ঢাকা ১২:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাছ চাষে বিপ্লব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৫
  • ৩২২ বার

সিলেটের জকিগঞ্জ থানার প্রত্যন্ত এলাকার ‘আমেরিকান ফিশারি’ এখন বৃহত্তর সিলেটে মাছ চাষের সফল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আটজনের ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এ খামার দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে ব্যতিক্রমী অবদান রাখছে। কামালপুর গ্রামে ২১৬ একর জায়গায় শুরু করা ফিশ গার্ডেনটি বর্তমানে চার কিলোমিটার ব্যাপ্তি পেয়েছে। এখানে পুকুরের সংখ্যা ২৪টি। রয়েছে ১৭৫ বিঘা আয়তনেরও পুকুর। এ খামার থেকে প্রতিবছর অন্তত ৬০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। তবে উদ্যোক্তারা জানান, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এখান থেকে বছরে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় হ্যাচারি, পোনা উৎপাদন, পুকুরে পানি বদল ও এয়ার ওয়াটার ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূর ময়মনসিংহ থেকে রেণু পোনা এনে তবেই সম্ভব হচ্ছে মাছ চাষ। এসবি গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহজাহান বাবলুর ব্যক্তি উদ্যোগে ঢাকার মাতুয়াইলে গড়ে তোলা ফিশিং কোল্ডস্টোরেজটি এখন রাজধানীর কয়েক হাজার মাছ ব্যবসায়ীর আশীর্বাদ। ব্যবসায়ীরা এখন আর ফরমালিন মিশিয়ে দিনভর মাছ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন না। বিক্রি না হলেই ফেলনা দামে ক্রেতাকে গছিয়ে দিতে হবে- এমন দুশ্চিন্তায়ও ভোগেন না তারা। বাজার শেষে অবিক্রীত মাছ নিশ্চিন্তে হিমাগারে রেখে আয়েশে বাড়ি ফেরেন তারা। পরদিন আবার সেই মাছ হিমাগার থেকে বের করে বাজারে বিক্রি করেন। দুই হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার এসবি ফ্রিজিং কোল্ডস্টোরেজটি বদলে দিয়েছে রাজধানীর মাছবাজারের দৃশ্যপট। সিলেট, ময়মনসিংহ, যশোর, কুমিল্লার মতো মাছ চাষে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে। আসাদ নামের এক বেকার যুবকের উদ্যোগে তার নিজ গ্রামেই গড়ে উঠেছে ২৭৫টি পুকুর-খামার। গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে মাছ চাষের বিপ্লবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এখন গ্রামটি থেকে প্রতিবছর তিন হাজার ৭০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। এভাবেই ব্যক্তিপর্যায়ে একের পর এক নজির সৃষ্টি করে দেশব্যাপী ‘মাছবিপ্লব’ ঘটিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাদের শ্রম-ঘাম আর একাগ্রতায় দেশের সামগ্রিক চাহিদা মিটিয়েও মাছ রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এই সফলতার ধারাবাহিকতায় মাছ উৎপাদনে বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বেসরকারি খাতের প্রয়াসে বেড়েই চলেছে মাছের উৎপাদন। উত্তরোত্তর বেড়েছে প্রবৃদ্ধি। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এ সময়ে দেশে মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে উন্নীত হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ টনে। এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, এর মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের অবস্থান থাকবে বলে জানানো হয়েছে। ১৯৯০ সালে দেশে মোট চাষকৃত মাছ উৎপাদিত হয়েছিল এক লাখ ৯৩ হাজার টন। ২০০০ সালে তা বেড়ে ছয় লাখ ৫৭ হাজার এবং ২০১৫ সালে এসে তা সাড়ে ১০ লাখ টন ছুঁই ছুঁই করছে। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলা দেশে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে আলোচিত অবস্থান করে নিয়েছে। কুমিল্লার প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মাছ চাষের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোক্তারা। জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ করা মাছের খামার এখন চোখে পড়ার মতো। লাভবান হওয়ায় দিন দিন বিভিন্ন পেশার মানুষসহ এলাকার বেকার যুবকরা মাছ চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। মাছের খামারগুলোর কারণে লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। উৎপাদিত মাছ ভূমিকা রাখছে পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা পূরণে। দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে ‘জাতীয় মৎস্য পদক-২০১৪’ অর্জনকারী শাহজাহান বাবলুও নাঙ্গলকোটের অধিবাসী। তিনি মাছের পোনা উৎপাদন, সরবরাহ, মাছ চাষ ও চাষের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ উৎপাদন এবং বিতরণের মাধ্যমে সারা দেশে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন বলে জানা গেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সর্ববৃহৎ মাছবাজার-সংলগ্ন মাতুয়াইলে এসবি কোল্ডস্টোরেজে শত শত মাছ ব্যবসায়ীর আনাগোনায় সারারাত কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। মাছ ফ্রিজিং, কোল্ডস্টোরেজ থেকে বাজারে সরবরাহ পাঠানোসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড চলতে দেখা যায়। দ্বীপ জেলা ভোলায়ও ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন শফি মাল নামের আরেক সফল মৎস্য চাষি। মাত্র ১৭ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে মাছ চাষ করে এক যুগের মাথায় কোটিপতি হয়েছেন ভোলা সদর উপজেলার সফল চাষি শফি মাল। সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ২০১৪ সালের জাতীয় মৎস্য পুরস্কার। যশোরের সীমান্তবর্তী শার্শা পরিচিতি পাচ্ছে ‘মাছের উপজেলা’ হিসেবে। সেখানেও গড়ে উঠেছে বাড়ি বাড়ি মাছ চাষের চমৎকার দৃষ্টান্ত। শার্শায় মাছ চাষ করে সুদিন এসেছে কয়েক হাজার পরিবারে। উপজেলার ১৫টি বাঁওড় ও সাড়ে ছয় হাজার পুকুর-জলাশয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান। প্রতিবছর শার্শা এলাকায় মাছের চাহিদা সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে সেখানে উৎপাদিত হয় ২০ হাজার মেট্রিক টন।
মাছ চাষ, উপকরণ সরবরাহ, বাজারজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণন কর্মকাণ্ডে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।রপ্তানির মাধ্যমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চট্টগ্রামের চকরিয়া ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় ঘেরসমূহে চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ চাষ জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এসব এলাকায় উৎপাদিত চিংড়ি মাছ এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিপণ্য।পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীরাও মাছ চাষের সর্বজনীন বিপ্লব থেকে পিছিয়ে থাকেননি। সেখানে পুকুর-ডোবা, নদী-নালার সংখ্যা অতি অল্প হলেও পাহাড়ে পাহাড়ে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর তাতে চলছে মাছের চাষ। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার ২৫টি উপজেলায় দুই পাহাড়ের মাঝে ক্রিকের (ঘোনায় মাছ চাষের জন্য বাঁধ) মাধ্যমে মৎস্য চাষের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০০ ক্রিক ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে, চলছে আরও পাঁচ শতাধিক নির্মাণের কাজ। মোট আট শতাধিক ক্রিক নির্মাণ শেষ হলে পার্বত্য এলাকায় মাছ চাষ রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদফতর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্রগুলো জানায়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ, চিংড়ি ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় চার হাজার ৩১৩ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ খাতে প্রতিবছরই নতুন করে ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশেরও বেশি মানুষ মৎস্য খাতের নানা কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন। তবে সারা দেশে পরিত্যক্ত খাসভূমি, অনাবাদি হাওর-বাঁওড়, হাজা-মজা, খাল-নালা ও পাহাড়ি উপত্যকায় মাছ চাষের পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সফল মাছ চাষিরা। তারা জানান, এসব পরিত্যক্ত জায়গা-জমি চাষের আওতায় আনা গেলে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন ও রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

মাছ চাষে বিপ্লব

আপডেট টাইম : ১২:০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৫

সিলেটের জকিগঞ্জ থানার প্রত্যন্ত এলাকার ‘আমেরিকান ফিশারি’ এখন বৃহত্তর সিলেটে মাছ চাষের সফল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আটজনের ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এ খামার দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে ব্যতিক্রমী অবদান রাখছে। কামালপুর গ্রামে ২১৬ একর জায়গায় শুরু করা ফিশ গার্ডেনটি বর্তমানে চার কিলোমিটার ব্যাপ্তি পেয়েছে। এখানে পুকুরের সংখ্যা ২৪টি। রয়েছে ১৭৫ বিঘা আয়তনেরও পুকুর। এ খামার থেকে প্রতিবছর অন্তত ৬০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। তবে উদ্যোক্তারা জানান, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এখান থেকে বছরে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় হ্যাচারি, পোনা উৎপাদন, পুকুরে পানি বদল ও এয়ার ওয়াটার ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূর ময়মনসিংহ থেকে রেণু পোনা এনে তবেই সম্ভব হচ্ছে মাছ চাষ। এসবি গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহজাহান বাবলুর ব্যক্তি উদ্যোগে ঢাকার মাতুয়াইলে গড়ে তোলা ফিশিং কোল্ডস্টোরেজটি এখন রাজধানীর কয়েক হাজার মাছ ব্যবসায়ীর আশীর্বাদ। ব্যবসায়ীরা এখন আর ফরমালিন মিশিয়ে দিনভর মাছ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন না। বিক্রি না হলেই ফেলনা দামে ক্রেতাকে গছিয়ে দিতে হবে- এমন দুশ্চিন্তায়ও ভোগেন না তারা। বাজার শেষে অবিক্রীত মাছ নিশ্চিন্তে হিমাগারে রেখে আয়েশে বাড়ি ফেরেন তারা। পরদিন আবার সেই মাছ হিমাগার থেকে বের করে বাজারে বিক্রি করেন। দুই হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার এসবি ফ্রিজিং কোল্ডস্টোরেজটি বদলে দিয়েছে রাজধানীর মাছবাজারের দৃশ্যপট। সিলেট, ময়মনসিংহ, যশোর, কুমিল্লার মতো মাছ চাষে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে। আসাদ নামের এক বেকার যুবকের উদ্যোগে তার নিজ গ্রামেই গড়ে উঠেছে ২৭৫টি পুকুর-খামার। গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে মাছ চাষের বিপ্লবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এখন গ্রামটি থেকে প্রতিবছর তিন হাজার ৭০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। এভাবেই ব্যক্তিপর্যায়ে একের পর এক নজির সৃষ্টি করে দেশব্যাপী ‘মাছবিপ্লব’ ঘটিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাদের শ্রম-ঘাম আর একাগ্রতায় দেশের সামগ্রিক চাহিদা মিটিয়েও মাছ রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এই সফলতার ধারাবাহিকতায় মাছ উৎপাদনে বিশ্বের চতুর্থ অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বেসরকারি খাতের প্রয়াসে বেড়েই চলেছে মাছের উৎপাদন। উত্তরোত্তর বেড়েছে প্রবৃদ্ধি। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এ সময়ে দেশে মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে উন্নীত হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ টনে। এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, এর মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের অবস্থান থাকবে বলে জানানো হয়েছে। ১৯৯০ সালে দেশে মোট চাষকৃত মাছ উৎপাদিত হয়েছিল এক লাখ ৯৩ হাজার টন। ২০০০ সালে তা বেড়ে ছয় লাখ ৫৭ হাজার এবং ২০১৫ সালে এসে তা সাড়ে ১০ লাখ টন ছুঁই ছুঁই করছে। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলা দেশে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে আলোচিত অবস্থান করে নিয়েছে। কুমিল্লার প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও মাছ চাষের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোক্তারা। জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ করা মাছের খামার এখন চোখে পড়ার মতো। লাভবান হওয়ায় দিন দিন বিভিন্ন পেশার মানুষসহ এলাকার বেকার যুবকরা মাছ চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। মাছের খামারগুলোর কারণে লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। উৎপাদিত মাছ ভূমিকা রাখছে পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা পূরণে। দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে ‘জাতীয় মৎস্য পদক-২০১৪’ অর্জনকারী শাহজাহান বাবলুও নাঙ্গলকোটের অধিবাসী। তিনি মাছের পোনা উৎপাদন, সরবরাহ, মাছ চাষ ও চাষের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ উৎপাদন এবং বিতরণের মাধ্যমে সারা দেশে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন বলে জানা গেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সর্ববৃহৎ মাছবাজার-সংলগ্ন মাতুয়াইলে এসবি কোল্ডস্টোরেজে শত শত মাছ ব্যবসায়ীর আনাগোনায় সারারাত কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। মাছ ফ্রিজিং, কোল্ডস্টোরেজ থেকে বাজারে সরবরাহ পাঠানোসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড চলতে দেখা যায়। দ্বীপ জেলা ভোলায়ও ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন শফি মাল নামের আরেক সফল মৎস্য চাষি। মাত্র ১৭ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে মাছ চাষ করে এক যুগের মাথায় কোটিপতি হয়েছেন ভোলা সদর উপজেলার সফল চাষি শফি মাল। সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ২০১৪ সালের জাতীয় মৎস্য পুরস্কার। যশোরের সীমান্তবর্তী শার্শা পরিচিতি পাচ্ছে ‘মাছের উপজেলা’ হিসেবে। সেখানেও গড়ে উঠেছে বাড়ি বাড়ি মাছ চাষের চমৎকার দৃষ্টান্ত। শার্শায় মাছ চাষ করে সুদিন এসেছে কয়েক হাজার পরিবারে। উপজেলার ১৫টি বাঁওড় ও সাড়ে ছয় হাজার পুকুর-জলাশয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান। প্রতিবছর শার্শা এলাকায় মাছের চাহিদা সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে সেখানে উৎপাদিত হয় ২০ হাজার মেট্রিক টন।
মাছ চাষ, উপকরণ সরবরাহ, বাজারজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণন কর্মকাণ্ডে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।রপ্তানির মাধ্যমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চট্টগ্রামের চকরিয়া ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় ঘেরসমূহে চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ চাষ জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এসব এলাকায় উৎপাদিত চিংড়ি মাছ এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিপণ্য।পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীরাও মাছ চাষের সর্বজনীন বিপ্লব থেকে পিছিয়ে থাকেননি। সেখানে পুকুর-ডোবা, নদী-নালার সংখ্যা অতি অল্প হলেও পাহাড়ে পাহাড়ে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর তাতে চলছে মাছের চাষ। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার ২৫টি উপজেলায় দুই পাহাড়ের মাঝে ক্রিকের (ঘোনায় মাছ চাষের জন্য বাঁধ) মাধ্যমে মৎস্য চাষের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০০ ক্রিক ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে, চলছে আরও পাঁচ শতাধিক নির্মাণের কাজ। মোট আট শতাধিক ক্রিক নির্মাণ শেষ হলে পার্বত্য এলাকায় মাছ চাষ রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদফতর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্রগুলো জানায়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ, চিংড়ি ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় চার হাজার ৩১৩ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ খাতে প্রতিবছরই নতুন করে ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশেরও বেশি মানুষ মৎস্য খাতের নানা কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন। তবে সারা দেশে পরিত্যক্ত খাসভূমি, অনাবাদি হাওর-বাঁওড়, হাজা-মজা, খাল-নালা ও পাহাড়ি উপত্যকায় মাছ চাষের পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সফল মাছ চাষিরা। তারা জানান, এসব পরিত্যক্ত জায়গা-জমি চাষের আওতায় আনা গেলে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন ও রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব।