হাওর বার্তা ডেস্কঃ গত তিন দশকে দেশে দারিদ্র্য অনেকটাই কমেছে। ২০১৬ সালের খানা জরিপের হিসাবে যার পরিমাণ ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তারপরও দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ এখনো খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তীব্র ক্ষুধায় ভুগছে আরও প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ। আড়াই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এবারের বন্যায় ব্যাপারটা আরও প্রকট হয়েছে। এতে যেমন একদিকে ৮০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বেড়েছে। ফলে উত্তরবঙ্গের যে চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তাভাত, পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকায় উঠে যাওয়ায় তারা এখন শুধু লবণ দিয়েই পান্তা খাচ্ছে।
হাওরে ফসলহানি ও পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ধসের পর ওই এলাকার মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গা সংকট। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইফপ্রির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১১-১৫ সালে কৃষি প্রবৃদ্ধির হার, বিশেষত চাল উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে। ২০০৭-১১ সালে কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫ শতাংশ, যেটা ২০১২-১৬ সালে ২ শতাংশের প্রান্তিক বেশি। গবেষণার দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণটি খুবই উল্লেখযোগ্য, সেটা হলো অন্যান্য খাতের তুলনায় শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি দুই-তিন গুণ বেশি দারিদ্র্য হ্রাস করে। কৃষিতে দারিদ্র্য প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতার মান প্রায় ২, মানে এ খাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটলে দারিদ্র্য কমবে ২ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো জরুরি।
এই পরিস্থিতিতে মানুষকে নানা ধরনের খাদ্যসহায়তা দিতে হবে। তবে আমন ও বোরো ধান উঠলে চালের দাম সহনীয় হবে আশা করা যায়। অন্যদিকে রবিশস্য উঠলে সবজির দামও নাগালের মধ্যে চলে আসবে। এতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর সঙ্গে সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে তাকে পুষ্টিমানের দিকে নজর দিতে হবে।
একসময় খাদ্যনিরাপত্তার অর্থ ছিল জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুত থাকা। কিন্তু সেই পরিস্থিতি আর নেই। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের সংজ্ঞানুসারে খাদ্যনিরাপত্তা আছে—এ কথাটা তখনই বলা যাবে, যখন একটি দেশের সব মানুষের নিরাপদ, পুষ্টিকর, পছন্দমাফিক ও প্রয়োজনীয় খাবার যথেষ্ট পরিমাণে প্রাপ্তির বাস্তব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ থাকবে; সক্রিয় ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য যা প্রয়োজনীয়।
এই সংজ্ঞানুসারে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, আমাদের প্রত্যাশা, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। কিন্তু ক্ষুধার্ত ও অপুষ্ট মানুষের কাঁধে ভর করে এটা অর্জন করা যে কঠিন বা তা করলেও যে ব্যাপারটা টেকসই হবে না, সেটা বলা বাহুল্য। বাংলাদেশ সরকার ও ইউএসএইডের এক যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশের প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। ফলস্বরূপ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় এর চেয়েও বেশি। বলা দরকার, ২০১৪ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতি ‘সিরিয়াস’ (গুরুতর) শ্রেণিতে। বাংলাদেশ খর্বকায় শিশুর হার কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, সেটা অর্জন করতে খর্বত্ব হ্রাসের পরিমাণ বছরে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়া উচিত। এখন আমরা তার চেয়ে অনেক পেছনে আছি। ২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার কোনো একটি অর্জনের পথেও বাংলাদেশ নেই—২০১৪ সালের গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্টে এটা বলা হয়েছে।
পুষ্টির দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার এ কারণে যে সঠিক পুষ্টির মাধ্যমে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। তার সঙ্গে আছে জীবনাচরণ। পুষ্টির নিম্নমানের পেছনে যেমন আর্থিক দিক আছে, তেমনি আছে সচেতনতার অভাব। এখনো আমাদের খাদ্যতালিকায় শস্যজাতীয় খাবারের প্রাধান্য রয়েছে। ডব্লিউএফপির তথ্যানুসারে ২০১১ সালে আমাদের শক্তির ৭৭ শতাংশ এসেছে এই শস্যজাতীয় খাবার থেকে, যেখানে ১৯৯৫-৯৬ সালে তা ছিল ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে যেমন ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে, তেমনি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধির কারণে ধানের পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে। যে দেশে মানুষের প্রধান খাবার ভাত, সেখানে এটা আশঙ্কার কথা। অন্যদিকে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ লৌহ ও জিঙ্কের ঘাটতিতে ভুগছে, যেটা শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য গুরুতর ব্যাপার। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগার হার বেড়ে যাবে।
নগরায়ণের কারণেও আজকাল পিতা–মাতার পক্ষে শিশুদের খাবারের দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ শিশু লালন-পালনবিষয়ক এক ওয়েবসাইটে দেখেছি, শিশু যা খায়, সে তেমনই হয়। ভ্রূণাবস্থা থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবার দেওয়া দরকার। এ সময়ই শিশুর বিকাশের সব শর্ত তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু সেই সচেতনতা আমাদের কজনেরই বা আছে আর রাষ্ট্রই বা এ ক্ষেত্রে কী করছে? অসচেতনতা ও আর্থিক দুরবস্থার সঙ্গে পারিবারিক কলহের কারণেও অনেক শিশু যথার্থ খাবার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
দেশের বিপুলসংখ্যক নিম্নবিত্তের পুষ্টির মান খুবই নিম্নপর্যায়ের, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক হল ও মেসবাসী ছাত্রছাত্রী ও ব্যাচেলররা যে খাবার খাচ্ছে, তার মানও খুব নিম্নপর্যায়ের। পরিস্থিতি এমন যে ছাত্রদের অনেকেই দিনে এক বেলা অভুক্ত থাকে। সেটা যেসব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণে ঘটে তা নয়, ভেজালহীন ও সহজপাচ্য খাবারের দুষ্প্রাপ্যতাও এর অন্যতম কারণ। আগামী দিনের জাতির কর্ণধারেরা কী খাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের মোটেও মাথাব্যথা নেই। ছাত্রীদের জন্য ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে তারাই ভবিষ্যতে মা হবে। তাই ছাত্রাবাসে খাদ্যের মান উন্নত করতে সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানুষের খাদ্য ও পর্যাপ্ত পুষ্টিপ্রাপ্তিকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। এর সঙ্গে মায়েদের পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টির মাধ্যমে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র শ্রেণির খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এ শর্তগুলো পূরণ করতেই হবে।
সংবাদ শিরোনাম
মানুষ উন্নয়নের অপুষ্ট সহায়ক নয়
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১১:৫৬:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ অক্টোবর ২০১৭
- ৩৬৪ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