গরুতে ঢুকছে বিষ মোটাতাজাকরণ প্রতিযোগিতা কোরবানি সামনে রেখে

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন পশু পালনকারীরা। ভালো দামের আশায় তারা দিনরাত পশু পরিচর্যা করছেন। তবে একশ্রেণীর অসাধু পশু পালনকারী গরু মোটাতাজাকরণে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ওষুধ। অধিক মুনাফার লোভে তারা গরুতে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন বিষ। এসব গরুর মাংস খেলে কিডনি, হৃৎপিন্ড, পাকস্থলীতে জটিল রোগ হতে পারে। কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে মানবদেহের নানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের। এখনই ব্যবস্থা না নিলে মানবস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ব্যুরো ও সংবাদদাতাদের খবর-

রাজশাহী : বিভিন্ন উপজেলায় গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর ট্যাবলেট ব্যবহার করছেন অসাধু পশু পালনকারীরা। রোগাক্রান্ত কিংবা কম ওজনের গরু, ছাগল ও মহিষের দ্রুত ওজন বাড়াতে ‘পাম’ বড়ি খাওয়াচ্ছেন তারা। বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর পলাশী ফতেপুর, দাদপুর কালিদাস খালীসহ চর এলাকায় পশুকে এসব বড়ি খাওয়ানো হচ্ছে। এছাড়া গোদাগাড়ী উপজেলায় স্টেরয়েড, প্রি-ডেক্সানল, ডেক্সামেথাসন, বেটামেথাসন, পেরিঅ্যাকটিন, প্যারাডেক্সা ও ওরাডেক্সান বড়ি গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে। এতে অল্প দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠছে গরু। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে এখানকার অনেক কৃষক ও গরু খামারি নিষিদ্ধ ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গোদাগাড়ীতে ১২৫টি গরু খামার রয়েছে; মহিষের খামার আছে ৭৭টি। একটি খামারে গরু-মহিষের সংখ্যা ১০ থেকে ৩০টি। এসব খামারের প্রায় সব ক’টিতেই ওষুধ খাইয়ে ও ইনজেকশন প্রয়োগ করে গরু-মহিষ মোটাতাজা করা হচ্ছে। এছাড়া একশ্রেণীর ‘মৌসুমি খামারি’ নিষিদ্ধ ওষুধ ও ইনজেকশন প্রয়োগ করে বাড়িতে গরু মোটাতাজা করছেন। আর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর তাদের নীরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান তো দূরের কথা, সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার কিংবা উঠান বৈঠকও করেন না তারা।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের সামনের ফার্মেসি কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটবাজার- সবখানেই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে গরু মোটাতাজাকরণের নিষিদ্ধ ওষুধ। ১৭ আগস্ট ১৬ হাজার ৬০০ পিস গরু মোটাতাজাকরণের নিষিদ্ধ ওষুধসহ তানোরের মু-ুমালা বাজারে গোদাগাড়ীর দুই ব্যবসায়ীকে আটকও করেছে র‌্যাব।

জানা গেছে, আটক ওই দুই ব্যক্তির মতো গোদাগাড়ীতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি সক্রিয় আছেন, যারা ভারত থেকে বিভিন্ন গ্রুপের নিষিদ্ধ গরু মোটাতাজাকরণের ওষুধ আমদানি করে গোটা উপজেলায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। গরু মোটাতাজাকরণের কয়েক ধরনের পাউডার ফেরি করে গ্রামে গ্রামে গিয়েও বিক্রি করছেন অনেকে। গরু মোটাতাজাকরণের আগে ওষুধ গোপনে বিক্রি হলেও ইদানীং পশু চিকিৎসকরা গরু খামারিদের হাতে প্রকাশ্যেই এসব ওষুধ ধরিয়ে দিচ্ছেন। আর অল্প দিনে বেশি লাভের আশায় খামারিরাও এসব ওষুধ কিনে খাওয়াচ্ছেন।

গোদাগাড়ীর মা-ইলের মৌসুমি গরু খামারি সেরমাহমুদ আলী জানান, প্রতি বছর তিনি ঈদুল ফিতরের পর তুলনামূলক কম দামে প্রাপ্তবয়স্ক রোগা-চিকন গরু কেনেন। তারপর গরুকে স্টেরয়েড ও ডেক্সামেথাসন গ্রুপের ওষুধ খাওয়ান। আর এতেই সর্বোচ্চ দেড় মাসের মধ্যে গরু হয়ে ওঠে মোটাতাজা ও আকর্ষণীয়। দুই মাস আগে যে গরু ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় কেনেন, কোরবানির ঈদের বাজারে সেসব গরু ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করা যায়।

সেরমাহমুদ আলীর মতে, গরু মোটাতাজা করার ‘ব্যবসা’ দারুণ লাভজনক। তাই তিনি প্রতি বছরই চার থেকে পাঁচটি গরু মোটাতাজা করে কোরবানির হাটে তোলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজাবাড়ীহাট এলাকার এক খামারি জানান, গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সারা বছর গরু পালন করে তেমন লাভ হয় না। এ কারণে অনেক খামারি কোরবানি ঈদের দিকে চেয়ে থাকেন। ঈদ সামনে ঘনিয়ে এলেই শুরু হয় গরু মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতা। এজন্য বিভিন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ, ওষুধ ও ইউরিয়া সার খাওয়ানো হয় গরুকে। আর এতেই অল্প সময়ের মধ্যে ফুলে-ফেঁপে ওঠে গরু। ওই খামারি দাবি করেন, বিষয়টি প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও জানেন। তারা এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা দেখান না। গরু মোটাতাজা করতে অনেক সময় তারাই বিভিন্ন ওষুধের নাম লিখে দেন। তাই বিষয়টিকে বৈধ বলেই ধরে নিয়েছেন গরু খামারিরা।

গোদাগাড়ী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, তিনি কখনও ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজা করার জন্য খামারিদের পরামর্শ দেননি; বরং তাদের সচেতন করতে তিনি নিয়মিত উঠান বৈঠকের আয়োজন করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পশু পালন কর্মকর্তা ডা. হোসেন আলী জানান, ওষুধ খাইয়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে কয়েক ধরনের দুরারোগ্য ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ারও। তাই অন্তত কোরবানির পশুহাটে ওষুধ খাইয়ে মোটাতাজা করা পশু চিহ্নিত করে হাট থেকে সেসব নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

বাঘা : উপজেলার ভেটেরিনারি ওষুধ ব্যবসায়ীরা পাম বড়ির নামে হলুদ ও সাদা রঙের এক ধরনের খোলা বড়ি বিক্রি করছেন। পশু ব্যবসায়ী ও পশু পালনকারীরা এগুলো গরুকে খাওয়াচ্ছেন। এর মধ্যে ভারতীয় পারকোটিন, থাইল্যান্ডের মাইকোটিন ও ডেক্সাউইন এবং দেশি ডেক্সামেথান জাতীয় স্টেরয়েড, ডেকাসন ও ডি-কর্ট পাম বড়ির তালিকায় রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, ১০টির এক পাতা দেশি বড়ির দাম ৫ থেকে ৬ টাকা। বিদেশি খোলা বড়ির দাম সস্তা হওয়ায় সেগুলো বেশিরভাগ খাওয়ানো হয়। প্রতি বছর কোরবানির আগে এসব ওষুধের চাহিদা বাড়ে।

বাঘা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকতা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, পাম বড়ি খাওয়ানোয় এক মাসের মধ্যে পশুর শরীর মোটা দেখাবে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে ওই পরিমাণ মাংস বা ওজন বাড়বে না। এসব বড়ি খাওয়ানোয় পশুর মাংস স্বাদহীন হয় এবং রঙ পরিবর্তন হয়। এসব পশুর মাংস খেলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, যেসব পশুকে এ বড়ি খাওয়ানো হয়, সেসব পশুর মাংস খেলে মানবদেহে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

লক্ষ্মীপুর : কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বিষাক্ত প্রক্রিয়ায় অর্ধশতাধিক খামারে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। ঈদ যতই এগিয়ে আসছে, খামারিদের প্রতিযোগিতা পাল্লা দিয়ে ততই বাড়ছে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দ্রুততম সময়ে গরু মোটাতাজা করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভের আশায় বিপজ্জনক সর্বনাশা এ খেলায় মেতে উঠেছে তারা। জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরে প্রায় গরুর ২৮২টি খামার রয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর ১৮০টি, রামগঞ্জে ৩৫, রায়পুরে ২৬, কমলনগরে ২০ এবং রামগতিতে ২০টি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এর মধ্যে সদরের শাকচর, মজু চৌধুরীর হাট, চররমণী, ভবানীগঞ্জ, তেয়ারীগঞ্জসহ অর্ধশতাধিক খামারে স্টেরয়েড জাতীয় ডেকাসন, ওরাডেক্সন, প্রেডিনিসোলোন, বেটনেনাল, কর্টান, অ্যাডাম-৩৩, পেরিঅ্যাকটিন, অ্যানাবলিক স্টেরয়েড ট্যাবলেট ও ইনজেকশনের মাধ্যমে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। এসব গরুর মাংস খাওয়ার ফলে কিডনি, লিভার, হৃৎপি-সহ মানবশরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এতে বিদ্যমান উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ মানবশরীরে বেশি মাত্রায় জমা হলে মানুষের বিপাকক্রিয়ায়ও প্রভাব পড়ে এবং মানুষও মোটাতাজা হতে থাকে বলে জানান চিকিৎসকরা।

কিশোরগঞ্জ : কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পশু পালনকারীরা গরু মোটাতাজাকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে। তবে স্টেরয়েডসহ নানা জাতের ওষুধ প্রয়োগে নয়, ঘাসসহ স্বাভাবিক খাদ্য খাইয়ে পশুকে মোটাতাজাকরণের কাজ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিরাপদ গোমাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। কেউ যাতে পশুখাদ্যে গ্রোথ হরমোন ও স্টেরয়েড ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে নজরদারি রাখা হচ্ছে।

মৌলভীবাজার : ঈদ সামনে রেখে গরু খামারিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপযুক্ত মূল্যে পেতে যত কষ্টই হোক গরুটিকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান করে তুলতে হবে। তবে অন্যদিকে দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কায় রয়েছেন তারা। বেশি মুনাফার লোভে বিষাক্ত ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ব্যবহার করে মোটাতাজা করে কেউ বাজারে ছাড়ে কিনা, সে বিষয়ে চিন্তায় রয়েছেন তারা। মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোঃ হেদায়ত উল্লাহ জানান, ইনজেকশন ও ট্যাবলেট ব্যবহার করে এলাকায় গরু মোটাতাজাকরণের নজির নেই। এক সময় সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের ঘটনা হতো।

সীতাকু- : ঈদ সামনে রেখে বাড়িতে বাড়িতে চলছে খামারিদের গরু মোটাতাজাকরণ। প্রায় ১৯৬ খামারি বাড়িতে দুই থেকে তিনটি করে গরু মোটাতাজা করছেন। এর বাইরেও শত শত কৃষক গরু মোটাতাজা করছেন। তবে তারা ক্ষতিকর ওষুধ ও ইনজেকশন ব্যবহার করছেন না বলে জানা গেছে।

লোহাগাড়া : অনেকেই বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে কোরবানি ঈদ সামনে রেখে গরু মোটাতাজা করছেন। তবে চট্টগ্রামের এ উপজেলায় এ বছর গরু মোটাতাজাকরণের সংখ্যা অর্ধেক। গেল বছর এখানে মোটাতাজাকরণ গরুর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর