হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিয়ানমার থেকে কেবল গত তিন সপ্তাহে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের অর্ধেকের বেশি শিশু। আর এসব শিশুর মধ্যে এমন শত শত শিশু আছে, যারা কোনো না কোনোভাবে তাদের পরিবারকে হারিয়ে অসহায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শিশুসহ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের স্রোত এখনো কমছে না। ফলে সবার জন্য জরুরি সেবা নিশ্চিত করা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো।
জাতিসংঘের হিসাবে গত ২৫ আগস্ট থেকে চার লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সেখানে তারা এখন খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর আশ্রয়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।
আশ্রয়শিবিরগুলোর অবস্থা সম্পর্কে জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থা ইউনিসেফের মুখপাত্র ক্রিস্টোফ বুলিয়ার্ক বলেন, ‘শিবিরগুলোতে লোকজন একেবারে উপচে পড়ছে। প্রতিদিনই বৃষ্টি আর কাদায় মাখামাখি। ’ তিনি জানান, উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করতে চরম চাপের মধ্যে আছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘খোলাখুলিই বলছি, আমরা সাহায্য বাড়াচ্ছি। কিন্তু (রোহিঙ্গাদের) স্রোত খুব বেশি।
’
ইউনিসেফের মুখপাত্র বুলিয়ার্ক জানান, গত ২৫ আগস্ট থেকে কেবল বাংলাদেশেই ঢুকেছে দুই লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শিশু। ইউনিসেফের সর্বশেষ গতকাল শুক্রবারের হিসাব অনুযায়ী, এক হাজার ২৬৭ শিশুকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে চরম অব্যবস্থাপনার কারণে এসব শিশু মানবপাচার, যৌন নিগ্রহ, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের প্রচণ্ড ঝুঁকিতে আছে। এ পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি শিশুর জন্য খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের একটু বিনোদন ও খেলার জন্য ৪১টি কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ বিনোদনকেন্দ্রও রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে একাকী অসহায় শিশুদের চিহ্নিত করা সহজতর হবে বলে মনে করছেন ইউনিসেফকর্মীরা।
কেবল শিশুরাই নয়, ঝুঁকিতে আছে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ও নারীরাও। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনপিএফ) হিসাব অনুযায়ী, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে ও নারী। তাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ নারী হয় গর্ভবতী অথবা শিশুকে বুকের দুধ দিচ্ছে, এমন মা। এসব নারীর সংখ্যা আরো বাড়ছে জানিয়ে বুলিয়ার্ক বলেন, ‘উদ্বেগজনক খবরটা হলো, এই স্রোত কমার কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ’
বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে অধিকারবঞ্চিত এবং তারা নিপীড়নের শিকার। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তাদের আরো কোণঠাসা করে ফেলা হয়। ওই সময় থেকেই থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূলের অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার। এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট রাখাইনের সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলা হলে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের একেবারে অবরুদ্ধ করে ফেলে তাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ ও জ্বালাওপোড়াও চালাতে থাকে সরকারি বাহিনী। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যেভাবে পারছে, পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গতকাল জানায়, গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে ৬২টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কারা দায়ী, সে সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অংশের ডেপুটি পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, ‘স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে যা বোঝা গেছে, আমাদের মাঠপর্যায়ের গবেষণাও সেটাকে সমর্থন করছে—রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে গণহারে অগ্নিকাণ্ডের জন্য সরাসরি বার্মিজ (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী দায়ী। ’
সূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস।