আতঙ্কে যুবলীগ ছাত্রলীগ

যুবলীগ ও ছাত্রলীগে এখন রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের তিন নেতা-কর্মীকে কথিত ক্রসফায়ার দেওয়ার পর পরিস্থিতি ক্রমাগত ভীতিকর হয়ে উঠছে। টানা দুই বার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে বার বার বিতর্কের মধ্যে ঠেলে দেওয়ায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রশ্নে কঠোর অবস্থানে সরকার। রাজধানীর হাজারীবাগে এক যুবকের আলোচিত হত্যাকাণ্ড ও মাগুরায় মায়ের গর্ভজাত সন্তান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নিয়ে বিতর্কের ঝড় শুরু হয়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ঘটনায় জড়িতদের খুঁজতে থাকে। হাজারীবাগের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা আরজু মিয়া নিহত হন র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে। মাগুরায়ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মেহেদী হাসান ওরফে আজিবর শেখ। দুটি পৃথক ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত দুই অপরাধীর নিহত হওয়ার ঘটনায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগে এখন চরম আতঙ্ক। সর্বশেষ বুধবার রাতে কুষ্টিয়ায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন জাকির হোসেন। শোকদিবসের দিন কুষ্টিয়ায় ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার মামলার আসামি ছিলেন তিনি। সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী অনেক ক্যাডার সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, আত্দকলহ, অভ্যন্তরীণ হত্যাকাণ্ড, প্রতিপক্ষকে হত্যা বা টেন্ডার, চাঁদাবাজিতে যারা যুক্ত তাদের সহযোগীদের অনেকেই এখন এলাকায় নেই। এমনকি বন্ধ করে রেখেছেন নিজেদের মোবাইল ফোন। তাদের মধ্যে এখন এক ধরনের কথিত ক্রসফায়ার আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে একাধিক নেতা জানিয়েছেন। সম্প্রতি রাজউকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের ভাগাভাগি যারা করেছেন তাদের অনেকেই এখন ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরসহ বিদেশ ভ্রমণে। রাজধানীর হাজারীবাগে ছাত্রলীগ নেতার হাতে কিশোর খুন, বাড্ডায় এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে ট্রিপল মার্ডার, চাঁদপুরের কচুয়ায় স্কুলশিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর যুবলীগের হামলা, মাগুরায় যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মায়ের গর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ, বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনাগুলোয় অসন্তোষ বাড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেই। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অপরাধীদের জন্য মন্ত্রী-দলীয় নেতাদের তদবির করতে নিষেধ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনার পর দুই ছাত্রলীগ ও এক যুবলীগ নেতা ইতিমধ্যে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। দলীয় সূত্র জানায়, দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সরকারকে বিব্রত করেছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনার পর এসব ব্যাপারে হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তের বিষয়টি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়েও এরই মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে নেমে পড়ে। অনেকেই মনে করেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরতে কঠোর পদক্ষেপই প্রয়োজন ছিল। যদিও কেউ কেউ মনে করেন, ক্রসফায়ার শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল বয়ে আনে না। স্বল্প মেয়াদে তা কার্যকর মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্ম দেয়। দ্রুত বিচারকেই সর্বোত্তম সমাধান মনে করেন তারা। দলের হাইকমান্ডের হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড্ডার ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় দুজনকে আটক করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তারা দায়ও স্বীকার করেছে। এ ঘটনার পরপরই এ এলাকায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডার রাজনীতি করতেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতেন এমন বেশ কয়েকজন নেতা গা ঢাকা দিয়েছেন। কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলার সন্দেহভাজন আসামি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর এখন এলাকায় অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন। নিজেদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো হত্যাকেই সমর্থন করি না। তবে কথিত ক্রসফায়ারের নামে বাড়ি থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা ছাত্রলীগ নেতাদের জন্য শুভ সংবাদ না। দল ক্ষমতায় থাকবে, আর আমাদেরই বিনাবিচারে হত্যা করা হবে, বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড সেটা হোক ক্রসফায়ার বা গণপিটুনি কোনোটাই আমরা সমর্থন করি না। দেশে আইন, আদালত আছে। কেউ অপরাধ করলে তাদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি হবে। কিন্তু ক্রসফায়ার দিয়ে মারবে, বা গণপিটুনি দিয়ে মারবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি দাবি করেন, গণপিটুনিতে নিহত রাজা ঘটনার এক সপ্তাহ আগে চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনি খেয়ে মাথা ফাটিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্রদল কিংবা অন্য যে কোনো দলেরই সদস্য হোক না কেন, কেউ অপরাধী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মঙ্গলবার ক্রসফায়ারে ছাত্রলীগের দুই নেতার নিহতের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেটা ক্রসফায়ার ছিল না, বন্দুকযুদ্ধ ছিল। মন্ত্রী বলেন, অপরাধীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীও তার বার্তা আগেই পেঁৗছিয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার। গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অবুঝ শিশু হত্যা ও অন্তঃসত্ত্বা নারীর ওপর হামলাকারীরা রেহাই পাবে না। অপরাধী যে দলেরই হোক তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে-অপরাধী কাউকে যাতে ছাড় দেওয়া না হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি পুলিশের ক্রসফায়ারে ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সব সংকটের সমাধান ক্রসফায়ারে নয়। ছাত্রলীগকে সমাধান করতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শবান হিসেবে তৈরি করতে হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে আর ছাত্রলীগকে ক্রসফায়ারে মারবে এটা কাম্য নয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর