হাওর বার্তা ডেস্কঃ একালের পরিকল্পিত শহরগুলো যেন ফ্যাক্টরি থেকে অর্ডার দেওয়া একেকটা চৌকস পণ্য। যেমন ছিমছাম, তেমনি ঝকঝকে। আজকাল শহর তৈরির আগেই তৈরি হয়ে যায় এদের নিখুঁত পরিকল্পনা। কোন পথ দিয়ে যাবে তাদের চওড়া অ্যাভিনিউগুলো, সেগুলোকে সমান্তরালভাবে কেটে বেরিয়ে যাবে কোথায় কোন স্ট্রিট, কোথায় হবে শহরের ডাউনটাউন, কোথায় কোন শহরতলি, কোথায় মাঠ, পার্ক, জলাশয়, সুপার মার্কেট, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো—এসব ছবির মতো আঁকা থাকে সেসব প্ল্যানে। এখানেই শেষ নয়; প্ল্যানের ভেতরেই দেখানো থাকে গ্যাস-বিদ্যুৎ আর পানির লাইনের বিশদ নকশা। অবকাঠামোর ছক তৈরির পর লোকজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর্ব শেষ করে বলা হয়, ব্যস, এবার শুরু হোক এ শহরে তোমাদের বসবাস। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করে নাও ভালোবাসার এই শহরটাকে।
আগের দিনের শহরগুলো কিন্তু এভাবে তৈরি হতো না। এগুলো গড়ে উঠত প্রকৃতির মতো একটু একটু করে—শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভেতর দিয়ে। একদিন যা ছিল পায়ে হাঁটা পথ, তা একসময় চওড়া হয়ে রূপ নিত বড় রাস্তায়, নর্দমা হয়ে উঠত ফুটপাত, কোথাও মাঠ হতো পার্ক বা পার্কগুলো রাজকীয় ঘরবাড়ি—সুবিধা বুঝে গড়ে উঠত বাণিজ্য, আবাসিক ও শিল্প এলাকা-স্কুল-কলেজ, সুপার মার্কেট বা বিশ্ববিদ্যালয়। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব শহরের নানা ধরনের সমস্যা বা জটিলতা থাকত। শহরগুলোর কোনো কোনো এলাকা হয়ে উঠত পুরো কংক্রিটের দুর্গ, কোথাও আবাসিক এলাকার মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে দিত বাণিজ্য বা শিল্প এলাকা। উপাসনালয়, নিষিদ্ধ এলাকা বা বইপাড়ার সীমারেখাও সব সময় স্পষ্ট থাকত না।
তবু এসব মেনেই বহুকাল ধরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল শহরগুলো। কিন্তু গত এক শতাব্দীতে পৃথিবীজুড়ে শহরগুলোর ওপর এদের বিপুল আয়তন, যানবাহন ও অগুনতি জনসংখ্যার এমন দুঃসহ চাপ বেড়েছে যে এই বিশাল ও বল্গাহীন বিকাশের সঙ্গে তাল মেলাতে শহরগুলোকে আজ নিজেদের চেহারা বদলে নিতে কেবলই খাবি খেতে হচ্ছে। গত ৫০ বছরে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধি যে দুঃসহ যানজটের জন্ম দিয়েছে, তা মোকাবিলা করতে ব্যক্তিগত যানবাহনের চেয়ে গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে গণপরিবহনের ওপর। ফলে বাস, ট্রাম, ডাবল ডেকার, আর্টিকুলেট বাস হয়ে উঠেছে নাগরিকদের যাতায়াতের প্রধান বাহন। কিন্তু শহরগুলো আরও বড় হয়ে উঠলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে কেবল যানবাহনের নয়, যাতায়াত সমস্যার সমাধান করতে হলে গতানুগতিক রাস্তা দিয়ে আর চলবে না। এর জন্য চাই বাড়তি রাস্তা—নতুন ধরনের রাস্তা। এই ভাবনা থেকে প্রথমে উদ্ভাবিত হলো মাটির নিচের রেলপথ। যেমন এর ট্রেনগুলোর ক্ষিপ্রতা, তেমনি ধারণক্ষমতা। শ-কয়েক যাত্রী নিয়ে চোখের পলকে চলে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল; যা মোড়, ক্রসিং বা লাল বাতি—আকীর্ণ মাটির ওপরকার রাস্তায় ছিল অচিন্তনীয়। এ যুগের মহানগরগুলোর অস্তিত্ব বিকাশ ও