছোট্ট বাজারের মতো তিন রাস্তার মোড় থেকে তাকালে অদূরের কংকালসার হাভেলি এবং প্রাচীন জমিদার মহলের ক্ষয়িষ্ণু বাড়ি-ঘরগুলোর স্মৃতিচিত্র মানসপটে ভেসে আসে।

বর্তমানের পরিবর্তনের নিচে চাপা পড়া ঐতিহ্য টের পাওয়া যায়।

এই মোড় থেকে আরও এগিয়ে গেলে শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার নানা পথ। ঢাকা-ময়মনসিংহ বাইপাস হয়ে পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, ভৈরব কিংবা উত্তরবঙ্গ, সিলেট বা চট্টগ্রামের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলো ওদিকেই।

মাঝখানের স্তব্ধ জনপদ হয়বতনগর।

কিশোরগঞ্জ শহরটিও বড় অদ্ভুত। সব পথ উত্তর, পশ্চিম আর দক্ষিণে প্রসারিত। পূর্ব দিকের রাস্তাগুলো মূলত হাওরাঞ্চলমুখী। নৌ চলাচলের ভালো ব্যবস্থা করা হলে নদী পথেও এখান থেকে বৃহত্তর সিলেট বা দক্ষিণবঙ্গে সহজেই যাতায়াত করা যেতো। এখন সবই সড়ক আর রেলমুখী যাত্রাপথ। নদী মার্তৃক বাংলাদেশের নৌ পথগুলো বলতে গেলে লুপ্তই হয়ে যাচ্ছে।

‘আপনেরা কই যাইবাইন’, হয়বতনগরের মোড়ে আমাদের অপেক্ষায় দেখে প্রশ্ন করেন এক বয়সী স্থানীয় মানুষ। ততক্ষণে মোড়ের কাঁচা দোকানগুলো খোলার আয়োজন করছে। একটি চা স্টলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিই, ‘হয়বতনগর জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছি।’ বয়স্ক লোকটিও আমাদের সঙ্গে চা স্টলে এসে বসেন, ‘এখন আর কি দেখবাইন, আগের দিন আর নাই।’ তার কণ্ঠে হতাশা। জানা গেল, অনাদার ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে অনেক কিছু। বাড়ির লোকজনও বিশেষ কেউ নেই। ঢাকা বা বিদেশে চলে গেছেন প্রায়-সকলেই। অনেক কিছুই ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিক্রি করে দেওয়ায় আধুনিক ঘর-বাড়ি বানানোর তৎপরতাও চলছে। পরিবর্তনের তোড়ে হয়বতনগর এখন প্রাচীনত্বের স্থলে নবসৃষ্টির আগ্রাসী দাপটের অধীন।

খালি স্টলের চা দোকানিও এতো সকালে অচেনা মানুষদের দেখে উৎসাহী হয়ে বললেন, ‘আমরার জমিদার সাব বাড়িত আছুন। তাইনের লগে দেহা করুইন।’ আমি অবাক গলায় বলি, ‘জমিদার! এখন তো জমিদারির দিন নেই ?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে জানলাম, জমিদার বাড়ির কর্তাকে তারা সম্মান করে ‘জমিদার সাব’ নামে ডাকেন। তিনি কোনও পদবি ও জায়গীর পাওয়া জমিদার নন, জমিদারির ঐতিহ্যের শেষ প্রতিনিধি হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে শ্রদ্ধার মানুষ।

ষাট-ছোঁয়া বয়সের ‘জমিদার সাব’-এর পোশাকি নাম সৈয়দ রেজওয়ানউল্লাহ বাসার। আমাদের সাদরে তার বাড়ির বৈঠক খানায় বসালেন। ঘর ভর্তি বই। ভদ্রলোক পড়ুয়া। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর পুরো মহল ঘুরিয়ে দেখালেন।

যদিও নামে মহল, আসলে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বাহির আর অন্দর মহলের নানা স্মৃতির কথা জানতে পারলাম। ফারসি শিলালিপিসহ একটি প্রাচীন মসজিদ আর পাশেই অতি পুরনো একটি কবরগাহ। পুরনো ইটে বাঁধানো অনেক প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র দেখা গেলো, যাতে উৎকীর্ণ রয়েছে ফরাসি লিপিতে রচিত নানা বিবরণ। দেখতে দেখতে জানতে পারলাম, যা ছিল, তার অনেক কিছুই এখন আর নেই।

তবুও হয়বতনগরের একদার জমিদার বাড়িকে লোকজন সাধারণ ভাষায় ‘সাহেব বাড়ি’ নামে ডাকে। বাড়ির দু’টি হিস্যা। একটি ‘দেওয়ান বাড়ি’, আরেকটি সৈয়দ বাড়ি।

‘দেওয়ান বাড়ি’ মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁর বংশধর। তাদের আত্মীয়তা রয়েছে জঙ্গলবাড়ি, এগারসিন্দুর, সোনার গাঁ ইত্যাদি স্থানে বসবাসরত ঈসা খাঁ ও তাঁর পুত্র মুসা খাঁর অধঃস্থন বংশধরদের সঙ্গে।

‘সৈয়দ বাড়ি’ মূলত বৈবাহিক সূত্রে প্রাসাদের বাসিন্দা ও অংশীদার। তাঁদের পূর্বপুরুষগণ হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গীদের একজন, যার নাম সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালার। সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও সরাইল অঞ্চলে তাঁদের আত্মীয়তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে। জানা গেল, ঢাকার শাইনপুকুরের সালমান এফ রহমান পরিবারের মাতুল বংশ কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সৈয়দ বাসার সাহেব তাঁদের বংশ লতিকা ও পূর্বপুরুষদের তথ্য সম্বলিত কিছু পুস্তিকা উপহার দিলেন। পুরনো আমলের তৈষজপত্র ও ব্যবহায্য দ্রবাদির অবশিষ্ট কিছু অংশ দেখালেন। বললেন, ‘অনেক কিছুই নানা শরিকের কাছে আছে। অধিকাংশই লুট বা চুরি হয়ে গেছে। জায়গা-জমিও বিক্রি হয়ে গেছে ।’ জানা গেল, বাড়ির বিভিন্ন অংশের বাসিন্দাদের প্রায়-সকলেই ব্যবসা ও চাকরি উপলক্ষ্যে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে গেছেন।

কিশোরগঞ্জে স্থায়ী বলতে তিনি ছাড়া অল্প কয়েকজনই আছেন। ‘তবে বছরে দুই-বছরে ঈদ বা কোনও উপলক্ষ্যে সকলেই হয়বতনগর আসেন। তখন লোক সমাগম ও নানা আয়োজনে জমজমাট হয়ে ওঠে পুরো হাভেলি’, বললেন তিনি।

জানতে চেয়েছিলাম, কিভাবে দিন কাটে প্রাচীন জমিদার প্রথার এই শেষ ও প্রতীকী প্রতিনিধির? সৈয়দ বাসার সাহেব বললেন, ‘আমাদের দেওয়ান ও সৈয়দ বাড়ির পূর্বপুরুষগণ রাস্তাঘাট, মসজিদ, ঈদগাহ, লাইব্রেরি ইত্যাদি স্থাপন করে বৃহত্তর কিশোরগঞ্জকে আলোকিত করেছিলেন। আমরা সে সবের খোঁজ-খবর রাখি।

কিশোরগঞ্জের শিল্প-সাহিত্য- শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক সকল কাজেই আমরা ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করি। পড়াশোনা করে আর সামান্য কিছু এস্টেটের তদারকি করেই আমার দিন কাটে। এখনো যা সহায়-সম্পতি রয়েছে, তা চলার জন্য যথেষ্ট।’

ফিরে আসার পথে দেখা হলো স্থানীয় হাসমতউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মওলানা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে।

তিনি জানালেন, ‘সাহেব বাড়ির লোকজন প্রতিবেশী হিসাবে খুবই উপকারী। এখনো এলাকার মানুষের সুখ- দুঃখের খবর নেন। সাহায্য করেন। তাঁরা অত্যন্ত শরিফ ও সম্ভ্রান্ত মানুষ। আগের আর্থিক জৌলুস না থাকলেও তাঁরা ঐতিহ্যগত দিক থেকে কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের গৌরবময় অংশ।’

পালাবদলের পৃথিবীতে সামাজিক কাঠামোর নানা অদল-বদল এবং উত্থান-পতনের হাত ধরে একদার হাতি-
ঘোড়া সজ্জিত প্রাসাদ বিরাণ হয়ে গেছে। আবার বিরাণ জনপদ আলো ঝলমল হয়েছে। কালের গর্ভে বিলীন সেইসব কথা ও কাহিনি ইতিহাসের প্রাচীন-ধুসর পাতায় কিংবা লোকশ্রুতিতে এখনো চকচক করে। আজকের বদলে যাওয়া হয়বতনগরের দিকে পেছন ফিরে তাকালে টের পাওয়া যায় সমৃদ্ধ অতীতের স্মৃতিমেদুর দ্যুতিময় ঝলক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কিশোরগঞ্জ হয়বতনগরের ‘শেষ জমিদার’ বাড়ি

আপডেট টাইম : ০৩:৪৬:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নিভে গেছে রঙিন আলো। ঝাড়বাতি আর ঝালরের বাহারও নেই। কোথাও বাজে না পাখোয়াজ। শোনা যায় না নূপুরের নিক্কণ। বিরাণ প্রান্তরের কোণে একখণ্ড অতীতকে বুকে চেপে নিথর দাঁড়িয়ে রয়েছে হয়বতনগরের জীর্ণ জমিদার মহলের স্মৃতির আঙিনা।

খানিক আগেই হয়বতনগরের পূর্ব সীমার সুপারি ও নারকেল বীথির মাথায় কুয়াশা-মাখা আকাশে উঁকি দিয়েছে অলৌকিক ভোর বেলা। দিন শুরুর মায়াবী প্রথম আলোর স্বর্ণালী আভায় একটু একটু করে জেগেছে কিশোরগঞ্জ শহর। কিন্তু শহরের প্রান্তিক ও প্রাচীন জনপদ হয়বতনগর জেগে ওঠেনি সানাই ও নহবতের সুরে। প্রায়-হানাবাড়ির মতো স্তব্ধ চারপাশ। অতীত এখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে লয়-প্রাপ্ত বাস্তবতায়।

গত (২ নভেম্বর) সকালে আমরা এসেছি মূল কিশোরগঞ্জ শহর থেকে শুকনো নরসুন্দা নদী আর গুরুদয়াল কলেজ পেরিয়ে দক্ষিণপশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তের প্রায়-বিচ্ছিন্ন হয়বতনগর পরগণায়। গ্রাম আর শহরের মিশেলে হয়বতনগরে প্রবেশের মুখে একটি ছোট্ট বাজারের মতো তিন রাস্তার মোড় থেকে তাকালে অদূরের কংকালসার হাভেলি এবং প্রাচীন জমিদার মহলের ক্ষয়িষ্ণু বাড়ি-ঘরগুলোর স্মৃতিচিত্র মানসপটে ভেসে আসে।

বর্তমানের পরিবর্তনের নিচে চাপা পড়া ঐতিহ্য টের পাওয়া যায়।

এই মোড় থেকে আরও এগিয়ে গেলে শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার নানা পথ। ঢাকা-ময়মনসিংহ বাইপাস হয়ে পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, ভৈরব কিংবা উত্তরবঙ্গ, সিলেট বা চট্টগ্রামের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলো ওদিকেই।

মাঝখানের স্তব্ধ জনপদ হয়বতনগর।

কিশোরগঞ্জ শহরটিও বড় অদ্ভুত। সব পথ উত্তর, পশ্চিম আর দক্ষিণে প্রসারিত। পূর্ব দিকের রাস্তাগুলো মূলত হাওরাঞ্চলমুখী। নৌ চলাচলের ভালো ব্যবস্থা করা হলে নদী পথেও এখান থেকে বৃহত্তর সিলেট বা দক্ষিণবঙ্গে সহজেই যাতায়াত করা যেতো। এখন সবই সড়ক আর রেলমুখী যাত্রাপথ। নদী মার্তৃক বাংলাদেশের নৌ পথগুলো বলতে গেলে লুপ্তই হয়ে যাচ্ছে।

‘আপনেরা কই যাইবাইন’, হয়বতনগরের মোড়ে আমাদের অপেক্ষায় দেখে প্রশ্ন করেন এক বয়সী স্থানীয় মানুষ। ততক্ষণে মোড়ের কাঁচা দোকানগুলো খোলার আয়োজন করছে। একটি চা স্টলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিই, ‘হয়বতনগর জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছি।’ বয়স্ক লোকটিও আমাদের সঙ্গে চা স্টলে এসে বসেন, ‘এখন আর কি দেখবাইন, আগের দিন আর নাই।’ তার কণ্ঠে হতাশা। জানা গেল, অনাদার ও অযত্নে নষ্ট হচ্ছে অনেক কিছু। বাড়ির লোকজনও বিশেষ কেউ নেই। ঢাকা বা বিদেশে চলে গেছেন প্রায়-সকলেই। অনেক কিছুই ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিক্রি করে দেওয়ায় আধুনিক ঘর-বাড়ি বানানোর তৎপরতাও চলছে। পরিবর্তনের তোড়ে হয়বতনগর এখন প্রাচীনত্বের স্থলে নবসৃষ্টির আগ্রাসী দাপটের অধীন।

খালি স্টলের চা দোকানিও এতো সকালে অচেনা মানুষদের দেখে উৎসাহী হয়ে বললেন, ‘আমরার জমিদার সাব বাড়িত আছুন। তাইনের লগে দেহা করুইন।’ আমি অবাক গলায় বলি, ‘জমিদার! এখন তো জমিদারির দিন নেই ?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে জানলাম, জমিদার বাড়ির কর্তাকে তারা সম্মান করে ‘জমিদার সাব’ নামে ডাকেন। তিনি কোনও পদবি ও জায়গীর পাওয়া জমিদার নন, জমিদারির ঐতিহ্যের শেষ প্রতিনিধি হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে শ্রদ্ধার মানুষ।

ষাট-ছোঁয়া বয়সের ‘জমিদার সাব’-এর পোশাকি নাম সৈয়দ রেজওয়ানউল্লাহ বাসার। আমাদের সাদরে তার বাড়ির বৈঠক খানায় বসালেন। ঘর ভর্তি বই। ভদ্রলোক পড়ুয়া। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর পুরো মহল ঘুরিয়ে দেখালেন।

যদিও নামে মহল, আসলে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বাহির আর অন্দর মহলের নানা স্মৃতির কথা জানতে পারলাম। ফারসি শিলালিপিসহ একটি প্রাচীন মসজিদ আর পাশেই অতি পুরনো একটি কবরগাহ। পুরনো ইটে বাঁধানো অনেক প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র দেখা গেলো, যাতে উৎকীর্ণ রয়েছে ফরাসি লিপিতে রচিত নানা বিবরণ। দেখতে দেখতে জানতে পারলাম, যা ছিল, তার অনেক কিছুই এখন আর নেই।

তবুও হয়বতনগরের একদার জমিদার বাড়িকে লোকজন সাধারণ ভাষায় ‘সাহেব বাড়ি’ নামে ডাকে। বাড়ির দু’টি হিস্যা। একটি ‘দেওয়ান বাড়ি’, আরেকটি সৈয়দ বাড়ি।

‘দেওয়ান বাড়ি’ মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁর বংশধর। তাদের আত্মীয়তা রয়েছে জঙ্গলবাড়ি, এগারসিন্দুর, সোনার গাঁ ইত্যাদি স্থানে বসবাসরত ঈসা খাঁ ও তাঁর পুত্র মুসা খাঁর অধঃস্থন বংশধরদের সঙ্গে।

