হাওর বার্তা ডেস্কঃ বেশ কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকার শিরোনামগুলো দখল করে আছে মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ। এর মধ্যে হাওর বার্তাররোহিঙ্গা শিশুদের অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত দুর্ভোগকে প্রাধান্য দিয়ে বেশ কিছু দরকারি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২১ অক্টোবর-এর মূল খবর ছিল, ‘অতি জরুরিভাবে শিশুদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন’। ২৩ অক্টোবর হাওর বার্তা লিখেছে, ‘তীব্র অপুষ্টিতে রোহিঙ্গা শিশুরা’।
একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পুষ্টি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করার সুবাদে গত মাসের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সে অভিজ্ঞতা বলছে, পত্রপত্রিকা পড়ে আমরা যা জানতে পারছি, পরিস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও ভয়াবহ ও শোচনীয়। প্রতিদিন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা আসছে। আমরা জানছি, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু। আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের প্রায় ৩০ শতাংশই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। এর মানে, আশ্রয়প্রার্থী দলের প্রতি ১০ জনে ৩ জন করে আসছে শিশু।
এরা আমাদের দেশে এসে পৌঁছাচ্ছে রওনা দেওয়ার সপ্তাহখানেক বা তার চেয়েও বেশি দিন ধরে যাত্রাপথে হেঁটে। এই পুরো সময়টাতে কখনো তাদের খাওয়া জুটেছে, কখনো জোটেনি। নিরেট বাস্তব হলো অনাহারে-অর্ধাহারেই তাদের পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে দীর্ঘ এতটা পথ। আর পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবের সঙ্গে হেঁটে আসার দুর্যোগকবলিত পথে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যে ত্বরিতগতিতে প্রত্যেকের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারছে, তা তো নয়। টেকনাফ পেরিয়ে উখিয়ার ক্যাম্প পর্যন্ত আসতে আসতেই পেরিয়ে যাচ্ছে আরও বেশ কয়েকটা দিন।
দীর্ঘ এই ১০-১২ দিনের ধকলে এই কম বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। রোহিঙ্গাদের আবাস যে আরাকান রাজ্য, আর্থিক ও মানবাধিকারের বিচারে সেটি মিয়ানমারের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এলাকা। অনুমান করা কঠিন নয় যে নিজ দেশে থাকা অবস্থায়ও এসব শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা কতটা নিচের স্তরে ছিল। বিতাড়িত ও অনাহারী এই দুর্বল স্বাস্থ্যের শিশুদের জন্য মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের সংকটবহুল পথ পাড়ি দেওয়ার কষ্ট হয়ে উঠেছে ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’র মতো।
ক্যাম্পে এসেও শিশুগুলোর মোটেই কোনো স্বস্তি নেই। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারাটা দিন ত্রাণের জন্য অপেক্ষা আর দিন শেষে খাদ্যসহ নানা কিছুর ভারী বোঝা বা পানির ওজনদার জারিকেন নিয়ে অপুষ্ট শরীরে পাহাড়ি খাঁড়াই পাড়ি দেওয়ার ধকল। ত্রাণ সংগ্রহে ব্যস্ত মা ছোট্ট শিশুকে ঠিকমতো দিতে পারছেন না বুকের দুধ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো তাই আক্ষরিক অর্থে শিশুদের জন্য নরক। অপুষ্ট ও রোগাক্রান্ত শিশুদের সেখানে ছড়াছড়ি। তাদের অতি জরুরি প্রয়োজন যথাযথ খাবার, পথ্য ও চিকিৎসার।
উখিয়ার আট-দশটা ক্যাম্পের মধ্যে চারটি আমার নিজের কর্মক্ষেত্র। গত মাসখানেকের বেশি দিনের প্রত্যক্ষ কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মোট শিশুর প্রায় প্রতি চারজনের একজন ভুগছে বিশেষ ধরনের অপুষ্টিতে, পুষ্টিবিজ্ঞানের অভিধানে যাকে বলা হয় ‘স্বল্পমেয়াদি অপুষ্টি’। খুব কম সময়ের মধ্যে—খাবারের তীব্র অভাবে বা অসুখবিসুখে—শিশু দ্রুত অতিরিক্ত ওজন হারিয়ে ফেললে এই অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। এতে তার মৃত্যুঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। স্বল্পমেয়াদি অপুষ্টির মাত্রা ১৫ শতাংশের বেশি হলে ইউএনএইচসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী ধরে নেওয়া হয়, দুর্গত এলাকায় সংকটাপন্ন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্যাম্পগুলোতে দেখতে পেয়েছি, স্বল্পমেয়াদি অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু ২৪ শতাংশের বেশি। এটি ইউএনএইচসিআর নির্দেশিত সংকটাপন্ন মাত্রার প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।
রোহিঙ্গা শিশুদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যু ঠেকাতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ দেশি ও বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো আপ্রাণ কাজ করে চলেছে। তবে সমস্যা হয়ে উঠেছে সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতিটি শয্যায় উপচে পড়া ভিড়। একজনের শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে দু-তিনজন করে শিশু। এ অবস্থায় এত শিশুর চিকিৎসা হাসপাতালে রেখে করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ‘আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত’ পুষ্টিপথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যাম্পগুলোতে এই বিশেষ ধরনের অপুষ্টির চিকিৎসাসেবা শুরু করেছে। শিশুরা এতে অল্প সময়ের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছে ঠিকই, কিন্তু নিজের ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পর খাবারের অভাবে আবারও অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে।
‘আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত’ এই পুষ্টিপথ্যটি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় কোনো কোনো পুষ্টিবিদ এটি ব্যবহারের বিপক্ষে। তাঁদের মতে, হালুয়া বা খিচুড়ি ইত্যাদি রান্না করা খাবারের মাধ্যমে অপুষ্ট শিশুদের সেবা দেওয়া দরকার। সমস্যা অবশ্য সেখানেও কম নয়। প্রতিদিন নিয়মিত দু-তিন হাজার শিশুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপত্তায় খাবার রান্না ও পরিবেশন করা বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। এ প্রশ্ন না ওঠার অবকাশ নেই যে নিরাপদ পানি ও উপযুক্ত স্যানিটেশনের অভাবে রান্না করা খাবার প্রতিদিন আদৌ কতটা যথাযথভাবে বিতরণ করা সম্ভব? ক্যাম্পের খোলা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না করা খাবার খেয়ে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়লে তার দায়ভার কে নেবে? ফলে প্রশ্নটি জরুরি, তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা এই শিশুদের বাঁচাতে কোন পথটি সঠিক—প্যাকেটজাত বিদেশি পথ্য, নাকি চাল-ডালে রান্না করা খাবার ? কিন্তু জরুরি এই প্রশ্নের অব্যর্থ জবাব কারও কাছে নেই। এ অবস্থায় কি তাহলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন ?
হতভাগ্য রোহিঙ্গা শিশুদের অসহায়ত্বের মুখে হাত গুটিয়ে বসে থাকার অবকাশ আদতে কারোরই নেই। ওরা আমার দেশে এসেই পড়েছে। মৃত্যুর ঝুঁকির মুখে টলটলায়মান এই শিশুদের মানবিক চাহিদার প্রতি আমাদের সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। যথাযথ চিকিৎসা, খাদ্য, পথ্য তাদের দিতে হবে।
‘স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্যাকেটজাত পথ্য’ নাকি ‘রান্না করা খিচুড়ি’, মৃত্যুর মুখোমুখি ধুঁকতে থাকা রোহিঙ্গা শিশুদের সামনে রেখে সে তাত্ত্বিক বিতর্কের সময় এখন নয়। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে হোক বা উন্নয়নকর্মী হিসেবে, এ প্রশ্নের সমাধান আমাদের নিশ্চয়ই করতে হবে। কিন্তু এখন প্রয়োজন এই শিশুদের বাঁচিয়ে তোলা। তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা। এবং সবাই একসঙ্গে মিলে।
প্রথম আলো