ব্যাপ্তির ব্যাপারে এই পাতাল রেল যেন এক যুগান্তকারী বিপ্লব। এগুলো ছাড়া এ যুগের কোনো মহানগর এখন যেন আর কল্পনীয় নয়। কিন্তু এ রেল খুবই খরচসাপেক্ষ। আমাদের মতো গরিব দেশে যেখানে এই রেল চালু করার মতো টাকার জোগান সহজ নয়, সেখানেই এই রেলের পাশাপাশি অল্প খরচে আজকাল আর একধরনের রাস্তা চালু করা হচ্ছে। এগুলো হলো রাস্তার ওপরের রাস্তা। তাদের নাম উড়ালসড়ক। এত দিনের রাস্তাগুলোয় যখন বাড়তি যানবাহন আর কিছুতেই ধরছে না, তখন এদের ধারণক্ষমতা কয়েক লেন বাড়িয়ে ফেলাই এদের কাজ। এরই দেখাদেখি একধরনের উড়ালসড়ক দিয়ে আজকাল আবার গাড়ির বদলে ট্রেন চালানোর ধারাও চালু হয়েছে। আমাদের দেশে এগুলোকে বলা হচ্ছে মেট্রোরেল। ১০ বছর ধরে আমরা শুনে আসছি, এই মেট্রোরেলগুলোই হবে ঢাকার প্রধান গণপরিবহন।
ইংরেজিতে যাকে বলে ফ্লাইওভার, বাংলায় তারই নাম উড়ালসড়ক। নাম হিসেবে দুটোই বেশ গালভরা। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই ধরা পড়বে আজকের পৃথিবীর বড় শহরগুলোয় যানবাহন চলাচলের জন্য যত রকম রাস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন উড়ালসড়ক, আকাশ রেল, পাতাল রেল, গতানুগতিক রাস্তাঘাট—এগুলোর মধ্যে উড়ালসড়কগুলোই (রাস্তার ওপরের রাস্তা) সবচেয়ে নিকৃষ্ট। এর প্রথম কারণ: যে রাস্তার ওপর উড়ালসড়ক তৈরি হয়, সে রাস্তাটিকে উড়ালসড়কটি প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে। এ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে এ কারণে যে এগুলো সাধারণভাবে তৈরি হয় চওড়া রাস্তা বা রাজপথের ওপর। এই রাজপথগুলোর এমনিতেই একটা সহজাত সৌন্দর্য ও বৈভব আছে। চেহারাতে আছে একটা আভিজাত্য ও রাজকীয়তার ছাপ। চওড়া রাস্তার দুই পাশের উঁচু উঁচু সুপার মার্কেট, শপিং মল, দৃষ্টিনন্দন বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের সমারোহ রাস্তাগুলোকে নগরবাসীর কাছে একধরনের সামাজিক ও বাণিজ্যিক মিলনকেন্দ্র করে তোলে। ইট-পাথরে ভারাক্রান্ত নগরের বসবাসকারীদের জীবনে এরা যেন একধরনের মুক্তির প্রতীক। ঢাকার মতো মাঠ-পার্কহীন জনবহুল ও অবরুদ্ধ শহরে এসব রাস্তাতে এসেই তো আমরা আকাশ দেখি, বুক ভরে নিশ্বাস নিই।
এ রকম একটি শহরের কোনো রাজপথের ওপর দিয়ে উড়ালসড়ক তৈরি করা মানে পথটাকে মুহূর্তে একটা বিমর্ষ অন্ধকার মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা। এ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাটার আলো-হাওয়ার প্রাচুর্যে ভরা রাজকীয় চেহারাটা দপ করে নিভে যায়, দুই পাশের দোকানপাটগুলোর রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়ে মনমরা। এক কথায়, একটা বৈভবময় বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক এলাকা হিসেবে রাস্তাটির মৃত্যু হয়।
উড়ালসড়কের আরও একটি খারাপ দিক আছে। এগুলো থেকে দুই পাশের নানা রাস্তায় নামার বা ওঠার জন্য যেসব র্যাম্প তৈরি হয়, সেগুলো ওই ছোট রাস্তাগুলোকে আবার শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে। ফলে গোটা নগরের গতি ও জীবনপ্রবাহের ওপর নেমে আসে স্থবিরতা। তা ছাড়া প্রতিটি রাস্তার দুই পাশের লোকালয়গুলোর মধ্যে যে সজীব সামাজিক সম্পর্ক থাকে, এই উড়ালসড়কগুলো বাধার মতো দাঁড়িয়ে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ফলে শহর তার একক জৈব সত্তা হারিয়ে একসময় ছোট ছোট কতকগুলো বিচ্ছিন্ন ও যান্ত্রিক অঞ্চলে ভাগ হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া এগুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব উড়ালসড়ক ব্যবহার করে শহরের কজন মানুষ? কত ভাগ অধিবাসী? সবাই জানেন উড়ালসড়কগুলোর ওপর দিয়ে বাস, ট্রাম, ডাবল ডেকার বা ট্রাকের মতো ভারী গণপরিবহন বা মালবাহী যান সাধারণত চলে না। চলে মূলত ছোট আর মাঝারি আকারের ব্যক্তিগত গাড়ি। ঢাকা শহরের ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়া মানুষের সংখ্যা শতকরা মাত্র ছয়জন। অর্থাৎ নগরের শতকরা ছয় ভাগ মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে গিয়ে আমরা ৯৪ ভাগ মানুষের যাতায়াতের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের উড়ালসড়কগুলোর নিচে ঘিনঘিনে অন্ধকার রাস্তাগুলোর ভেতর ঠেলে দিচ্ছি। এই কি রাষ্ট্রের কাছে একটি শহরের বিত্তহীন ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য আচরণ?
বিশেষজ্ঞরা বহুদিন থেকে বলে আসছেন, ঢাকার যানজটের মূল কারণ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও রাস্তাঘাট ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষের অক্ষমতা। যেখানে কোনো ব্যবস্থাপনাই দিয়ে পার পাওয়ার উপায় নেই, সেখানে ছোটখাট ওভারপাস, আন্ডারপাস ও লুপ তৈরি করে ও আরও কিছু ছোটখাটো পদক্ষেপ নিয়ে এর মোটামুটি সমাধান সম্ভব। যাত্রাবাড়ী ক্রসিংয়ে কয়েকটা ওভারপাস আর আন্ডারপাস তৈরি করে ও নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রেললাইনের কিছুটা অংশকে মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে গিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকার যে যানজটকে সহজেই নিরসন করা যেত, তা সমাধান করার জন্য মেডিকেল কলেজ থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত কী আজদাহা উড়ালসড়কই না তৈরি করা হয়েছে। রাস্তাটার দিকে ভালো করে তাকালে খুব অসহায় লাগে। বোঝা যায়, ওটা করতে গিয়ে কীভাবে একটি আট লেনের বিরাট রাস্তার (যতটা চওড়া রাস্তা ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী নগরগুলোতেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর) চারটি লেনকে কার্যত খুন করে তাকে চার লেনওয়ালা ও নানা প্রতিবন্ধকতায় ভরা একটি দম আটকানো রাস্তায় পরিণত করা হয়েছে। ভালো করে তাকালে দেখবেন, উড়ালসড়কটির কলাম আর তাদের পাটাতনগুলোকে বিরাট জায়গাজুড়ে তৈরি করে রাস্তার ওপর এমন সব বড় বড় বাধা তৈরি করা হয়েছে যে রাস্তাটি যান চলাচলের জন্য প্রায় অকেজোই হয়ে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তাটি হয়ে পড়েছে দুটো দীর্ঘ সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গ। কোথাও কোথাও রাস্তাটাকে যেন পুরো মেরেই ফেলা হয়েছে। শহরের একটি প্রধান রাস্তার এমন দুঃখজনক মৃত্যু দেখে মন ভারী হয়ে আসে। মনে হয়, কই, শহরের অন্য কোনো উড়ালসড়ক তো এমন নিষ্ঠুরভাবে রাস্তা ধ্বংস করেনি। অনেকেই মনে করেন এমনটা হয়েছে