‘সৈয়দ বাড়ি’ মূলত বৈবাহিক সূত্রে প্রাসাদের বাসিন্দা ও অংশীদার। তাঁদের পূর্বপুরুষগণ হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গীদের একজন, যার নাম সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালার। সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও সরাইল অঞ্চলে তাঁদের আত্মীয়তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে। জানা গেল, ঢাকার শাইনপুকুরের সালমান এফ রহমান পরিবারের মাতুল বংশ কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সৈয়দ বাসার সাহেব তাঁদের বংশ লতিকা ও পূর্বপুরুষদের তথ্য সম্বলিত কিছু পুস্তিকা উপহার দিলেন। পুরনো আমলের তৈষজপত্র ও ব্যবহায্য দ্রবাদির অবশিষ্ট কিছু অংশ দেখালেন। বললেন, ‘অনেক কিছুই নানা শরিকের কাছে আছে। অধিকাংশই লুট বা চুরি হয়ে গেছে। জায়গা-জমিও বিক্রি হয়ে গেছে ।’ জানা গেল, বাড়ির বিভিন্ন অংশের বাসিন্দাদের প্রায়-সকলেই ব্যবসা ও চাকরি উপলক্ষ্যে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে গেছেন।

কিশোরগঞ্জে স্থায়ী বলতে তিনি ছাড়া অল্প কয়েকজনই আছেন। ‘তবে বছরে দুই-বছরে ঈদ বা কোনও উপলক্ষ্যে সকলেই হয়বতনগর আসেন। তখন লোক সমাগম ও নানা আয়োজনে জমজমাট হয়ে ওঠে পুরো হাভেলি’, বললেন তিনি।

জানতে চেয়েছিলাম, কিভাবে দিন কাটে প্রাচীন জমিদার প্রথার এই শেষ ও প্রতীকী প্রতিনিধির? সৈয়দ বাসার সাহেব বললেন, ‘আমাদের দেওয়ান ও সৈয়দ বাড়ির পূর্বপুরুষগণ রাস্তাঘাট, মসজিদ, ঈদগাহ, লাইব্রেরি ইত্যাদি স্থাপন করে বৃহত্তর কিশোরগঞ্জকে আলোকিত করেছিলেন। আমরা সে সবের খোঁজ-খবর রাখি।

কিশোরগঞ্জের শিল্প-সাহিত্য- শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক সকল কাজেই আমরা ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করি। পড়াশোনা করে আর সামান্য কিছু এস্টেটের তদারকি করেই আমার দিন কাটে। এখনো যা সহায়-সম্পতি রয়েছে, তা চলার জন্য যথেষ্ট।’

ফিরে আসার পথে দেখা হলো স্থানীয় হাসমতউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মওলানা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে।

তিনি জানালেন, ‘সাহেব বাড়ির লোকজন প্রতিবেশী হিসাবে খুবই উপকারী। এখনো এলাকার মানুষের সুখ- দুঃখের খবর নেন। সাহায্য করেন। তাঁরা অত্যন্ত শরিফ ও সম্ভ্রান্ত মানুষ। আগের আর্থিক জৌলুস না থাকলেও তাঁরা ঐতিহ্যগত দিক থেকে কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের গৌরবময় অংশ।’

পালাবদলের পৃথিবীতে সামাজিক কাঠামোর নানা অদল-বদল এবং উত্থান-পতনের হাত ধরে একদার হাতি-
ঘোড়া সজ্জিত প্রাসাদ বিরাণ হয়ে গেছে। আবার বিরাণ জনপদ আলো ঝলমল হয়েছে। কালের গর্ভে বিলীন সেইসব কথা ও কাহিনি ইতিহাসের প্রাচীন-ধুসর পাতায় কিংবা লোকশ্রুতিতে এখনো চকচক করে। আজকের বদলে যাওয়া হয়বতনগরের দিকে পেছন ফিরে তাকালে টের পাওয়া যায় সমৃদ্ধ অতীতের স্মৃতিমেদুর দ্যুতিময় ঝলক।