হাওর বার্তা ডেস্কঃ নানামুখী চাপে পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সরকারের কঠোর মনোভাব, শিক্ষার্থী ভর্তি হ্রাস, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় মালিকদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হারানো, শিক্ষার মান তলানিতে যাওয়া এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাণিজ্যের মনোভাবের কারণে নতুন চ্যালেঞ্জে পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমে যাওয়া। এর ফলে নতুন করে গড়ে উঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ ৪৩তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমার চিত্র উঠে এসেছে। ১৪ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হ্রাস পেল। শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা হারাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০১৬ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন লাখ ৫০ হাজার ১৩০ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করলেও ২০১৭ সালে এই সংখ্যা কমে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৭ জনে গিয়ে ঠেকেছে। সর্বশেষ ২০০১ সালে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমেছিল। চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ সালে শিক্ষার্থী ছিল ৬ হাজার ২২১ জন, ২০১৬ সালে কমে এটি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৭৮ জনে। প্রায় ২০টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি হার এভাবে কমেছে। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ভর্তি হার বেড়েছে এমন তথ্য দেখা গেছে। সার্বিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার কমেছে এমন তথ্য এসেছে ইউজিসি প্রতিবেদনে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমার অন্যতম কারণ প্রত্যেক জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া। এ কারণে শিক্ষার্থীরা ঢাকা ও মহানগরে আসতে চাচ্ছে না। আর প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে। একটা পর্যায়ে এসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কমবে। সেই ধাক্কা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে লাগবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমার কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট ধীরে ধীরে কমে যাওয়া, মান উন্নতি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা বাড়া ও আসন বৃদ্ধি, কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক। এ ছাড়া প্রচুর শিক্ষার্থী দেশের বাইরে পড়াশুনা করতে যাচ্ছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ভিসি, প্রো-ভিসি না থাকা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, সর্বোপুরি শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে না পারায় শিক্ষার্থীরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তি সংখ্যা কমার কারণ সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা ও সিট বৃদ্ধি। এ কারণে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় উন্নত পড়াশুনা প্রদান করার ফলে এখনও আগের মতই শিক্ষার্থী পাচ্ছে।
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকবে। কারণ অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারছে না। অভিভাবকরা সচেতন। তারা ইউজিসির ওয়েবসাইড দেখে সন্তানকে ভর্তি করান।
অন্যদিকে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি। এজন্য সিন্ডিকেট সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টি সদস্য, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি, অর্থ কমিটি এবং শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধি ও অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেছে। বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংশোধন করে এসব বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় সাব-কমিটি। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ খসড়া প্রস্তাব দেয়ার পর সংসদীয় কমিটি একটি সাব কমিটি করে দেয়। এই কমিটি ৫টি বৈঠকে তা চূড়ান্ত করেছে। সাব-কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে- বোর্ড অব ট্রাস্টিজের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ থাকতে হবে। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া সেখানে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না। প্রয়োজনে এই বোর্ডে কমিশন সাময়িকভাবে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে পারবে। বিদ্যমান আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের নিজস্ব বা ভাড়া করা ভবনের স্থলে ৫০ হাজার বর্গফুট আয়তন থাকতে হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে রিজার্ভ ফান্ডের অঙ্ক বাড়ানো না হলেও এই অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তরে কমিশনের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মেয়াদ দুই বছর, যৌন হয়রানি ও যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একজন অধ্যাপককে (যথাসম্ভব নারী) এই কমিটির প্রধান করতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সরকার মনোনীত একজন সদস্যের পরিবর্তে ইউজিসির দু’জন সদস্য রাখতে হবে। অর্থ কমিটিতে ভিসি মনোনীত একজন সদস্যের স্থলে কমিশন মনোনীত একজন সদস্য এবং শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে ভিসি ছাড়াও কমিশন মনোনীত একজন শিক্ষাবিদ রাখতে হবে। ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা জীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় শ্রেণি অগ্রহণযোগ্য হবে। শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণ ও বিভিন্ন খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের কমিশনের অনুমোদন হতে হবে বাধ্যতামূলক। শিক্ষার্থী ফি কাঠামো চূড়ান্ত করতে অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা থাকতে হবে। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থ দণ্ডের স্থানে ২০ লাখ টাকা অর্থ দণ্ডের বিধান যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষা সমাপনী তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ব্যানবেইসের ওয়েবসাইটেও প্রকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ে সনদ নিতে ব্যর্থ হলে ইউজিসির সুপারিশে সেটি বন্ধ ঘোষণা করা যাবে।
তিন মাসের সময় দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আবদুল কুদ্দুস এমপিকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ইউজিসির একজন সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। সেই কমিটি প্রায় দুই বছরে সেটি চূড়ান্ত করেছে।
সংবাদ শিরোনাম
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমছে চাপে পড়ে শিক্ষার্থী
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০৫:২৬:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৭
- ২৩৭ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