হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলাদেশের বন্যা-বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৭ সালের বন্যা ছিল বিরলতম বন্যা। বন্যার গতিবিধি (বিমানের ভাষায় গতি ও অবস্থান) সময়জ্ঞান, স্থান নির্বাচন, ফিরে ফিরে আসা—সবকিছুই তাকে বিরলতম করেছে।
হাওরের নিদান কবে শুরু, কবে শেষ?
শেষ মার্চে হাওর দিয়ে শুরু, হতবাক করে দেওয়া সে বন্যায় ‘নিদান’ শুরু হয় সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত। হাওরের এমন ফসলহানি ঘটেনি আগে কখনো। বন্যার অনেক আগেই ফসলহানির কোনো আভাস ছাড়াই জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এফএও সরকারের খাদ্য বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে এক যৌথ গবেষণায় সুনামগঞ্জকে মারাত্মক খাদ্যঘাটতির জেলা ঘোষণা করেছিল। বন্যা ছাড়া যে জেলা ছিল লাল রঙের বন্ধনীতে, বন্যার নিষ্ঠুরতায় তার অবস্থা এখন কী? কে রাখে সে হিসাব? তত্ত্ব-তালাশের সব গাড়ি এখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে নাফ, টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি। হাওরের মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থার আর কোনো হালনাগাদ নেই।
বন্যার পর সরকার যেসব প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তার গতি ও অবস্থানের কোনো চালচিত্র কারও কাছে আছে কি? বিনা পয়সায় চাল দান (ত্রাণ), কম দামে খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস), খুব সস্তায় চাল বিক্রি (১০ টাকার চাল) এসব কি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেছে? দেখলেও কত দিনের জীবনকাল ছিল এসব কর্মসূচির?
ভাসান জলে মাছ ধরার আন্দোলনের কী হলো? হাওরের কৃতী সন্তান রাষ্ট্রপতির কথা প্রশাসন শুনেছে কি? হাওর নিয়ে সকালে একটা, সন্ধ্যায় একটা বুকফাটা সেমিনারের মিছিল কোন জাদুতে বন্ধ হলো? নাকি সব চুকেবুকে গেছে? সবাই আবার দুধে-ভাতে আছে। একটা বেসরকারি সংস্থা তাদের তালিকাভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে কয়েক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ত্রাণ দিতে গিয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষকে আর খুঁজেই পায়নি। এটা গড় হিসাব, কোথাও কম, কোথাও বেশি। তাহলে তারা গেল কোথায়? কোন রাক্ষসের পেটে পাচার হলো তারা? হাওরে তো হাঙর নেই? ক্ষুধার হাঙর তাদের হাপিস করে দিয়েছে কি? বিশেষ উদ্যোগে কতিপয় স্কুল চালু থাকলেও বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীর আনাগোনা অসম্ভব রকম কমে গেছে। হাওরের দুর্যোগ প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির এক সেমিনারে দেওয়া তথ্য বলছে, প্রায় ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অনিয়মিত হয়ে গেছে। ২৯ থেকে ৩২ শতাংশ শিশু সেই যে বৈশাখের শুরুতে স্কুল ছেড়েছে, আর ফেরেনি। হয়তো ফিরবেও না আর কোনো দিন। তারা কোথায় হারাল? কী করে তারা এখন? সবার তো রিকশা চালানোর বয়সও হয়নি। মেয়েশিশুরা কী করছে? পোশাক কারখানাগুলো তো শিশুদের কাজে নেয় না। তাহলে কোথায়, কোন কাজে তারা এখন জীবনের ঋণ শোধ করছে?
ব্যাংকের তৈরি বন্যা-জলাবদ্ধতা
গত মৌসুমের শুরু থেকে কম বৃষ্টি হলেও এবারও ডুবেছে মণিরামপুর-কেশবপুর। গত বছরে জলাবদ্ধতায় নাস্তানাবুদ হওয়ার পর পৌরসভার ভেতরে আর ধারেকাছে থাকা মানুষেরা অনেকে ভিটের পোতা উঁচু করে নিয়েছিল। শেষ রক্ষা হয়নি। এবারও তাদের সড়কের দুই পাশে এসে রাত কাটাতে হয়েছে। গত বছর মাঠের জল উঠান হয়ে ঘরে ঢুকলে মানুষের কষ্ট বেড়েছিল কিন্তু মাছ পেয়েছিল প্রচুর। ঘের, পুকুর, জলাধার ভেসে যাওয়ায় মাছ হয়েছিল এজমালি সম্পদ। যে ধরবে, তার। জাল, মশারি, বড়শি, ঝুড়ি—যে যা পেরেছে, তা-ই দিয়ে মাছ ধরেছে, খালি হাতেও ধরেছিল অনেকে।
এবার আর সে সুযোগ ছিল না। ঘেরের দেয়াল দুর্গের আদলে উঁচু করে নেন মালিকেরা। সে কারণে আনুপাতিক হারে গত বছরের চেয়ে কম বৃষ্টি হওয়ার পরও আটকে যায় পানি। জলাবদ্ধতা দীর্ঘায়িত হয়। গত বন্যায় মাছ হারানোর পরও কোথায় পেলেন এত টাকা ঘেরমালিকেরা যে কল বসিয়ে ঘেরের পাড় আরও দু-তিন হাত উঁচু করলেন? যে ব্যাংকের টাকায় তাঁদের মাছ চাষ, সেই ব্যাংকই দিয়েছে, সেটা কি ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ায় বন্যা-পরবর্তী সহজ শর্তের (কম সুদের) ঋণ ছিল? ব্যাংকগুলো কোন নীতিতে দ্বিগুণ জলাবদ্ধতার শঙ্কা তৈরি করার খাতে লগ্নি করে? নীতিভ্রষ্টতার চর্চার এ এক অনন্য উদাহরণ।
রেকর্ডের পর্দা-বেপর্দা
গাইবান্ধার বালাশি ঘাটে পানির উচ্চতা এবার সর্বকালের নথিভুক্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অনেক পণ্ডিত ঘোষণা দিয়ে বসেন, এবার ফাটাফাটি বন্যা হবে, ছাড়িয়ে যাবে আটাশির বন্যাকে। কৃষকের আর প্রান্তিক মানুষের কপাল ফাটালেও রেকর্ড ফাটেনি। রেকর্ড না ফাটালেও যে সাধারণ মানুষের কপাল ফাটতে পারে, তার এক উদাহরণ ছিল এবারের বন্যা। এবার ব্রহ্মপুত্রের সম্পূর্ণ পানি এসেছে একটা পথ বা চ্যানেল বেয়ে। সানন্দাবাড়ী থেকে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের পানি ঢোকার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃতি জনপদ বাঁচিয়ে পানিকে সাগরে পৌঁছে দেওয়ার যে বন্দোবস্ত করে রেখেছে, সেটা আমরা গাফেলের দল বন্ধ করে দিয়েছি। এ দেশের ব্রহ্মপুত্রের বন্যা ব্যবস্থাপনার একটা বড় ভিত্তি হচ্ছে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের মুখ। অর্থাৎ সানন্দাবাড়ী মুখের নাব্যতা জারি রাখা। যাদের এটা দেখার কথা, তাদের ঘুমের কারণ কি দুদক দেখবে? হাওরের ঠিকাদারদের টিকি নিয়ে দুদকের নাড়াচাড়ার কথা বেশ জোরেশোরে প্রচারে এসেছিল। আরেক বন্যা মৌসুমের আগেই সানন্দাবাড়ী-বাহাদুরাবাদ মুখ খুলে দিয়ে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রে পানি আসার পথ পরিষ্কার করা দরকার। হাতে সময় চার মাস। গোটা ময়মনসিংহে ভূতলে পানির স্তর ঠিক রাখার জন্যও এটা প্রয়োজন। এই পানি গড়িয়েই শীতলক্ষ্যায় আসে। কে এটা নিশ্চিত করবে? কার দায়িত্ব এত সব খেয়াল রাখার?
নদী তুমি কার?
নদীর অভিভাবক অনেক। ডজনখানেক মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর কোনো না কোনোভাবেই নদীর এজমালি মালিক। ইংরেজিতে ডার্টি ডজন আর বাংলায় বারোভূতের সম্পত্তি নদী। এসব কামড়াকামড়ি থেকে নদীকে বাঁচাতে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট নদী রক্ষা কমিশন গঠন করে নদীর ব্যাপারে শেষ কথা বলার এখতিয়ার দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার প্রায় পাঁচ বছর পর অবসরপ্রাপ্ত বা প্রায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয় নদী রক্ষা কমিশন—কমিশনের বছরে একটা রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়ার কথা। সংসদ কি সেটা কখনো দেখেছে? নদীর পাড়ের মানুষ তো অনেক পরের কথা।
অচেনা দিনাজপুর
কেমন আছে দিনাজপুর-পঞ্চগড়ের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা এখন? তাদের শুধু ফসল আর গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির ক্ষতি হয়নি, বাপ-দাদার গড়া বাড়িঘর চোখের নিমেষে হারিয়ে গেছে। এক প্রবীণ বললেন, ‘পাকিস্তানিরা তাড়া করত, কখনো ঘরে আগুন দিত, তাতে চালটা পুড়ত, আমাদের মাটির বাড়িঘরের দেয়ালকাঠামো দাঁড়িয়ে থাকত। আমরা তার ওপর আবার চাল জুড়ে ঘর বেঁধেছিলাম।’ এখন তো মাটি-ঢেলা ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্রামের পর গ্রাম এখন চষা মাঠ। তারা আর জীবনেও এ রকম মাটির ঘরবাড়ি গড়তে পারবে না। অর্থ, সময় কোনোটাই তাদের হাতে নেই। সস্তা ঢেউটিন দিয়ে একচালা উঠিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করছে তারা।
ত্রাণ নয়, প্রয়োজন নীতি সহায়তার
রাষ্ট্রের ত্রাণ সহায়তার চেয়ে নীতি সহায়তার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি; জনকল্যাণমুখী আর বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে মানুষের প্রয়োজনের কথা মেনে নিয়ে সংস্কার আর নীতিমালা চালু করলেই সাধারণ মানুষ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা যাচ্ছে যাদের জমি আছে, তাদের কাছে। কিন্তু এ দেশের ঘোর বাস্তবতা, যাদের জমি নেই, তারাই ‘আধি’ নিয়ে জমি চাষ করে ফসল ফলায়। আগেও এমনটাই ছিল, যে কারণে এ দেশে তেভাগা আন্দোলন গড়ে ওঠে জনপ্রিয়তা লাভ করে সফল হয়। তখন ফসল কাটার পর ভাগ হতো, এখন আর ভাগাভাগি নেই, মাঠে হাল বাওয়ার আগেই নগদে ফসলের দাম দিয়ে দিতে হয় মালিককে।
এই অন্যায় প্রথা বন্ধ করতে সরকারের কোনো ‘বাজেট’ লাগবে না। কিন্তু একটা বড় কাজ হবে। কৃষককে চড়া সুদে ঋণ করে জমি আধি নিতে হবে না। নীতি সহায়তার আরেক উদাহরণ হতে পারত নির্মাণসামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণ। পাহাড়ধসের পর খুব ত্বরিতগতিতে রাঙামাটিতে প্রশাসন এটা করতে পেরেছিল। দিনাজপুরে পারেনি বা করেনি। সেখানে বন্যার পর প্রতিদিন ঢেউটিন আর সিমেন্টের খুঁটির দাম বেড়েছে, এখনো ঊর্ধ্বমুখী।
আসন্ন বোরো মৌসুমে ওয়াদা মোতাবেক সরকারের অর্থ বা বীজ ইত্যাদি সহায়তা দেওয়ার কথা; কিন্তু বর্তমান নীতিমালায় সে সহায়তা পৌঁছাবে ফসলের আগে ভাগচাষির কাছ থেকে কড়ায়-গন্ডায় নগদে বুঝে নেওয়া জমির মালিকের কাছে। মাঠপর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরা জানেন কার জমি কে চাষ করে। ফলে বন্যা-পরবর্তী কৃষি সহায়তা চাইলেই আসল ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম বন্ধ করার জনপ্রিয় নির্দেশ জারি করে বন্যাবিধ্বস্তō এলাকায় সহজ পুঁজিপ্রাপ্তির পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই বলে তো আর ঋণ নেওয়া বন্ধ নেই। লাভ হয়েছে চড়া সুদের মহাজনদের। কারণ, বন্যার পর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মানুষের প্রয়োজন টাকার, পুঁজির। কাজ খুঁজতে শহরে যেতেও টাকার দরকার হয়।
এবারের বন্যা অনেক ভুগিয়েছে, ভোগান্তির এখনো অবসান হয়নি। আরেক ফসল না ওঠা পর্যন্ত এ ভোগান্তি থাকবে। তবে বাঁধ উপচে বন্যা হয়নি এবার, বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে। বাঁধ টিকল না কেন? যাদের জন্য বাঁধের এই বেহাল, তাদের বিচার কি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা দেখে যেতে পারবে? বন্যা ব্যবস্থাপনার এটাও একটা অংশ। ন্যায়বিচার, জবাবদিহি, আইনের শাসন ছাড়া ন্যায্য বন্যা ব্যবস্থাপনা সম্ভব কি?