মূলত উড়ালসড়কটিকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে তৈরি করার ফলে। উড়ালসড়কটি তৈরি করার সময় ইজারা নেওয়া নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি নিচের রাস্তাটিকে কেন যে এমন শ্বাসরুদ্ধ ও গুমোট করে তুলেছে, তার কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। অনেক বিশেষজ্ঞকেও বলতে শুনেছি, এ রকম করা হয়েছে, যাতে ওই বিশাল রাস্তাটা মোটামুটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং রাস্তার গাড়িগুলো নিচ দিয়ে চলতে না পেরে উড়ালসড়কের ওপর উঠতে এবং তাদের টোল দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হয়।
আগেই বলেছি, রাস্তাটি ছিল কমপক্ষে আট লেনের। যাত্রাবাড়ী মোড়ের কারণে প্রচণ্ড যানজট দেখা দিলে ভাবনা শুরু হয় যে ওপরে চার লেনওয়ালা একটা উড়ালসড়ক তৈরি করলে নিচের আট লেন আর ওপরের চার লেন মিলে পথটা হবে ১২ লেনের। কিন্তু এই স্বপ্ন ভন্ডুল হয়েছে! নিচের আট লেনের রাস্তাকে কার্যত চার লেনের রাস্তায় পরিণত করায় নিচের চার লেন আর ওপরের চার লেন মিলে হয়ে পড়েছে আগের সেই আট লেনই। (কোথাও কোথাও নিচের রাস্তাটিকে নিংড়ে–পিষে দুই লেনও করে ফেলা হয়েছে। এসব জায়গার অবস্থা আরও মর্মান্তিক।) মনে প্রশ্ন আসে, জনগণের বিপুল টাকা অপচয় করে, জনস্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এই অকারণ উড়ালসড়কটা কেন তৈরি হলো? কিছু মানুষকে মুনাফার সুযোগ দেওয়ার জন্য? এতে নিচের চওড়া রাস্তাটা আমরা তো হারালামই, সেই সঙ্গে উড়ালসড়কের নিচের গোটা জায়গাটাকে করে ফেলা হলো আস্ত একটা নরকপুরী।
এত বড় একটা ফ্লাইওভার তৈরি হলো, কিন্তু তাতে গণপরিবহনে (বাস, ডবল ডেকার বা আর্টিকুলেট বাসে) চলাচলকারী সেই ৯৪ ভাগ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত আর গরিব মানুষদের কিন্তু কিছুই হয়নি। যে নোংরা ঘিনঘিনে ভাগাড়ে তারা ছিল, তার চেয়েও নিকৃষ্টতর ভাগাড়ে তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
ভবিষ্যতে আমাদের জনস্বার্থ ও সেবা খাতকে এ ধরনের মুনাফা সর্বস্ব বেনিয়াদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আগে এসব নিয়ে সরকারের ভালো করে ভেবে দেখা উচিত।
আমার ধারণা, মৌচাক ও মগবাজার চৌরাস্তার যে যানজটকে সামান্য কিছু আন্ডারপাস, ওভারপাস, লুপ তৈরি আর যানবাহনের অল্প সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারতাম, তার জন্যেও মগবাজার-মালিবাগ-শান্তিনগর এলাকায় চার লেনের একটি কদর্য ও দানবীয় উড়ালসড়ক তৈরি করে রাস্তাটির জমকালো বাণিজ্যিক ও নান্দনিক সৌন্দর্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তাটিকে পরিণত করা হয়েছে একটা বিমর্ষ অন্ধকূপে। শোনা যাচ্ছে, সেতু মন্ত্রণালয়ের পরামর্শকের তুড়িতে উড়িয়ে পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ পথ তৈরির জন্য একটি বিশাল উড়ালসড়ক শান্তিনগর থেকে রওনা হয়ে ঢাকা শহরের বুকের ওপর দিয়ে বুড়িগঙ্গা অতিক্রম করবে। এদিকে রেললাইনের ওপর দিয়ে বিমানবন্দর থেকে যে উড়ালসড়কটি কমলাপুর হয়ে ডেমরা পর্যন্ত যাচ্ছে, সেটি নাগরিক জীবনের তেমন বড় ক্ষতি না করলেও এ থেকে দুই পাশের রাস্তাগুলোতে যেসব র্যাম্প নেমে আসবে, সেগুলো ওই এলাকাগুলোর গলা টিপে তো ধরবেই, সেই সঙ্গে অবরুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করে শহরের একটা অংশকে স্থবির করে দেবে।
ঢাকা শহরের উড়ালসড়ক তৈরির কর্তৃত্ব কোনো একক সংস্থার হাতে নেই। তাই দেখা যায়, কোনো উড়ালসড়ক তৈরি করছে সিটি করপোরেশন (যেমন যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক), কোনোটা সেতু বিভাগ, কোনোটা তৈরির পাঁয়তারা করছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চলছে এক কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ির ব্যাপার। কেউ কোনো এলাকায় নতুন উড়ালসড়ক তৈরির কোনো রকম ছুতো বের করতে পারলেই পাগলের মতো তা তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যেমন প্রায় অকারণে নগরবাসীর অসীম দুর্ভোগ ঘটিয়ে তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক, যাতে যানবাহন চলাচল আজও খুব কম। আশঙ্কা করা হচ্ছে টাইগারপাস লালখান বাজারের ভাগ্যও অনেকটা একই রকম হবে। এসবের আরও সহজ, মানবিক বা সাশ্রয়ী সমাধান আছে কি না, তা নিয়ে কেউ যেন ভাবতেই রাজি নয়। অবশ্য এ কারণে নয়। উড়ালসড়ক বিরাট বাজেটের জিনিস। তার ওপর রহস্যজনক কারণে আমাদের দেশে উড়ালসড়ক তৈরির পরিমাণ আমাদের আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় গড়ে প্রায় দ্বিগুণ। তা ছাড়া মূল উড়ালসড়ক অত বড় না হলেও অদরকারে সেটির দুই কান টেনে লম্বা করেও বাজেট বাড়িয়ে নেওয়া যায়। আর কে না জানে বড় বাজেট মানেই বড় ‘লাভ’। এ জন্যই উড়ালসড়ক বানানো নিয়ে হুড়োহুড়ির শেষ নেই। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে ঢাকা মহানগর নামের জনস্বার্থের এই বিরাট কেকটি অগুনতি উড়ালসড়কের লম্বা লম্বা করাতের নিচে কাড়া-ছেঁড়া হয়ে নানাজনের রসনা তৃপ্তির রসদ জোগাচ্ছে। কেবল উড়ালসড়ক নয়, বছর কয়েক আগে আরও যা দিয়ে এই নগরকে পুরো শ্বাসরোধ করার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত হয়েছে, তার নাম ঢাকা মেট্রোরেল। উড়ালসড়কের হামলা থেকে যেসব রাজপথ প্রাণে বাঁচবে, তাদের চাপা পড়তে হবে এর নিচে। ভালোই হবে। ঢাকা শহরের নিশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আধুনিক পৃথিবীতে অনেক বড় বড় শহর আছে। কিন্তু ওই সব শহরের রাস্তাঘাটে আপনি মানুষ দেখবেন না। এর কারণ তাদের কাণ্ডজ্ঞান। রাস্তাঘাটের ওপর একমাত্র বাস আর সীমিতসংখ্যক প্রাইভেট গাড়ি আর কালেভদ্রে দু-একটা ছোটখাটো ওভারপাস ছাড়া—টেলিফোনের খুঁটি বা টিভি কেব্ল থেকে শুরু করে উড়ালসড়ক, আকাশ রেল—কোনো কিছুকেই তারা রাস্তার ওপর থাকতে দেয় না। সবকিছু সেখানে মাটির নিচে। শহর এতে জনবিরল ও পরিপাটি থাকে। লেক, পার্ক, নীলাকাশ আর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নিয়ে শান্ত ছবির মতো ঝলমল করে।
আমাদের ব্যাপার উল্টো। এখানে লাখ লাখ যাত্রী, পথচারী, যানবাহন, বিলবোর্ড, বাড়িঘর, বহুতল ভবন, উড়ালসড়ক, আকাশ-ঢাকা মেট্রোরেল—সব মাটির ওপর। কী বিশাল শহর এই ঢাকা—কত যানবাহন, কত দালানকোঠা, কলকারখানা, বাণিজ্য এলাকা, ক্লেদ, জনসংখ্যা আর নৈরাজ্য এখানে! কিন্তু ঢাকা শহর নিয়ে কোনো সরকারই আজ পর্যন্ত কোনো বিশদ পরিকল্পনা তৈরি করল না! আজও পুরোপুরি পরিকল্পনাহীনভাবেই তৈরি হচ্ছে এই শহর। যখন যে যা চাইছে তা-ই হচ্ছে। সবখানেই ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’। সবখানেই উপস্থিত সমস্যাকে ছাইচাপা দেওয়ার আপাত অজুহাতে শহরকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা। এ দেশে এত রাজনীতিবিদ, এত আমলা, এত ক্ষমতাধর মানুষ! পৃথিবীর কত অপরূপ, ছবির মতো শহরে তাঁরা যান, সেসব জায়গায় থেকেও আসেন। সেসব শহর দেখে নিজেদের এই ক্লেদাক্ত শহরটার জন্য তাঁদের কি সম্মানবোধও লাগে না? মনে হয় না আমাদের জাতির এই গর্বের রাজধানীটা ওসব শহরের মতোই পরিপাটি আর ঝলমলে হয়ে উঠুক!
এসব উড়ালসড়ক আর মেট্রোরেলপথের নিচে ঢাকা শহর পুরোপুরি কবরস্থ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আমাদের কাছে একটা আশাব্যঞ্জক খবর এসেছে। সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে গণপরিবহনব্যবস্থার শুধু সাব সার্ভিসটুকুকে মাটির ওপরে রেখে আর সবকিছুকে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। শুনেছি, এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনাও এসে গেছে। অর্থাৎ উড়ালসড়ক আর নয়, আকাশ দিয়ে মেট্রোরেলের বীভৎসতা আর নয়, এখন থেকে উজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে একটা ঝকঝকে স্নিগ্ধ নগর। শুনেছি এই আচমকা সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর নিজের। শহরের সৌন্দর্য ও বসবাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে এমন একটি খবর পাওয়ায় আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
তবু কথা থেকে যায়। এখন থেকে এই নির্দেশ যদি কার্যকর হয়ও, তবু উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেলের যেটুকু অংশ প্রকাশ্যে বা চোখের আড়ালে এরই মধ্যে তৈরি শুরু হয়েছে, তার আঘাত থেকে শহরকে বাঁচানোর উপায় কী? উদাহরণত, ঠিক হয়েছে মেট্রোরেল-৬ মিরপুরের উত্তর প্রান্ত থেকে এগিয়ে এসে রোকেয়া সরণি হয়ে জাতীয় সংসদের ভেতর দিয়ে ফার্মগেট ঘুরে শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে এগিয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত নগরের এই প্রধানতম সড়কটির কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ও ময়মনসিংহ রোডের দুই পাশে বহু দৃষ্টিনন্দন ও জমকালো ভবন তৈরি হয়ে গেছে এবং আরও হচ্ছে। ফলে সড়কটি এর মধ্যেই শহরের অভিজাততম সড়কের বৈভব লাভ করেছে। এমন সম্ভ্রান্ত একটি রাস্তার ওপর দিয়ে রেলপথ না নিয়ে গেলেই কি নয়! রোকেয়া সরণির মোড়ের পর মেট্রোরেলের এই পথটি মাটির নিচ দিয়ে কি নিয়ে যাওয়া যায় না? তাতে অন্তত তিনটি লাভ হয়:
১. নগরের প্রধান সড়কটি শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার কদর্যতা থেকে বেঁচে যায়।
২. শহরের কেন্দ্রস্থলের রমনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উন্মুক্ত ও সবুজ শ্রী অটুট থাকে।
৩. মেট্রোরেলকে সংসদ ভবনের ভেতর দিয়ে নিয়ে আসতে হয় না, যে ব্যাপারটিকে স্থপতি ও পরিবেশবাদীরা লুই কান ও বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান বলে মনে করেন।