ঢাকা ০৬:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্ডারে দুর্নীতির কারণে ঠেকানো যাচ্ছে না ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আব্রাম না থাকলে তাকে আমার যোগ্য বলেও মনে করতাম না ওমরাহ শেষে গ্রামে ফিরে খেজুর-জমজমের পানি বিতরণ করল শিশু রিফাত বিদেশে প্রশিক্ষণে ঘুরে-ফিরে একই ব্যক্তি নয়, জুনিয়রদের অগ্রাধিকার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়ে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মতামত জরিপ জানুয়ারিতে বুয়েট শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩ আসামি রিমান্ডে বিয়ের আগে পরস্পরকে যে প্রশ্নগুলো করা জরুরি

এরপরেও কি আশাবাদী না হয়ে পারা যায়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৩০:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৭
  • ৩৭৬ বার

ওই মহাদুর্যোগের দিনে, সকাল থেকেই প্রকৃতির সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সকাল সাতটা থেকে ভিড় জমিয়েছিল ঢাকার রেসিডেনশিয়াল কলেজের মাঠে। সকাল সাড়ে সাতটায় মাঠের ভেতরে তিন হাজার আসনের প্যান্ডেল কানায় কানায় পূর্ণ। কলেজের গেট থেকে ভেতরের রাস্তায় হাজার হাজার ছাতা। অভিভাবকেরা আর কিশোর-কিশোরীরা প্রবেশের অপেক্ষায় ধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ।

এটা ছিল মাসিক পত্রিকা হাওর বার্তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান—কিআনন্দ! অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল আটটায়। ছেলেমেয়েদের ফেসবুকে বলে রেখেছিলাম, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বৃষ্টির কথা বলছে, তোমরা ছাতা আর রেইনকোট এনো, বৃষ্টি-উপযোগী জুতা পরে এসো, আর ঠিক আটটাতেই অনুষ্ঠান শুরু করব, ভিড় হবে, কাজেই সাতটার মধ্যে চলে এসো। তারা সেই কথাই শুনেছে।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাতটার মধ্যে চলে এসেছে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরী আর এসেছেন তাদের অভিভাবকেরা। কিন্তু তারও আগে, ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে এসেছে আড়াই শ কিশোর-কিশোরী, যারা স্বেচ্ছাসেবকের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক মানে স্বেচ্ছাসেবকই, নিজের ইচ্ছায় সেবা করতে চেয়েছে যারা।

এই ছেলেমেয়েদের দেখে, প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ, আমি খুব সচেতনভাবে লিখছি এবং জোর দিয়ে বলছি, আমাদের এই কিশোর তরুণ বালকবয়সী স্বেচ্ছাসেবকদের দেখে আমার সমস্ত হতাশা কেটে গেছে, আমার মনে হয়েছে, এদের জন্যই পৃথিবী এখনো বাসযোগ্য রয়ে গেছে, জীবন সত্যি সুন্দর এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল।

হাওর বার্তার স্বেচ্ছাসেবকেরা স্কুল-কলেজের ছাত্র ও ছাত্রী। তারা ভোর সাড়ে ছয়টার মধ্যে চলে এসেছে মাঠে, বৃষ্টি উপেক্ষা করে। মাঠভরা পানি আর আমি পা রাখতেই দেখলাম, জুতাজোড়া ডুবে গেল কাদার মধ্যে। আর আমার স্বেচ্ছাসেবক কিশোর-কিশোরীরা সেই বৃষ্টি আর কাদার মধ্যে অবিচলভাবে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। যাকে যেখানে থাকতে বলা হয়েছে, সে সেখানে ‘ডিউটি’ করছে। কারও কাজ গেটের প্রবেশপত্র পরখ করা, কারও কাজ স্টল সামলানো, কেউবা দায়িত্ব পেয়েছে কর্মশালার মঞ্চের, কেউবা মূল মঞ্চে। তারা কেউ তাদের জায়গা থেকে নড়ছে না, এক মুহূর্তের জন্য সরছে না।

আমরা অনুষ্ঠান যথারীতি আটটার দিকেই শুরু করে দিতে পারলাম। নজরুলসংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরার একটা গানের দল আছে, সুর সপ্তক, তাদের ছেলেমেয়েরা লাল-সবুজ পোশাক পরে মঞ্চ দখল করে গাইল জাতীয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা। তারপর উদ্বোধনী পর্বে মঞ্চে এলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ফরিদুর রেজা সাগর, অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, মিনার আর আয়মান সাদিক।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বললেন, বাংলা ভাষায় দুটি শব্দ আছে, একটা হলো ‘পণ্ড’, একটা হলো ‘ভন্ডুল’। সকাল থেকে বৃষ্টি দেখে ভাবছিলাম, ওই শব্দগুলো বুঝি আজকে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এই অদম্য কিশোর-কিশোরীরা বরং ওই শব্দগুলোকেই পণ্ড আর ভন্ডুল করে দিল। আসলেই তো। ওরা যেন গাইছে, ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে।

এ তো বলছি ২০ অক্টোবরের কথা। কিন্তু তারও আগের সপ্তাহে, ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামে, নাসিরাবাদ বালক উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠেও ভেঙে পড়েছিল চট্টগ্রামের কিশোর-তরুণেরা। এবার প্রথমবারের মতো আমরা কিআনন্দ উৎসব করছিলাম ওখানে। বিকেলের দিকে পুরো মাঠে মানুষ আর মানুষ। ছেলেমেয়েরা এসেছে, এসেছেন তাদের বাবা-মায়েরা। এত ভিড় দেখে পুলিশ এসে বলছিল, আপনারা তাড়াতাড়ি শেষ করে দিন, আর মেয়েদের পরে যেতে বলুন। আমি তখন ‘বুদ্ধি’ করে বললাম, অনুষ্ঠান শেষ, তবে মেয়েরা থাকো, কারণ গণিত নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কিছু কথা আছে, তিনজন মেয়ে মঞ্চে এসো, আচ্ছা বলো, তুমি বড় হয়ে কী হবে, এটা কি সত্যি যে মেয়েরা গণিতে ভয় পায়! এই গুরুত্বপূর্ণ ‘টক শো’র আসল উদ্দেশ্য মাঠ খালি করে দেওয়া, কিন্তু মাঠ কি আর খালি হয়! এক ঘণ্টা লেগেছিল শুধু মাঠ থেকে দর্শনার্থীদের বেরোতে।

আর ঢাকায়? ঢাকার কিআনন্দের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়েছিল, আর সঙ্গে করে আনতে হবে অক্টোবর সংখ্যার কিশোর আলোর কুপন। সাত দিন আগে ১৫ হাজার নিবন্ধন শেষ। তখনো ছেলেমেয়েরা দাবি করে চলেছে, আরও নিবন্ধনের সুযোগ দিন। দুই দিনের জন্য বাড়াতেই আরও ৭ হাজার নিবন্ধন। এর সঙ্গে অভিভাবকেরা এলে মাঠে তো আর জায়গা হবে না। আমরা নিবন্ধন বন্ধ করে দিলাম। তারপর থেকে শুরু হলো ভীষণ ছোটাছুটি, কীভাবে কিআনন্দে ঢোকার প্রবেশপত্র জোগাড় করা যাবে, এ যেন সোনার হরিণ, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তদবির আসতে লাগল—দুটো প্রবেশপত্র কি হবে?

২০ অক্টোবর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মূল মঞ্চে উঠলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছেলেমেয়েরা মঞ্চে উঠে তাঁকে প্রশ্ন করতে লাগল।

সায়ীদ স্যার পুরান ঢাকার পাখা বিক্রেতার গল্পটা প্রায়ই বলেন। এবার কিআনন্দ উৎসবেও তাঁকে গল্পটা বলতে অনুরোধ করলাম।

পাখা বিক্রেতা পাখা বিক্রি করে। একটার দাম এক টাকা, একটার দাম দশ টাকা। এক লোক এক টাকার পাখা কিনে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বাতাস করতে গেছে, অমনি পাখা গেছে ভেঙে। তখন সে পাখাওয়ালাকে এসে অভিযোগ করছে, কী মিয়া, কী পাখা দিলা, ভেঙে যায়।

পাখাওয়ালা বলল, কোনটা কিনছিলেন? এক টাকারটা না দশ টাকারটা।

এক টাকার পাখা দিয়া বাতাস করার নিয়ম, পাখা সোজা কইরা ধইরা মাথা ডাইনে বামে নাড়াইবেন, খবরদার পাখা নাড়াইবেন না।

স্যার বলেন, তোমরা যদি পাখা বানাও, দশ টাকারটা বানাবে। যদি ডাক্তার হও, সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হবে। যদি লেখক হও, সবচেয়ে ভালো লেখক হবে। যদি গাছে ওঠো, মগডালে উঠবে।

যে কাজই করো, সবচেয়ে ভালোভাবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে করবে, যাতে উৎকর্ষের চূড়া ছুঁতে পারো।

মঞ্চে কত মজা হচ্ছে, লেখকদের কাছ থেকে জানা হলো লেখালেখির কৌশল, চলচ্চিত্র আর অভিনয় নিয়ে কথা বললেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী আর তিশা, হলো চিরকুটের গান। আরেক মঞ্চে হচ্ছে ছড়াপাঠের আসর, আয়মান সাদিকের কর্মশালা। কিন্তু স্টলে কিংবা গেটে যে কিশোরেরা ‘ডিউটি’ করছে, তারা কেউ মঞ্চের দিকে আসছে না। তারা তাদের পোস্টে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কর্তব্য পালন করে চলেছে। ‘ডিউটি’ আর ‘কর্তব্য’ শব্দ দুটোও আমি সচেতনভাবে ব্যবহার করছি। আমাদের শিশুদের কর্তব্যবোধ কী রকম প্রখর। যে ‘ডিউটি’ তাদের দেওয়া হয়েছে, তা পালনে তারা কী রকম বদ্ধপরিকর। চিরকুটের গানের সময় শ্রোতারা আকুল হলো, তারা মঞ্চের দিকে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো ছুটে আসতে চাইছে আর আমাদের কিশোর স্বেচ্ছাসেবকেরা হাতে হাত ধরে শিকল বানিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঁধ হয়ে তাদের সামলাচ্ছে। আমি কী বলব! এই দৃশ্য যদি আপনারা দেখতেন, আপনাদেরও আমার মতো বলতেই হতো, বলতেই হতো—যে বাংলাদেশ এই ছেলেমেয়েদের জন্ম দিতে পেরেছে, সেই বাংলাদেশ চির অপরাজেয়, সেই বাংলাদেশ একদিন বিশ্বজয় করবেই।

যদিও আমরা পুলিশ, র‍্যাব, বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা, প্রথম আলো ইভেন্টস, বন্ধুসভা, ক্রসওয়াক নামের সংস্থার কর্মীদের দিয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ব্যবস্থা রেখেছিলাম, কিন্তু আমাদের আস্থা ছিল কিশোর ভলান্টিয়ারদের ওপরই, আর তারা আমাদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে বহুগুণ।

আমাদের এক স্বেচ্ছাসেবক ফেসবুকে লিখেছে:

‘শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করেছি। একে “হাই” বলিনি, ওকে পাত্তা দিইনি, তার খোঁজ করিনি, এসব অভিযোগও এসেছে—বন্ধুরা, আমিও দুঃখিত কাউকে হাই দেওয়ারও সময় পাইনি। এই টি–শার্ট এবং আইডি কার্ড অনেক বড় একটা দায়িত্ব। এটার অবমাননা করিনি।

‘একটা জিনিস আমার খুব ভালো লাগল। আমি যখন আমার ১০ ফুটের ভেতরের ময়লা কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলছিলাম, আমার দেখাদেখি একটা বাচ্চাও সেই কাজটা করল। সব জোনের লিডার, ভলান্টিয়ারদের আত্মোৎসর্গের কারণেই এত নিম্নচাপের মধ্যে স্কুল-কলেজপড়ুয়া বাচ্চাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে কিআ পাঠকদের মহোৎসব কিআনন্দ।

‘কাজ করতে গিয়ে ভলান্টিয়াররা বৃষ্টিতে ভিজেছে, কাদায় পিছলে পড়েছে, জ্বর বাঁধিয়েছে, তবু দায়িত্ব ফাঁকি দেওয়ার
বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি কেউ। শুধু ওই বৃষ্টিটা না থাকলেই এবারের কার্যক্রম, এবারের নিয়মকানুন, এবারের কিআনন্দ হতো অসাধারণ।—এশনা বিনতে আলী।’

আরেকজন কিশোরের লেখা পড়ুন:

‘কিআনন্দ শেষে বাসায় আসছিলাম। দোয়েল চত্বরের সামনে থেকে বাসে না উঠে ভাবলাম একটু হেঁটেই নিই বৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ফুলের দোকানের পাশে একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা নারী প্রচণ্ড শীতে কাঁপছেন। দেখে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, দুই দিন ধরে তিনি কিছু খাননি। আর অনেকক্ষণের বৃষ্টিতে তার ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল বুঝতে পেরেছিলাম। পাশের দোকান থেকে কিছু ফল আর রুটি কিনে খাইয়েছিলাম। তিনি আমাকে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। খুবই আনন্দ লাগছিল তাঁর মুখে হাসি ফোটাতে পেরে।

‘তখনই আজকে কিআনন্দে আয়মান সাদিকের কথাটা মনে পড়ে গেল, যে প্রতিদিন অন্তত একজন মানুষকে খুশি করো। তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন, যা তাঁর চোখে ফুটে উঠেছিল।

‘এই বিশাল পৃথিবীতে আমার এইটুকু সাহায্য হয়তো কিছুই না, কিন্তু সত্যিই এই ভেবে আমার দিনটা আজকে অনেক ভালো কেটেছে।—সাবা সিদ্দিকা সুপ্ত।’

প্রিয় পাঠক, এই শিশু-কিশোরেরা এই বাংলাদেশে সুদিন আনবে কি না আপনিই বলুন।

আজ আমরা কিআনন্দ নিয়ে যাচ্ছি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। আমরা জানি, কালিহাতীতেও আমরা একই প্রেরণা পাব।

আনিসুল হক

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে মদনে আবারও বিক্ষোভ মিছিল

এরপরেও কি আশাবাদী না হয়ে পারা যায়

আপডেট টাইম : ০৬:৩০:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

ওই মহাদুর্যোগের দিনে, সকাল থেকেই প্রকৃতির সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সকাল সাতটা থেকে ভিড় জমিয়েছিল ঢাকার রেসিডেনশিয়াল কলেজের মাঠে। সকাল সাড়ে সাতটায় মাঠের ভেতরে তিন হাজার আসনের প্যান্ডেল কানায় কানায় পূর্ণ। কলেজের গেট থেকে ভেতরের রাস্তায় হাজার হাজার ছাতা। অভিভাবকেরা আর কিশোর-কিশোরীরা প্রবেশের অপেক্ষায় ধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ।

এটা ছিল মাসিক পত্রিকা হাওর বার্তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান—কিআনন্দ! অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল আটটায়। ছেলেমেয়েদের ফেসবুকে বলে রেখেছিলাম, আবহাওয়ার পূর্বাভাস বৃষ্টির কথা বলছে, তোমরা ছাতা আর রেইনকোট এনো, বৃষ্টি-উপযোগী জুতা পরে এসো, আর ঠিক আটটাতেই অনুষ্ঠান শুরু করব, ভিড় হবে, কাজেই সাতটার মধ্যে চলে এসো। তারা সেই কথাই শুনেছে।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাতটার মধ্যে চলে এসেছে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরী আর এসেছেন তাদের অভিভাবকেরা। কিন্তু তারও আগে, ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে এসেছে আড়াই শ কিশোর-কিশোরী, যারা স্বেচ্ছাসেবকের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক মানে স্বেচ্ছাসেবকই, নিজের ইচ্ছায় সেবা করতে চেয়েছে যারা।

এই ছেলেমেয়েদের দেখে, প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ, আমি খুব সচেতনভাবে লিখছি এবং জোর দিয়ে বলছি, আমাদের এই কিশোর তরুণ বালকবয়সী স্বেচ্ছাসেবকদের দেখে আমার সমস্ত হতাশা কেটে গেছে, আমার মনে হয়েছে, এদের জন্যই পৃথিবী এখনো বাসযোগ্য রয়ে গেছে, জীবন সত্যি সুন্দর এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল।

হাওর বার্তার স্বেচ্ছাসেবকেরা স্কুল-কলেজের ছাত্র ও ছাত্রী। তারা ভোর সাড়ে ছয়টার মধ্যে চলে এসেছে মাঠে, বৃষ্টি উপেক্ষা করে। মাঠভরা পানি আর আমি পা রাখতেই দেখলাম, জুতাজোড়া ডুবে গেল কাদার মধ্যে। আর আমার স্বেচ্ছাসেবক কিশোর-কিশোরীরা সেই বৃষ্টি আর কাদার মধ্যে অবিচলভাবে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। যাকে যেখানে থাকতে বলা হয়েছে, সে সেখানে ‘ডিউটি’ করছে। কারও কাজ গেটের প্রবেশপত্র পরখ করা, কারও কাজ স্টল সামলানো, কেউবা দায়িত্ব পেয়েছে কর্মশালার মঞ্চের, কেউবা মূল মঞ্চে। তারা কেউ তাদের জায়গা থেকে নড়ছে না, এক মুহূর্তের জন্য সরছে না।

আমরা অনুষ্ঠান যথারীতি আটটার দিকেই শুরু করে দিতে পারলাম। নজরুলসংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরার একটা গানের দল আছে, সুর সপ্তক, তাদের ছেলেমেয়েরা লাল-সবুজ পোশাক পরে মঞ্চ দখল করে গাইল জাতীয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা। তারপর উদ্বোধনী পর্বে মঞ্চে এলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ফরিদুর রেজা সাগর, অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মান্নান ভুঁইয়া, মিনার আর আয়মান সাদিক।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বললেন, বাংলা ভাষায় দুটি শব্দ আছে, একটা হলো ‘পণ্ড’, একটা হলো ‘ভন্ডুল’। সকাল থেকে বৃষ্টি দেখে ভাবছিলাম, ওই শব্দগুলো বুঝি আজকে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এই অদম্য কিশোর-কিশোরীরা বরং ওই শব্দগুলোকেই পণ্ড আর ভন্ডুল করে দিল। আসলেই তো। ওরা যেন গাইছে, ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে।

এ তো বলছি ২০ অক্টোবরের কথা। কিন্তু তারও আগের সপ্তাহে, ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রামে, নাসিরাবাদ বালক উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠেও ভেঙে পড়েছিল চট্টগ্রামের কিশোর-তরুণেরা। এবার প্রথমবারের মতো আমরা কিআনন্দ উৎসব করছিলাম ওখানে। বিকেলের দিকে পুরো মাঠে মানুষ আর মানুষ। ছেলেমেয়েরা এসেছে, এসেছেন তাদের বাবা-মায়েরা। এত ভিড় দেখে পুলিশ এসে বলছিল, আপনারা তাড়াতাড়ি শেষ করে দিন, আর মেয়েদের পরে যেতে বলুন। আমি তখন ‘বুদ্ধি’ করে বললাম, অনুষ্ঠান শেষ, তবে মেয়েরা থাকো, কারণ গণিত নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কিছু কথা আছে, তিনজন মেয়ে মঞ্চে এসো, আচ্ছা বলো, তুমি বড় হয়ে কী হবে, এটা কি সত্যি যে মেয়েরা গণিতে ভয় পায়! এই গুরুত্বপূর্ণ ‘টক শো’র আসল উদ্দেশ্য মাঠ খালি করে দেওয়া, কিন্তু মাঠ কি আর খালি হয়! এক ঘণ্টা লেগেছিল শুধু মাঠ থেকে দর্শনার্থীদের বেরোতে।

আর ঢাকায়? ঢাকার কিআনন্দের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়েছিল, আর সঙ্গে করে আনতে হবে অক্টোবর সংখ্যার কিশোর আলোর কুপন। সাত দিন আগে ১৫ হাজার নিবন্ধন শেষ। তখনো ছেলেমেয়েরা দাবি করে চলেছে, আরও নিবন্ধনের সুযোগ দিন। দুই দিনের জন্য বাড়াতেই আরও ৭ হাজার নিবন্ধন। এর সঙ্গে অভিভাবকেরা এলে মাঠে তো আর জায়গা হবে না। আমরা নিবন্ধন বন্ধ করে দিলাম। তারপর থেকে শুরু হলো ভীষণ ছোটাছুটি, কীভাবে কিআনন্দে ঢোকার প্রবেশপত্র জোগাড় করা যাবে, এ যেন সোনার হরিণ, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তদবির আসতে লাগল—দুটো প্রবেশপত্র কি হবে?

২০ অক্টোবর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মূল মঞ্চে উঠলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছেলেমেয়েরা মঞ্চে উঠে তাঁকে প্রশ্ন করতে লাগল।

সায়ীদ স্যার পুরান ঢাকার পাখা বিক্রেতার গল্পটা প্রায়ই বলেন। এবার কিআনন্দ উৎসবেও তাঁকে গল্পটা বলতে অনুরোধ করলাম।

পাখা বিক্রেতা পাখা বিক্রি করে। একটার দাম এক টাকা, একটার দাম দশ টাকা। এক লোক এক টাকার পাখা কিনে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বাতাস করতে গেছে, অমনি পাখা গেছে ভেঙে। তখন সে পাখাওয়ালাকে এসে অভিযোগ করছে, কী মিয়া, কী পাখা দিলা, ভেঙে যায়।

পাখাওয়ালা বলল, কোনটা কিনছিলেন? এক টাকারটা না দশ টাকারটা।

এক টাকার পাখা দিয়া বাতাস করার নিয়ম, পাখা সোজা কইরা ধইরা মাথা ডাইনে বামে নাড়াইবেন, খবরদার পাখা নাড়াইবেন না।

স্যার বলেন, তোমরা যদি পাখা বানাও, দশ টাকারটা বানাবে। যদি ডাক্তার হও, সবচেয়ে ভালো ডাক্তার হবে। যদি লেখক হও, সবচেয়ে ভালো লেখক হবে। যদি গাছে ওঠো, মগডালে উঠবে।

যে কাজই করো, সবচেয়ে ভালোভাবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে করবে, যাতে উৎকর্ষের চূড়া ছুঁতে পারো।

মঞ্চে কত মজা হচ্ছে, লেখকদের কাছ থেকে জানা হলো লেখালেখির কৌশল, চলচ্চিত্র আর অভিনয় নিয়ে কথা বললেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী আর তিশা, হলো চিরকুটের গান। আরেক মঞ্চে হচ্ছে ছড়াপাঠের আসর, আয়মান সাদিকের কর্মশালা। কিন্তু স্টলে কিংবা গেটে যে কিশোরেরা ‘ডিউটি’ করছে, তারা কেউ মঞ্চের দিকে আসছে না। তারা তাদের পোস্টে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কর্তব্য পালন করে চলেছে। ‘ডিউটি’ আর ‘কর্তব্য’ শব্দ দুটোও আমি সচেতনভাবে ব্যবহার করছি। আমাদের শিশুদের কর্তব্যবোধ কী রকম প্রখর। যে ‘ডিউটি’ তাদের দেওয়া হয়েছে, তা পালনে তারা কী রকম বদ্ধপরিকর। চিরকুটের গানের সময় শ্রোতারা আকুল হলো, তারা মঞ্চের দিকে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো ছুটে আসতে চাইছে আর আমাদের কিশোর স্বেচ্ছাসেবকেরা হাতে হাত ধরে শিকল বানিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঁধ হয়ে তাদের সামলাচ্ছে। আমি কী বলব! এই দৃশ্য যদি আপনারা দেখতেন, আপনাদেরও আমার মতো বলতেই হতো, বলতেই হতো—যে বাংলাদেশ এই ছেলেমেয়েদের জন্ম দিতে পেরেছে, সেই বাংলাদেশ চির অপরাজেয়, সেই বাংলাদেশ একদিন বিশ্বজয় করবেই।

যদিও আমরা পুলিশ, র‍্যাব, বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা, প্রথম আলো ইভেন্টস, বন্ধুসভা, ক্রসওয়াক নামের সংস্থার কর্মীদের দিয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ব্যবস্থা রেখেছিলাম, কিন্তু আমাদের আস্থা ছিল কিশোর ভলান্টিয়ারদের ওপরই, আর তারা আমাদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে বহুগুণ।

আমাদের এক স্বেচ্ছাসেবক ফেসবুকে লিখেছে:

‘শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করেছি। একে “হাই” বলিনি, ওকে পাত্তা দিইনি, তার খোঁজ করিনি, এসব অভিযোগও এসেছে—বন্ধুরা, আমিও দুঃখিত কাউকে হাই দেওয়ারও সময় পাইনি। এই টি–শার্ট এবং আইডি কার্ড অনেক বড় একটা দায়িত্ব। এটার অবমাননা করিনি।

‘একটা জিনিস আমার খুব ভালো লাগল। আমি যখন আমার ১০ ফুটের ভেতরের ময়লা কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলছিলাম, আমার দেখাদেখি একটা বাচ্চাও সেই কাজটা করল। সব জোনের লিডার, ভলান্টিয়ারদের আত্মোৎসর্গের কারণেই এত নিম্নচাপের মধ্যে স্কুল-কলেজপড়ুয়া বাচ্চাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে কিআ পাঠকদের মহোৎসব কিআনন্দ।

‘কাজ করতে গিয়ে ভলান্টিয়াররা বৃষ্টিতে ভিজেছে, কাদায় পিছলে পড়েছে, জ্বর বাঁধিয়েছে, তবু দায়িত্ব ফাঁকি দেওয়ার
বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি কেউ। শুধু ওই বৃষ্টিটা না থাকলেই এবারের কার্যক্রম, এবারের নিয়মকানুন, এবারের কিআনন্দ হতো অসাধারণ।—এশনা বিনতে আলী।’

আরেকজন কিশোরের লেখা পড়ুন:

‘কিআনন্দ শেষে বাসায় আসছিলাম। দোয়েল চত্বরের সামনে থেকে বাসে না উঠে ভাবলাম একটু হেঁটেই নিই বৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ফুলের দোকানের পাশে একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা নারী প্রচণ্ড শীতে কাঁপছেন। দেখে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, দুই দিন ধরে তিনি কিছু খাননি। আর অনেকক্ষণের বৃষ্টিতে তার ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল বুঝতে পেরেছিলাম। পাশের দোকান থেকে কিছু ফল আর রুটি কিনে খাইয়েছিলাম। তিনি আমাকে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। খুবই আনন্দ লাগছিল তাঁর মুখে হাসি ফোটাতে পেরে।

‘তখনই আজকে কিআনন্দে আয়মান সাদিকের কথাটা মনে পড়ে গেল, যে প্রতিদিন অন্তত একজন মানুষকে খুশি করো। তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন, যা তাঁর চোখে ফুটে উঠেছিল।

‘এই বিশাল পৃথিবীতে আমার এইটুকু সাহায্য হয়তো কিছুই না, কিন্তু সত্যিই এই ভেবে আমার দিনটা আজকে অনেক ভালো কেটেছে।—সাবা সিদ্দিকা সুপ্ত।’

প্রিয় পাঠক, এই শিশু-কিশোরেরা এই বাংলাদেশে সুদিন আনবে কি না আপনিই বলুন।

আজ আমরা কিআনন্দ নিয়ে যাচ্ছি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। আমরা জানি, কালিহাতীতেও আমরা একই প্রেরণা পাব।

আনিসুল হক