হাওর বার্তা ডেস্কঃ শিশু শব্দটি শোনামাত্রই যেমন পবিত্র ও সুন্দর একটি ফুলের মতো অবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তেমনি শৈশব শব্দটিতেও একটি জটিলতা ও কুটিলতামুক্ত সুন্দর, সহজ-সরল, মধুর ও চঞ্চল একটি সময়ের চিত্র ফুটে ওঠে। মানবজীবনের প্রথম ধাপটিই হলো শৈশবকাল।
শিশুরা মাসুম বা নিষ্পাপ। হাদিস শরিফে রয়েছে, কিয়ামত ততক্ষণ সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ জগতে একজন নিষ্পাপ মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে। অন্য হাদিসে আছে, কিয়ামত যখন সংঘটিত হবে, তখন কোনো শিশু থাকবে না। অর্থাৎ শিশু ও শৈশব পবিত্রতার প্রতীক, এই পবিত্রতাই পারে সব সংকট থেকে মানবজাতিকে মুক্ত রাখতে, এমনকি কিয়ামতের মহাপ্রলয় থেকেও রক্ষা করতে। তাই আমাদের মানবসভ্যতা রক্ষার জন্য শিশুদের শৈশবকে পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে হবে। সভ্যতার উন্নয়নের জন্য আমাদের শিশুদের উন্নত চিন্তা ও পবিত্র জীবনের দীক্ষা দিতে হবে।
সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের চেষ্টার অন্ত থাকে না পিতা-মাতার। যে সন্তানের শৈশব সুন্দর হবে, সে ইহকাল ও পরকালে গর্বের ধন হবে। আল্লাহ তাআলা অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া ও শুভকামনা শিখিয়েছেন। ‘হে আমার প্রভু! আমাকে সুসন্তান দান করুন।’ (সুরা: ছফফাত, আয়াত: ১০০)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের সাথিদের ও আমাদের সন্তানদের আমাদের জন্য চোখের শীতলতায় পরিণত করুন, আর আমাদিগকে মুত্তাকিনদের প্রধান করুন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৫)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করুন, আর আমাদের বংশধরদেরও আপনার অনুগত করুন; আপনার বিধান আমাদের প্রত্যক্ষ করান এবং আমাদের প্রতি মনোনিবেশ করুন! নিশ্চয় আপনি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১২৮)।
সন্তান যেন বার্ধক্যে পিতা-মাতাকে নিঃসঙ্গ ফেলে না রাখে, সে জন্য প্রার্থনা, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে একা ছেড়ে দেবেন না, আপনিই তো সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী দাতা।’ (সুরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৮৯)। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন উত্তম পারিবারিক পরিবেশ। আল্লাহ তাআলা তাও বলে দিলেন, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে উত্তম পরিবার দান করুন, নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (সুরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩৮)। ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের ইহকালে ও পরকালে কল্যাণ দান করুন, আর দোজখের আজাব হতে আমাদের রক্ষা করুন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২০১)। সেই দোয়া আল্লাহ কবুল করেন, যা একনিষ্ঠভাবে প্রার্থনা করা হয়। প্রার্থনার সঙ্গে প্রচেষ্টা একনিষ্ঠতার প্রমাণ। তাই আমাদের সন্তানদের শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যকে আনন্দময় ও নিরাপদ করতে হবে। এ জন্য প্রথমে প্রয়োজন পারিবারিক আনন্দঘন পরিবেশ, নিকটজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক। সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি। পিতা-মাতার মধুর সম্পর্ক সন্তানের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ততা সন্তানকে অনুপ্রাণিত করে।
শিশুর লালন-পালন, ভরণপোষণ, নিরাপত্তা প্রদান ও সুশিক্ষিত করা পিতা-মাতা ও অভিভাবকের ওপর ফরজ কর্তব্য। কোনো শিশু যদি অভিভাবকের অবহেলার কারণে পথচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে সে হাশরের দিনে আল্লাহর কাছে সে অভিভাবকের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের অভিভাবক ও বড়দের অনুসরণ করেছি, তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিসম্পাত করুন।’ (আল–কোরআন, মঞ্জিল-৫, সুরা-৩৩ [৯০] আহজাব, রুকু: ৮/৫, আয়াত: ৬৭-৬৮, পারা: ২২, পৃষ্ঠা: ৪২৮/৬)। শিশুর জন্য সুশিক্ষার সব ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তার দুনিয়া ও আখিরাত মঙ্গলময় হয়। শিশুকে শিষ্টাচার শেখাতে হবে, যাতে তার আচার-আচরণ সুন্দর হয় এবং সমাজে সবার ভালোবাসা ও সহানুভূতি লাভ করে। শিশুকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ ও অকল্যাণ বোঝাতে হবে, যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিশুকে সততা, সত্যতা, আদব-আখলাক ও সদ্গুণাবলি শেখাতে হবে, যাতে সে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, নামাজসহ ইবাদতে অভ্যস্ত করতে হবে, যাতে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। কোরআন, হাদিস ও ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় সাহিত্য পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও বিখ্যাত মনীষীদের গল্প শোনাতে হবে। তাদের মনোজগতে স্বপ্ন তৈরি করতে হবে। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ তৈরি করতে হবে। খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের চর্চা বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করো এবং তাদের ভালো ব্যবহার শেখাও।’ (বুখারি)। ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়েও উত্তম।’ (ইবনে মাজাহ)। ‘তোমরা সন্তানদের জ্ঞান দান করো; কেননা, তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (বায়হাকি)।
শিশুদের দীর্ঘ সময় একা থাকতে দেওয়া যাবে না। পিতা-মাতা ও অভিভাবক তাদের সঙ্গ দেবেন, তাদের সঙ্গে খেলা করবেন, গল্প করবেন। তাদের কথা শুনবেন, তাদের ইতিবাচক বায়নাগুলো সামর্থ্যমতো পূরণের চেষ্টা করবেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে রয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখো।’ (মুসলিম)। প্রিয় নবী (সা.) শত ব্যস্ততার মাঝেও শিশু নাতি হাসান (রা.) ও হোসেইন (রা.)-এর সঙ্গে খেলতেন। তাঁরা নবীজি (সা.)-এর নামাজের সময় ঘাড়ে চেপে বসতেন। এশার নামাজের পর বিশেষ জরুরি কাজ না থাকলে ফজরে ওঠার সুবিধার্থে তাড়াতাড়ি শোয়া বিধেয় হলেও মাঝেমধ্যে নবীজি (সা.) পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাতে গল্প করতেন, যা শামায়েলে তিরমিজি শরিফে হাদিসে উম্মে জারা বা জারার মায়ের গল্প নামে সপ্ত রমণীর বিখ্যাত কাহিনি উল্লেখ আছে। (জামে তিরমিজি)। হজরত আবু সালমান হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেবে, সাঁতার শিক্ষা দেবে এবং তির চালনার শিক্ষা দেবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। প্রিয় নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। তোমরা তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে তা পূরণ করো। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে তোমরাই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করছ।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
সন্তানদের নিরাপদ ও আনন্দময় শৈশবের জন্য পিতা-মাতা, অভিভাবকসহ শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সব স্তরের সচেতন নাগরিকেরই দায়িত্ব পালন করতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর এ ব্যাপারে প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।’ (বুখারি)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন: যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়; তবে তিনটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকে। এমন দান যার কল্যাণ চলমান থাকে, এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে, এমন সৎকর্মশীল সন্তান, যে তার (পিতা-মাতা ও অভিভাবকের) জন্য দোয়া করে।’ (ইবনে কাসির)। সুন্দর জীবনের জন্য প্রধান প্রভাবক, উদ্দীপক, প্রেরণা ও নিয়ামক হলো বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা।