হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূলের জন্য অব্যাহত অভিযান সেব্রেনিসার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। সেব্রেনিসায় যখন হাজার হাজার বসনীয় মুসলিম পুরুষ ও তরুণকে নিধন করা হচ্ছিল তখন সেখানে জাতিসংঘ বাহিনী পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে। নারী ও শিশুদের বাস ভর্তি করে বসিনিয়াকদের দখলকৃত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে জাতিসংঘ বাহিনীর অধিকাংশ সেনা ছিলো ডাচ। তাদের ওপর তাদেও সরকারের নির্দেশ ছিলো কোন সেনার লাশ দেশে পাঠানো যাবে না। কারো জীবনের ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তখন থেকে হল্যা-ের সাধারণ মানুষ তাদের বাহিনীকে অপদস্ত করতে ‘সেব্রেনিসার লজ্জা’ শব্দটি উদ্ভাবন করে।
মিয়ানমারে যখন জাতিগত নির্মূল অভিযানের হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত ও নৃশংসতার শিকার হচ্ছে তখনও বিশ^ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে অবলোকন করছে। বার্মিজ সেনাবাহিনী সেখানে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, গুম, জোরপূর্বক বহিস্কারের মতো অপরাধ করে চলেছে। এখানে নারী ও শিশুদেরও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতে পুড়ে যাওয়া শত শত রোহিঙ্গা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। এসব গ্রাম থেকে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই শরণার্থীদের অর্ধেকের বেশি শিশু।
অন্যদিকে, বক্তৃতার ফুলঝুরি ছুটছে, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন প্রধান গলা ফাটিয়ে নিন্দা করছেন। ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্কের নেতাদের কাছ থেকে নিন্দাবাদ করা হয়েছে। অন্যদিকে, গণতন্ত্রের ব্যানারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বর্মি জান্তা এসব নিন্দাবাদে কান দিচ্ছে না। কারণ, কেউ তাদেরকে বলছে না যে তাদের নেতাদের জাবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার জন্য তাদেরকে হেগে’র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। সেখানে অপরাধ প্রমাণ হলে যাবজ্জীবন নিশ্চিত। সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিচ ও রাটকো ম্লাদিচের ভাগ্যের কথা কেউ মিয়ানমার জান্তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক আইনে যেখানে বিশ্বজনিন বিচার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কিভাবে তার অপকর্মের জন্য নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পাচ্ছে? দেশটির ওপর কয়েক দশক যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিলো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৬ সালের অক্টোবর তা তুলে নেন। এরপর থেকে দেশটির বিরুদ্ধে আর নতুন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা অবশ্য রাশিয়া, ইরান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলার মতো দেশগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বেশি আগ্রহী। মিয়ানমার নেত্রী অং সাং সুচি’কে যে কারণে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিলো তার সঙ্গে তিনি বিশ^াসঘাতকতা করেছেন বলে অভিযোগে পুরস্কার বাতিলের দাবি উঠেছে। একে মিয়ানমারের লজ্জাজনক কাজের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র আকারের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আখ্যায়িত করা যায়।
২০০৫ সালে জাতিসংঘের সকল ১৯১ সদস্য ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ (আর২পি) নীতি অনুমোদন করেন। এই দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে একটি দেশ তার নিজ নাগরিকদের রক্ষা করবে অথবা তার সার্বভৌমত্ব বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। গণহত্যা বিষয়ে ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশনের ভিত্তিতে তৈরি এই নীতিতে বলা হয়েছে, সকল রাষ্ট্র গণহত্যা, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান, ও ব্যাপক-আকারে নৃশংসতা প্রতিরোধ, বন্ধ ও শাস্তি দিবে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ‘আর২পি’ পাস করে লিবিয়ায় অভিযান চালিয়ে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করে। গাদ্দাফি বেনগাজির বিদ্রোহীদের নির্মূলের হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়। মিয়ানমারে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তারচেয়েও বেশি গুরুতর; এখানে কোন হুমকি দেয়া হয়নি, সরাসরি নির্মূল অভিযান চালানো হচ্ছে, অনেক বড় আকারে।
‘দ্যা প্রব্লেম ফ্রম হেল’ বইয়ে সামান্থা পাওয়ার উল্লেখ করেছেন যে একের পর এক গণহত্যা – কম্বোডিয়া, ইরাক, বসনিয়া, রুয়ান্ডা – বিশ্বশক্তি কিছু করতে পারেনি। কোন গণহত্যা শুরু হওয়ার আগে জাতিসংঘ ও বিশ্বশক্তিগুলো অনেক সময় পায় তা প্রতিরোধ করার জন্য। কোন দেশ যখন তার নাগরিকদের রক্ষা করে না তখন তাদের রক্ষা করতে জাতিসংঘ সেনা রয়েছে, বিশেষ করে এ ধরনের মিশনের জন্য যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়। এরা আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে পারে। দেশটিকে জাতিসংঘ হুমকি দিয়ে বলতে পারে যে আর কোন সেব্রেনিসা সহ্য করা হবে না। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে এর কিছুই করা হয়নি।
কেউ কেউ সন্দেহ করেন যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ ধরনের অর্থবহ কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না। নিষেধাজ্ঞা থেকে সীমিত সেনা অভিযান চালানোর হুমকি কিছু দেয়া হবে না। কারণ, দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন চীনকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে। আরো ব্যাপক অর্থে এটা হলো চীনের সীমান্তবর্তী দেশগুলো সঙ্গে সামরিক মিত্রতা গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে এ কাজটি করেছিলো। এটা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা মিয়ানমার সফর করেন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের ওপর নিজের প্রভাব বজায় রাখতে চীনও সচেষ্ট।
এসব ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনাগুলো তাদের জায়গায় থাক। কিন্তু, মিয়ানমারের মতো একটি দেশের সেনাবাহিনী যখন বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন ওই ভূরাজনীতি এক পাশে সরিয়ে রাখা উচিত। তা নাহলে, মানবাধিকার নিয়ে এসব উচ্চস্বরের বক্তব্য ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে। বিশ্বের নেতাদের ওই একই প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের যখন কচুকাটা করা হচ্ছিলো তখন আপনারা কি করেছেন? আপনারা রুয়ান্ডায় গণহত্যা ঘটতে দিয়েছেন, সেব্রেনিসা দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেন; আপনাদের কথার কি দাম আছে। আপনাদের জন্য লজ্জা, আমাদের জন্যও লজ্জা।