হাওর বার্তা ডেস্কঃ সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা যায়, বন বিভাগের তিন থেকে চার হাজার একর জমিতে একটি স্থানে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আবাসন গড়ে তোলা হবে। এটি কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের খুব কাছাকাছি। রাজাপালং ও পালংখালী ইউনিয়নের আওতায়। এর হয়তো বেশ কিছু ইউনিট, সাব-ইউনিট থাকবে। তবে একই এলাকায়। বিষয়টি রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার বিপরীত হচ্ছে। যারা শরণার্থী হয়েছিল ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে, তাদের জন্য যথাক্রমে ১৩ এবং ১৫টি শিবির গড়ে তোলা হয়েছিল। আর তা ছিল টেকনাফ উপত্যকারই বিভিন্ন স্থানে। এসব শিবিরে ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও চিকিৎসক, পুলিশ, আনসার সবই ছিল। প্রতিটি শিবিরের জন্য ছিল ত্রাণভান্ডার। এবার সবাইকে একসঙ্গে রাখার পক্ষে কি যুক্তি তা বোধগম্য নয়। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনা কার্যক্রম সব সময়ই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গারা নিজেদের মাঝে, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে এমনকি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত। কখনো গুলি চালিয়ে প্রাণহানির মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছে। তখন একেকটি শিবিরে থাকত ২৫ থেকে ৩০ হাজার। আর এখন ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে একত্রে রাখার আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত দিকটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি না বোধগম্য নয়।
তা ছাড়া দাতা সংস্থাগুলো বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সংস্থা ইউএনএইচসিআর এভাবে এত লোককে একত্রে রাখা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ ঘটাতে পারে বলে সতর্ক করেছে। ছোঁয়াচে রোগ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। স্থানীয় হাটবাজারসহ অন্যান্য অবকাঠামোয় চাপ পড়বে মাত্রাতিরিক্ত। তৃতীয় কোনো পক্ষ যাতে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে রোহিঙ্গাদের প্ররোচিত না করতে পারে, সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজরদারির জন্য এমনটা করা হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। ব্যাপারটির বরং বিপরীত দিক রয়েছে। তুলনামূলক ছোট শিবিরে এ–জাতীয় কর্মকাণ্ড নজরদারির সুযোগ অনেক বেশি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবারই সুযোগ থাকে জোরালো দৃষ্টি রাখার। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে অনেক বেশি। আর এ–জাতীয় পরিস্থিতিতে ভয়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে পদদলিত হতে পারে অনেকে। এসব খুঁটিনাটি বিষয় হলেও বিবেচনার দাবি রাখে। তা ছাড়া ইতিপূর্বে যাদের শরণার্থী মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তারাও কি এখানে আসবে? তাদের ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কিছুই তো পৃথক। একই শিবিরে কি নিয়ে আসা হবে ৫০০ হিন্দু সম্প্রদায়ের আশ্রয় প্রার্থীকে? তাদের নিরাপত্তা বিধান এভাবে নিশ্চিত করা যাবে কি না? এসব বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি সবার জানা। আর এ আগমন মাত্রার তারতম্যভেদে এখনো চলছে। এক মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে হতভাগ্য মানুষগুলো এসেছে আমাদের দেশে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবরণ অনুযায়ী নিজ দেশে তারা শোচনীয় মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছে। সহায়তা দিতে কোনো আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাকে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না এদের কাছে। তাই তারা চরম খাদ্যসংকটেও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। এ অবস্থায় পাড়ি জমায় বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপত্যকায়। প্রথম স্থান নিয়েছিল মহাসড়কের দুই ধারে উন্মুক্ত স্থানে। এখন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় আপাতত বিভিন্ন স্থানে পলিথিন বা ত্রিপলের ছাউনিতে বসবাস করতে পারছে। খাবারও জুটছে এসব উৎস থেকে। তবে পয়োনিষ্কাশন, পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আমাদের জনবহুল দেশটির দুটো উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এবার আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যাই তাদের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া গত কয়েক বছর বিভিন্ন সময়ে আসা ১ লাখ রোহিঙ্গা নিজ থেকেই কুঁড়েঘর করে বাস করছে এখানে। আছে ১৯৯২ সালে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে প্রত্যাবাসন না হওয়া অবশিষ্ট ৩৪ হাজার। তারা থাকে কুতুপালং ও নয়াপাড়া নামক দুটো শিবিরে। তবে এরা ছাড়া অন্য রোহিঙ্গাদের সরকার শরণার্থী বলে স্বীকার করছে না। এদের আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার সমন্বয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে ইউএনএইচসিআরের পরিবর্তে আইওএম (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেন্টস) নামের সংস্থাকে।
ব্যবস্থাটা অত্যন্ত সাময়িক হলেও আসল কথা হলো রোহিঙ্গারা এখন যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় রাখা চলে না। সমস্যা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে। আমরা সবাই তা চাই। কিন্তু খুব সহজভাবে হবে এটা মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তাদের সে দেশে ফিরিয়ে নিতে হলে যে কারণে বিতাড়িত হয়েছে এর গোড়ায় কিছুটা হাত দিতে হবে। মিয়ানমার সরকারের গঠিত কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট সুপারিশ রয়েছে। ১৯৮২ সোলের নাগরিকত্ব আইনে তাদের বংশপরম্পরা
নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। একপর্যায়ে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে জীবন-জীবিকাকে করে তোলা হয় অনিশ্চিত। এ দুটো বিষয়ে মিয়ানমার তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে না সরলে প্রত্যাবাসন দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। সবকিছু মিলিয়ে কিছুটা সময় নেবে সমস্যা সমাধানে। তাই যারা এসেছে তাদের একটি নিরাপদ আবাসন, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি ব্যবস্থাও আমাদের করতে হচ্ছে। দরকার হবে কিছু সংযোগ সড়ক।
পৃথিবীর অনেক দেশের শরণার্থী আছে। যেমন জর্ডান, তুরস্ক, পাকিস্তান ও লেবাননে যথাক্রমে ২৭ লাখ, ২৫ লাখ, ১৬ লাখ ও ১৫ লাখ শরণার্থী আছে। এ দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর কেনিয়ার প্রায় শুষ্ক দাদাব শহরে পাঁচটি শিবিরে ২ লাখ ৪৫ হাজার ১২৬ জন শরণার্থীর আবাসন গড়ে তোলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিবিরের শিরোপায় রয়েছে। পরিকল্পনা অপরিবর্তিত থাকলে অচিরেই উখিয়ার কুতুপালং সে শিরোপা কেড়ে নেবে। দায়িত্বশীল সূত্র থেকে আবার এটাও জানা যায়, এখানে শিবিরটি হবে অস্থায়ী। প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হলে একটি দ্বীপে তাদের স্থানান্তরের ব্যবস্থা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এর আয়োজন করতে দায়িত্ব এবং অর্থ দেওয়া হচ্ছে নৌবাহিনীকে। সে দ্বীপটি এখন পর্যন্ত ভালোভাবে জেগেও ওঠেনি। ভরা জোয়ারে পানি প্রায় সমতলে থাকে। এটাকে হাতিয়া উপজেলার দ্বীপ বলা হলেও ভৌগোলিক নৈকট্য সন্দ্বীপের সঙ্গে। ভাটার সময়ে শুধু ছোট একটি খাল পার হতে হয়।
সন্দ্বীপের লোকদের দাবি, তাদের উপজেলার নেয়ামস্তি ইউনিয়ন ভেঙে এখানে জেগে উঠেছে। সন্দ্বীপের বন কর্মকর্তারা করেছেন বনায়ন। হাতিয়া উপজেলা এ দ্বীপটি থেকে বেশ দূরে। অবশ্য সরকার জেলা–উপজেলার সীমানা পরিবর্তন করতে পারে। তবে তা করা হয় ভৌগোলিক নৈকট্য এবং প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায়। আর মালিকানার প্রশ্নে নদী পয়স্তির নিয়মটা তো এখানে চলে আসবে। কথার কথা, যদি দ্বীপে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করাই হয়, তবে ত্রাণ বণ্টনের জন্য ভিন্ন প্রশাসন হয়তো ইতিমধ্যে কাজ করবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য বিষয় থাকবে সংশ্লিষ্ট জেলা–উপজেলা প্রশাসনের আওতায়। নির্মাণ করতে হবে ব্যয়বহুল বেড়িবাঁধ। ত্রাণকর্মী, চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় জনবল এ প্রত্যন্ত দ্বীপে কাজ করতে অনীহা দেখাবে। বৈরী প্রকৃতির কারণে সময়ে সময়ে বিঘ্নিত হতে পারে ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা।
সবচেয়ে বড় কথা, দ্বীপটি এখনো বাসযোগ্য হয়নি বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আমাদের সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বসমাজে প্রশংসিত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। সামান্য কোনো ভুল পদক্ষেপে সে প্রশংসা বিপরীতমুখী হতে পারে। এমনটা হোক এটা কেউ চায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা এক বেলা খেয়ে হলেও এদের খাওয়াব। তাঁর এ আবেগের সঙ্গে গোটা জাতি সহমত পোষণ করে। রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বড় সহায়তা হবে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপকে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করা। তাদের দ্রুত মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনেই সমস্যার সমাধান রয়েছে। সমস্যাটি সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার আর সমাধানও করতে হবে তাদের।
এর মাঝখানে যেটুকু সময় এ দেশে তাদের থাকতে হবে তার জন্য সব ব্যবস্থাই ধীরে ধীরে হলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। দুর্বল দিককে জোরদারও করা যাবে। তবে সবাইকে এক শিবিরবাসী করার ব্যবস্থা কিংবা দ্বীপান্তরের উদ্যোগ নতুন বিতর্ক সামনে নিয়ে আসছে। এদের স্থান দিয়ে যে মর্যাদা আমরা পেয়েছি, তা বিপন্ন করে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অনুচিত হবে।