হাওর বার্তা ডেস্কঃ সম্প্রতি ২০১৬ সালের খানা জরিপ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই জরিপে কুড়িগ্রাম সবচেয়ে গরিব জেলার স্থানে ঠাঁই পেয়েছে। ২০১০ সালের দারিদ্র্য-মানচিত্র যৌথভাবে প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও বিশ্বব্যাংক। এ মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। তখনো কুড়িগ্রাম ছিল সবচেয়ে দরিদ্র জেলা। তখন সারা দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ শতাংশ। এ বছর তা কমে হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের গড় দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। আর কুড়িগ্রামের গড় দারিদ্র্য ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের গড় দারিদ্র্য যখন কমেছে, তখন কুড়িগ্রামের গড় দারিদ্র্য বাড়ছে কেন?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ সম্পদ। এতে বোঝা যায় দেশের গড় উন্নয়ন কতটা বৈষম্যমূলক। নারায়ণগঞ্জে গরিব মানুষের সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দারিদ্র্য-মানচিত্রে সবচেয়ে গরিব এবং কম গরিব দুটি জেলার পার্থক্য দেখলে বোঝা যায় উন্নয়নবৈষম্য কতটা ভয়াবহ। সরকার যে উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণে সচেষ্ট নয়, এটা তার প্রমাণ। কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের প্রধান কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রাকৃতিক কারণ
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ১৬টি। বাস্তবে কুড়িগ্রামে নদ-নদীর সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। প্রতিবছর বর্ষায় বন্যা হয়। এই বন্যায় হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে যে হারে মানুষ স্বাবলম্বী হয়, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ গৃহহীন হয়।
রাজনৈতিক কারণ
রাজনৈতিকভাবে কুড়িগ্রাম চরম অবহেলার শিকার। যে নয় বছর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন, তখন কুড়িগ্রামে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বিএনপির প্রথম পাঁচ বছর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল। এ সময়ে কুড়িগ্রামের সব আসনে সাংসদ ছিলেন জাতীয় পার্টির। ফলে বিএনপি সরকার কুড়িগ্রামে কোনো উন্নয়ন করেনি। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তখন কুড়িগ্রামে সাংসদ ছিলেন জাতীয় পার্টির। ফলে গড় উন্নয়ন কুড়িগ্রামে হয়নি।
২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছে বিএনপি। তখনো কুড়িগ্রামের সাংসদ জাতীয় পার্টির। উন্নয়ন থেকে তখনো বঞ্চিত কুড়িগ্রাম। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন সরকারি দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টি ছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টি এতটাই ক্ষমতাহীন যে তাদের পক্ষে কোনো কিছু আদায় করা অসম্ভব। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আবারও জাতীয় পার্টি কুড়িগ্রামের আসনগুলোতে জয়ী হয়। এই জাতীয় পার্টির সাংসদ যাঁরা আছেন, তাঁরা নিজেদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের কেউ কেউ কখনো কখনো দল পরিবর্তন করলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিতেই ফিরেছেন। এঁরাই কুড়িগ্রামের উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কুড়িগ্রাম সদরের সাংসদ তো এ বছর সর্বকালের ভয়াবহ বন্যায় একবারের জন্যও বন্যার্ত মানুষের খোঁজ নিতে আসেননি।
ভৌগোলিক কারণ
ভৌগোলিকভাবে কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা। রাজধানী ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের দূরত্বও অনেক। প্রায় সাড়ে চার শ কিলোমিটার। সড়কপথের যোগাযোগই প্রধান অবলম্বন। গত বছর একটি শাটল ট্রেন দিয়েছে ঢাকাগামী একটি ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত করে। সম্ভবত দয়া করে!
উপার্জনের উৎসের অভাব
কুড়িগ্রামে শিল্পকারখানা নেই। একটি টেক্সটাইল মিল ছিল, সেটি এখন বন্ধ। কুড়িগ্রামের মানুষ প্রধানত কৃষিনির্ভর। সেই কৃষিও বন্যায় ভেসে যায়। ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না কৃষক। সরকার যখন ধান-গম-পাট ক্রয় করে, সেগুলো যায় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে। দেশের উন্নয়নের একটি বড় উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের আয়। কুমিল্লা, সিলেটের একটি পাড়ায় যতজন বিদেশে থাকেন, সমগ্র কুড়িগ্রামেও ততজন প্রবাসে থাকেন কি না সন্দেহ।
সম্ভাবনাময় কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের যেকোনো জেলার চেয়েও সম্ভাবনাময় জেলা। কুড়িগ্রামে যে সোনাহাট স্থলবন্দর আছে, সেই স্থলবন্দরটি কাজে লাগানো গেলে কুড়িগ্রামের তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সোনাহাট বন্দরের সঙ্গে রেল-সড়ক এবং জলপথে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। ভারতের সেভেন সিস্টারস খ্যাত সাতটি রাজ্যের সঙ্গে এ বন্দর দিয়ে যোগাযোগ সহজ। কুড়িগ্রাম জেলার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। কুড়িগ্রামে শিল্পকারখানা স্থাপন করলে এখানকার সাধারণ মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানমালিক উভয়ই লাভবান হবেন।
সরকারের অবহেলা
দেশের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়া সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন না করে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে আরও পশ্চাৎপদ করা সংবিধানের পরিপন্থী কি না ভাবা প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে কুড়িগ্রামের প্রতি চরম অবহেলা দেখানো হয়। প্রতিবছর নদীভাঙনের বিষয়ে সরকার থাকে চরম উদাসীন। এ বছরের বন্যায় যেসব সড়ক ভেঙে গেছে সেসব সংস্কারে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেই। বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় শ কোটি টাকারও বেশি। অথচ সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। প্রতিবছর যে বন্যা হয় তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, যদি সরকার নদীগুলোর প্রতি যত্নবান হতো। কুড়িগ্রাম বলে একটি জেলা যে আছে, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা স্বীকার করা হয় কি না জনমনে সন্দেহ আছে। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী কি কখনো ভেবে দেখেছেন কুড়িগ্রামের মানুষের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিদেশে পাঠানো যায় কি না? আমাদের শিল্পমন্ত্রী কি কুড়িগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠার কথা একবারও ভেবেছেন? আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী কি কুড়িগ্রামে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছেন? আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী কি কুড়িগ্রামের করুণ চিত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছেন? আমাদের অর্থমন্ত্রীর কি কুড়িগ্রাম নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে?
সরকারের কাছে প্রশ্ন
কুড়িগ্রামের সাংসদেরা কুড়িগ্রামের জন্য কোনো দাবি উত্থাপন করেন না। খাদ্যের মঙ্গা কমলেও সাংসদদের চিন্তার মঙ্গা তো কমেনি। প্রায় প্রতিটি পরিসংখ্যানে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের চিত্র পাওয়া যায়। যখন যাঁরাই প্রধানমন্ত্রী হন, তাঁরা কি প্রভাবশালী সাংসদের এলাকার প্রধানমন্ত্রী? তাঁরা কি আমাদের সবার প্রধানমন্ত্রী নন? সরকারি প্রতিষ্ঠানই তো দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশ করে। তাহলে না জানার তো কোনো কারণ নেই। কুড়িগ্রামবাসীর উচিত ছয়-সাতবারের সাংসদদের জবাবদিহি করা।
কুড়িগ্রামের প্রতি সদয় হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত দুই মেয়াদে তিনবার কুড়িগ্রাম এসেছেন। তিনি একটি অর্থনৈতিক জোন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং চিলমারী নৌবন্দর সচলের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কাজের কোনো অগ্রগতি
নেই। এখানকার উন্নয়নবৈষম্য দূর করার জন্য বিশেষ বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই। কুড়িগ্রামের উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণে রাষ্ট্রচালকেরা শিগগিরই কোনো ঘোষণা দেবেন, এটাই কুড়িগ্রামবাসীর প্রত্যাশা।