হাওর বার্তা ডেস্কঃ কাউকে মার খেতে দেখলে আমরা কয়জন এগিয়ে যাই? কয়জন প্রতিরোধ করি। ভাবি, কিছু হবে না। পরে হয়তো দেখা যায়, মানুষটা গণপিটুনিতেই মারা গেছেন। এমনটা তো প্রতিনিয়তই হচ্ছে, ‘এই মৃত্যুর দায় কিন্তু আমাদেরও’—সহকর্মীর এমন মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে ভেসে ওঠে কয়েক দিন আগের স্মৃতি।
ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। এক লোককে চোর সন্দেহে ১০ থেকে ১২ জন মিলে ঘিরে ধরে মারছিল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। ইচ্ছে হচ্ছিল প্রতিবাদ করি, মনে হচ্ছিল এগিয়ে যাই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিলাম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে। তবে মনের গভীরে যে ভয় আছে, আছে অচেনা পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের আশঙ্কা, তা দ্রুত ওই জায়গা থেকে আমাকে সরিয়ে নিল। প্রতিবাদ আর করা হয়ে উঠল না। মনে তবু খচখচ করছিল, না জানি মানুষটার ভাগ্যে কী ঘটেছিল!
এমন ঘটনা আমাদের কতজনার জীবনে প্রতিনিয়তই হচ্ছে। ভয়, দ্বিধায় আমাদের সাহস হয় না একটু প্রতিবাদ করার, একটু এগিয়ে যাওয়ার। আর নারী হলে তো সাহসটা একেবারেই হওয়ার কথা না, এই দেশে এই পরিস্থিতিতে। কারণ, কটু কথা বা খারাপ মন্তব্যের বিষয়টি তো আছেই। তা ছাড়া কোথাকার ঘটনা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এমনটাই চলে আসছে, সন্দেহের বশে এমনভাবেই মার খেয়ে আহত বা নিহত হচ্ছে কত মানুষ। অন্যদের প্রতিবাদের মুখটি যেন কুলুপ দেওয়া। অন্তরে তোলপাড় হয় অথচ মুখ দিয়ে বের হয় না প্রতিবাদ।
এমন পরিস্থিতিতে কেউ প্রতিবাদ করতে চান না—এ কথা বলছি না। সমস্যা একটাই—‘সাহস’। বিপদ ডেকে আনার আশঙ্কা। এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। সবাই বললেন, ‘চোর পেটানোর সময় তাকে বাঁচাতে গেলে তো আমাকেও চোর ভেবে মারবে, এই ঝামেলা কে নেবে, ভাই। সাহস দেখাতে গিয়ে আমার জীবনটাই না যায়।’ কথাটা একদম ভুল—এমনটা বলার উপায় আমার নেই। তাই সাহস আর জাগ্রত হয় না। দায়িত্বটা ছিল পুলিশের, চোর হলে তার জন্য যথাবিহিত ব্যবস্থা করা, না হলে সসম্মানে রক্ষা করা, এই দায়িত্বটা তো তাদেরই।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলায় সবার সামনে চোর সন্দেহে এক কিশোরকে খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করেছেন কয়েক ব্যক্তি। অনেকে সেই মারধরের ঘটনা ভিডিও করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখে হাত দিয়ে ভীত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে অনেকেই দেখছিলেন পুরো ঘটনা। যেটি করেননি, সেটি হচ্ছে প্রতিবাদ। উগ্র কয়েকজনের নির্দয় হাতের বলি হওয়ার ভয় ঢুকেছিল তাঁদের মনে। তাদেরই-বা কী দোষ দেব? এমনটা যে আমিও করে থাকি। সাহস যে হয়ে ওঠে না।
কিন্তু কিছু সময় আসে, ‘যখন ভয়কাতুরে মাহবুব হয় ভীষণ সাহসী’—ছোটবেলায় পড়া ছড়ার ওই ছেলেটির মতো! সেদিন আবারও মুখোমুখি হলাম এমন একটি ঘটনার। চোর সন্দেহে এক যুবককে ধরে পেটাচ্ছে আট-দশজন। কেউ লাথি মারছেন, কেউ চড়-থাপ্পড়, মাথা ঠুকে দিচ্ছে দেয়ালে। প্রচণ্ড মারের চোটে রক্তাক্ত যুবকটির সরে যাওয়ারও আর শক্তি নেই। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘটনা যা বুঝলাম তা হলো, মুঠোফোন চুরির অভিযোগে এই পিটুনি ‘উৎসব’ চলছে। যদি মানুষটা চোরও হয়ে থাকে, তবে তার শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। ক্ষুব্ধ হিংস্র কতগুলো মুখ মেরেই চলছে ছেলেটাকে। অসহায় মানুষটার মতো তাদের শরীরও উন্মত্ততায় ঘামছে, পুরোপুরি ক্ষিপ্ত তারা। ভয়ে ওই জায়গা থেকে একটু সরে গেলাম।
মনে হলো ওই সহকর্মীর কথা, ‘লোকটির মৃত্যু হলে তার দায় যে আমারও’। ফিরে এলাম ঘটনাস্থলে। চিৎকার করে লোকগুলোকে থামতে বললাম, কেউ গ্রাহ্য করল না। একজন বললেন, ‘আপা, আপনে এখান থেকে যান।’ আশপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কী করা যায়। ইন্টারনেটে আশপাশের থানার ফোন নম্বর খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুলিশের গাড়ি নজরে এল। সেখানে ছুটে গিয়ে বললাম লোকটাকে বাঁচাতে। একবার মনে হয়েছিল তারা সাহায্য করবে না, দায়িত্ব পালন করবে না। তবে আমাকে একটু অবাক করে দিয়ে তারা এগিয়ে এল। ওই জায়গা থেকে লোকটিকে উদ্ধার করে সরিয়ে নিয়ে গেল তাদের পিকআপে।
বলে বোঝাতে পারব না, সামান্য এতটুকু প্রতিবাদ করতে পারায় নিজের মধ্যে কী তীব্র শান্তি পেয়েছি। মনে হয়েছে, আমি মানুষই আছি। নিজের মনের শক্তি বেড়েছে বহুগুণ। এ উপলব্ধি ভাষায় বোঝানো যায় না।