রোহিঙ্গা নিধনের দায়ে সু চি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনী কেন অভিযুক্ত হবে না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অবশেষে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনও (ইউএনএইচসিআর) বলল, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগতভাবে নিধনযজ্ঞ চলছে। তাদের কাছে এসংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিধনযজ্ঞের তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়েই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৩৬তম সভায় ইউএনএইচসিআর প্রধান জায়িদ রা’দ আল হুসেইন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এর আগেও সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘গত বছর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা দেখে আমি সতর্ক করেছিলাম। এটি একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক পরিসরে বা ধারাবাহিক আক্রমণ। এসব ঘটনা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সম্ভবত মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও তুলে ধরা যাবে। ’ তিনি আরো বলেন, মানবাধিকার তদন্তদলকে ঢুকতে দিতে মিয়ানমার অস্বীকৃতি জানানোয় পরিস্থিতি পুরোপুরি মূল্যায়ন করা যায়নি, তবে সেখানকার পরিস্থিতিকে জাতিগতভাবে নির্মূলের ‘টেক্সটবুক এক্সামপল’ বলেই মনে হচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারে জঙ্গি-সন্ত্রাসী দমনের নামে নিরাপত্তা বাহিনীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা নির্মূল ও নিধন অভিযানে তিন হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার হাত থেকে নারী-শিশুরাও রেহাই পায়নি। বিশ্বের গণমাধ্যম তো বটেই, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের চিত্র উঠে আসছে।

মিয়ানমার বাহিনীর নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে না পেরে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময় আরো প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার দেশে এত মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এই চাপ এবং বোঝা বহন করার ক্ষমতাও বাংলাদেশের নেই। কেবল মানবিক কারণে সরকার তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতার যে নিদর্শন তিনি দেখিয়েছেন, তা সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

মিয়ানমার বাহিনীর নিধনযজ্ঞের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর সবার দৃষ্টিতে পড়ে। কোনো সচেতন মানুষই তাঁর সফরটিকে ভালোভাবে নেয়নি। বলা হচ্ছে, চীনকে চাপে ফেলতেই তিনি এই সফর করেন। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। সেই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি। উত্তেজনা এখনো চলমান।

আমরা জানি, ভূ-রাজনৈতিক কারণে চীন মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চীনা সেনাবাহিনীর আদলে গড়া। চীনা সেনাবাহিনীই মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে তৈরি করেছে। মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রতিবেশী হিসেবে ভারতও বিগত দুই দশক মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নিয়েছে। এখানে উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত।

এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে ভারত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রায় দুই কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি অংশ নিয়েছে। তাদের অনেক অফিসার ও সেনা সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় ভূমিকা রেখেছে। সেই দেশটি যখন বিপদের সম্মুখীন তখন ভারতের মতো দেশ বাংলাদেশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। অতীতেও বাংলাদেশের যেকোনো ধরনের বিপদে ভারত পাশে ছিল। এখনো বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

মিয়ানমারে যা চলছে, তা কোনো মানবতাবাদী দেশ সমর্থন করতে পারে না। আমি নিশ্চিত ভারতকে ভুল বোঝানো হয়েছিল।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির দল এখন ক্ষমতায়। সংগত কারণেই রোহিঙ্গা নিধনের সব দায়-দায়িত্ব তাঁর ওপরই বর্তায়। শান্তিতে নোবেল পেয়ে মিয়ানমারে অশান্তি সৃষ্টি করেছেন বলে তাঁর নোবেল কেড়ে নেওয়ার দাবি উঠেছে। তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে তিনি যদি বলতেন, ‘আমি একজন মানবাধিকার নেত্রী। আমার দেশে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। আমি এর প্রতিবাদে সরকার থেকে পদত্যাগ করছি। ’ তাহলে হয়তো তিনি কিছুটা রক্ষা পেতেন।

উল্টো তিনি বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, রাখাইনে সন্ত্রাসীদের দমন করতে সেনা অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের আড়ালে যে গণহত্যা চলছে, তা তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করলেন। সু চি রোহিঙ্গা শব্দটিও বলতে নারাজ। তিনি বললেন রাখাইনের জনগোষ্ঠী। বিবিসি সাংবাদিককে ধন্যবাদ যে তিনি জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিষয়ে সু চিকে প্রশ্নটি করেছিলেন। আর এভাবেই হয়তো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।

মিয়ানমার বন্ধু রাষ্ট্র হলেও সেই দেশটির অন্যায় কাজের প্রতি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভারত কী করে সমর্থন করে? রাষ্ট্রীয় নীতি যা-ই থাকুক, ভারত জাতিগতভাবে নিধনযজ্ঞের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে না। তা ছাড়া একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার নীতিকেও সমর্থন করতে পারে না। ভারত বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভাষার দেশ। এটা ভারতের ঐতিহ্য। চিরায়ত সেই ঐতিহ্য থেকে ভারত বিচ্যুত হবে বলেও মনে করি না।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, চীন যে শুধু মিয়ানমারের বন্ধু তা নয়, বাংলাদেশেরও বন্ধু।   বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চীন সহযোগিতা না করলেও ১৯৭৫ সালের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে। শেখ হাসিনা সরকার চীনের অতীতের ভূমিকার কথা মনে না রেখে সম্পর্কের উন্নয়ন করেছে। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে চীন ভূমিকা রেখেছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের জলসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুটি ডুবোজাহাজ দিয়েছে।

দুই বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারত ও চীনের মতো বন্ধু থাকতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিপদে থাকবে তা কী করে হয়! নিশ্চয়ই ভারত ও চীন নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি যা-ই থাকুক, বাংলাদেশকে বিপদে ফেলবে না। নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশকে ‘টুলস’ হিসেবেও ব্যবহার করবে না।

চলমান রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও চীন সফর করবেন। উভয় দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বোঝাবেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের কাছে যেতে হবে। উন্নত দেশগুলোর কাছে সহায়তা চাইতে হবে। যদিও বাংলাদেশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ ছাড়াও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার মূলে বাংলাদেশের ‘প্রো-অ্যাকটিভ ডিপ্লোমেসি’ কাজ করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি প্রাধান্য পাচ্ছে।

একটা বিষয় উপলব্ধি করতে হবে, নিকট প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই কিন্তু রোহিঙ্গারা বিপদে পড়লে বারবার বাংলাদেশে ছুটে আসছে। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমার সীমান্ত বরারব কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাখত, তাহলে হয়তো রোহিঙ্গা ঢুকতে পারত না। হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে সাগরে ডুবে হয়তো মরতে হতো।

অথচ একসময় রোহিঙ্গাদের স্বাধীন ভূমি ছিল। সাবেক বার্মার আরাকান রাজ্যটি ছিল রোহিঙ্গাদের। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব ঘটে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে থাকে। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে রোহিঙ্গারা আত্মপ্রকাশ করে। রাখাইন তাদের আবাসস্থল। এখন তারা নিজ ভূমে পরবাসী।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জাতি হিসেবে মানতে পারছে না। তারা মনে-প্রাণে রোহিঙ্গাবিরোধী। রোহিঙ্গাবিরোধী মানসিকতার কারণেই তারা ওই জাতিকে বিলুপ্ত করার নীলনকশা প্রণয়ন করে। সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে তারা প্রথমেই আরাকানের নাম বদল করে রাখাইন রাখে। এরপর শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালে রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে অভিহিত করে। এরপর শুরু হয় হয়রানি। ১৯৮২ সালের আইন তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১২ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে কার্যত অবরুদ্ধ রাখা হয়। তাদের পরিচয়পত্র বাতিল, ভোটাধিকার খর্ব করার পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হয়। যোগাযোগ অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে একটি পশ্চাত্পদ অঞ্চলে পরিণত করা হয়।

সেই পশ্চাত্পদ অঞ্চলের মানুষের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মেতে উঠেছে নিধনযজ্ঞে। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাখাইন সম্প্রদায় নািস সমর্থক জাপানিদের পক্ষ নিলেও রোহিঙ্গারা ছিল মিত্র বাহিনীর পক্ষে।

ধিক, মিয়ানমার সেনাপ্রধানের বক্তব্য। আমরা তাঁর বক্তব্যের নিন্দা জানাই এবং রাখাইনে গণহত্যার দায়ে অং সান সু চি ও মিয়ানমার সেনাপ্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করছি। তাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এর প্রমাণ জাতিসংঘের কাছেই রয়েছে।

এ ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং উন্নত দেশগুলোর উচিত সহযোগিতা দেওয়া। একই সঙ্গে অবিলম্বে রোহিঙ্গারা যাতে নিজেদের আবাসভূমিতে ফিরে যেতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তা না হলে বিশ্বজুড়ে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হবে। বিশ্ববিবেক তখন শুধু তাকিয়ে দেখবে। কিছুই করার থাকবে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর