হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৭৮ সালে প্রথম রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর বাংলাদেশের ওপর বেশ আন্তর্জাতিক চাপ আসে প্রথম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এবং পরে আশ্রয়প্রার্থীদের অমতে প্রত্যাবাসন না করানোর জন্য। নিজ গৃহ থেকে উৎপাটিত হাজার হাজার নরনারী সীমান্তে পৌঁছালে তাদের ঠেকানো সীমান্তরক্ষীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলত দুই মাসের মাথায় দুই লাখ শরণার্থী কক্সবাজার-বার্মা সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এদের রাখা হয় প্রথমে সীমান্তসংলগ্ন কয়েকটি অস্থায়ী শিবিরে। শিবিরগুলো বিস্তৃত ছিল নাফ নদীর তীর থেকে কক্সবাজার হয়ে বান্দরবান এলাকার নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের বয়স মাত্র সাত, দেশ কিছুদিন আগে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে গেছে। দেশে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সদ্য শেষ হয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশ তখন নাজুক। এই পরিস্থিতে দুই লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় ও ত্রাণ দেওয়া ছিল আয়ত্তের বাইরে। প্রথম এক মাস আমরা ধাক্কাটা সামলে ছিলাম জেলার ত্রাণসামগ্রী দিয়ে। এরপর অন্যান্য জেলা থেকে পাঠানো সরঞ্জাম দিয়ে। কয়েক দিন পর আসতে শুরু করে বিদেশি সাহায্য, প্রথম আন্তর্জাতিক রেডক্রস, পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসে। এর ওপর ছিল আন্তর্জাতিক শরণার্থী সাহায্য সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান বাংলাদেশের জন্য যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, তেমনি ছিল নিরাপত্তার হুমকি। কারণ, রোহিঙ্গারা সবাই নিরীহ ছিল না, এদের মধ্যে ছিল কিছু ব্যক্তি, যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে আরাকান রাজ্যে পৃথক রোহিঙ্গা ভূমির চিন্তা করত। এদের মধ্যে কেউ কেউ অস্ত্র ধারণ করে আরাকানে গোপনে হামলা চালাত। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা শিবির থাকলে এখান থেকেও তারা এই গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে বলে আমাদের কাছে (স্থানীয় প্রশাসন) খবর ছিল।
এসব কারণে জেলা প্রশাসন থেকে আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করি, যাতে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘকালীন আশ্রয়ের চিন্তা না করে তাদের প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করা হয়। আর এ প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে শুধু বর্মি (বর্তমানে মিয়ানমার) সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে। সুখের বিষয়, এ সুপারিশ সরকার গ্রহণ করে এবং বর্মি সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৮-এর শেষ দিকে। প্রথমে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা হয় ঢাকায়। পরেরটি ঠিক আলোচনা নয়, এটি ছিল বার্মার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর দলের কক্সবাজার সীমান্তে চাক্ষুষ রোহিঙ্গা শিবির দর্শন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে সে দলকে স্বাগত জানাই এবং তাদের নিয়ে শিবিরে শিবিরে ঘুরি।
তৃতীয় ও শেষ আলোচনা হয় আরাকান রাজ্যের মংগদু শহরে, যা সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। আমিও দলে ছিলাম। আলোচনায় শরণার্থীদের বিনা প্রতিবন্ধকতায় বার্মা সরকার ফিরিয়ে নিতে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিতে কিস্তিতে কিস্তিতে শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার স্থান ও সময়সীমা স্থির হয়। স্থান নির্ধারিত হয় ঘুনধুম সীমান্ত পোস্ট। প্রথম শরণার্থী দল ফেরত যাওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হলেও দুটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমটি হলো রোহিঙ্গাদের নিজেদের থেকে, আর দ্বিতীয় হলো আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর উত্থাপিত। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত ব্যক্তি প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণা চালাতে শুরু করে যে শরণার্থীরা আরাকানে ফিরে গেলে তাদের ওপর নির্যাতন হবে। তারা দাবি করে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রদত্ত নিরাপত্তার আশ্বাস এবং পুনর্বাসনে সাহায্য। এদিকে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে যে রোহিঙ্গাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরাকানে ফিরতে বাধ্য না করা হয়।
প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণা শরণার্থী প্রত্যাবাসনকাজে বেশ বাধা সৃষ্টি করে এবং এর সমাধান করতে প্রশাসনকে বেশ বেগ পেতে হয়। একপর্যায়ে কক্সবাজারের একটি শিবিরে যখন শরণার্থী প্রত্যাবাসনের জন্য নাম নিবন্ধনের কাজ চলছিল, তখন রোহিঙ্গাদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টিকারী কিছু ব্যক্তি সরকারি কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে পুলিশ গুলি ছুড়তে বাধ্য হয় এবং তাতে কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী মারা যায়। এ ঘটনায় কিছু হতাহত হলেও প্রত্যাবাসন নিবন্ধনের কাজে পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গা গোলযোগকারীরা বাধা দেয়নি। বাধা আসে আরও পরে, যখন প্রত্যাবাসনের প্রথম দফার শরণার্থীদের ঘুনধুম সীমান্তবর্তী শিবিরে জড়ো করা হয় আরাকানে প্রত্যাবাসনের জন্য।
প্রত্যাবাসনের আগের রাতে বেশ কিছু রোহিঙ্গা লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শিবিরের পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। তারা সম্পূর্ণ শিবিরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং দাবি জানায় যে প্রত্যাবাসনের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তারা এ দাবি তাদের এক মুখপাত্রের মাধ্যমে স্থানীয় উখিয়া থানায় জানায়।
আমি ঘটনার রাতে কক্সবাজারে ছিলাম। খবর পেয়ে আমি ও জেলা পুলিশ সুপার উখিয়ায় পৌঁছে যাই। তখন মধ্যরাত। সারা কক্সবাজার মহকুমায় তখন ছিল পুরো একটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, তার এক অংশ ছিল উখিয়া থানায়। আমরা আর্মড পুলিশের একটি প্লাটুন নিয়ে ঘুনধুম শিবিরে পৌঁছে প্রথমে যাই বাইরের পুলিশ ক্যাম্পে। সেখানে কয়েকজন পুলিশ অস্ত্রবিহীন
অবস্থায় দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে তাঁরা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে থাকেন কীভাবে তাঁরা এক অতর্কিত আক্রমণের শিকার হন। আমাদের
সঙ্গে ছিল রোহিঙ্গাদের তথাকথিত মুখপাত্র। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কীভাবে তাদের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। যোগাযোগ করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল ক্যাম্পে আবদ্ধ রিফিউজি কমিশনারের অবস্থা জানতে।
মুখপাত্রটি জানালেন যে পুলিশ ক্যাম্প, যা এখন তাদের দখলে, সেখানে বেতার টেলিফোন আছে, আমরা তার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারব। আমরা তা-ই করলাম। প্রায় দুই ঘণ্টার আলাপ-আলোচনার পর বিদ্রোহীরা রাজি হলো আমাকে ও আমার মহকুমা প্রশাসককে শিবিরে ঢুকতে দিতে এবং রিফিউজি কমিশনারকে বের করে নিয়ে আসতে। আরও রাজি হলো পুলিশের অস্ত্র ফিরিয়ে দিতে, তবে তাদের শর্ত হলো, এক, প্রত্যাবাসন বন্ধ করতে হবে এবং যেসব শরণার্থীকে ঘুনধুুমে জড়ো করা হয়েছে, তাদের নিজের শিবিরে ফিরিয়ে নিতে হবে। পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।
আমি শর্তে রাজি হলাম। কারণ, আমার প্রধান চিন্তা ছিল রিফিউজি কমিশনারের নিরাপত্তা। তাঁকে উদ্ধার ও অস্ত্র ফেরত খুব জরুরি ছিল। ভোররাতে শিবিরে ঢুকে প্রথমে উদ্ধার করি রিফিউজি কমিশনারকে। তারা তাঁকে একটি ক্ষুদ্র কুটিরে আটকে রেখেছিল। রিফিউজি কমিশনার উষ্মা প্রকাশ করলেন শরণার্থী প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ার ওপর। তাঁর মতে, রোহিঙ্গাদের অমতে কোনো প্রত্যাবাসন হওয়া উচিত নয়। আমি হ্যাঁ হ্যাঁ করতে করতে তাঁকে নিয়ে বাইরে এলাম। এসে দেখলাম, বিদ্রোহীরা অস্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছে। পুলিশ ক্যাম্প পুলিশ আবার ফেরত পেয়েছে। আমি আমার পরবর্তী শর্ত অনুযায়ী নেতাদের বললাম, যেসব শরণার্থী পরিবার প্রত্যাবাসনের জন্য জড়ো হয়েছিল, তাদের নিয়ে আমি কক্সবাজারে চলে যাচ্ছি। এই বলে আমি শিবিরের কর্মকর্তাদের সে পরিবারগুলোকে বাসে তুলে দিতে বলি। প্রায় ৪০ জন শরণার্থী নিয়ে আমি কক্সবাজার অভিমুখে রওনা হই। বাসের সামনে ও পেছনে ছিল দুই ট্রাকভর্তি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সেপাই।
কক্সবাজার অভিমুখে শরণার্থীদের নিয়ে যাওয়া ছিল একটি পুরো ভাঁওতা, আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল কোনোমতে তাদের বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের হাত থেকে বের করে এনে ঘুনধুম সীমান্ত দিয়ে তাদের আরাকানে প্রত্যাবাসন করা। মাইল পাঁচেক যাওয়ার পর আমি পুলিশ সুপারের সঙ্গে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বাস ঘোরাতে বলি।
ঘুনধুম শরণার্থী শিবির সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল ভেতরে, তাই বাস ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় শিবিরের সামনে দিয়ে যেতে হলো না। আগে থেকেই সীমান্তে খবর দেওয়া ছিল শরণার্থীদের নিয়ে পৌঁছানোর কথা। এবার শুধু বলে দেওয়া হলো সময়।
দুপুরের কিছু পর সীমান্তে পৌঁছে দেখি সেখানে আমাদের সীমান্ত কর্মচারীদের সঙ্গে মহকুমা প্রশাসক, আর কিছু সাংবাদিক। ঘুনধুম সীমান্ত নাফ নদীর পাড়ে, কিন্তু নদীটি সেখানে খুব সরু। দেখলাম শরণার্থী পারাপার হওয়ার জন্য বর্মি কর্তৃপক্ষ একটি কাঠের পুল বানিয়েছে। আমরা ৪০ জন শরণার্থী নিয়ে কয়েকজন করে পুল পার হলাম। ওপারে গিয়ে বর্মি কর্তৃপক্ষের কাছে শরণার্থীদের পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসি। সম্পূর্ণ ঘটনা শেষ হতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে।
সেদিনের প্রত্যাবাসনের পর এ প্রক্রিয়া চলে কয়েক মাস। প্রায় চার মাসে দুই লাখ শরণার্থীর প্রায় সবাই ফিরে যায়। বর্মি সরকার কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি কিংবা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধীরাও।
আজ প্রায় চার দশক পর আমরা আবার সম্মুখীন হচ্ছি আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থীপ্রবাহের। এর মধ্যে চার লাখ লোক ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। তারা আসতে থাকবে যত দিন না বার্মা (মিয়ানমার) সরকার নিজেদের উদ্যোগে এ প্রবাহ বন্ধ করে।
চার দশকের আগের পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতির মধ্যে অনেক পার্থক্য। রোহিঙ্গাদের উৎপীড়নের সূত্র শুধু মিয়ানমার সরকারই নয়, আরাকানের বৌদ্ধ সমাজও। এর ওপর রয়েছে রোহিঙ্গাদের নিজস্ব সৃষ্ট সশস্ত্র বাহিনী, যারা সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল কিছুদিন আগে। দুঃখের বিষয়, এত দিন যে গোষ্ঠী পৃথিবীর কাছে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হিসেবে পরিগণিত ছিল, আজ তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এসেছে। এই অভিযোগের দোহাই দিয়ে অনেক দেশ (যেমন ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র) রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করবে। তাই, আজ আমাদের কাজ হবে প্রথমে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসা, আর সঙ্গে ভারতকে এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানানো। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমরা বাইরের দুনিয়ায় বাহবা পাব, অনেক ত্রাণসামগ্রীও পাব। যেটা পাব না তা হচ্ছে এই লাখ লাখ লোকের আশ্রয়ের স্থান। এ স্থান বাংলাদেশকেই দিতে হবে, যত দিন না মিয়ানমার সরকার এদের দেশে ফিরে যেতে দেয়। আর তারা ফিরে যাবে তখনই, যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করবে।