ঢাকা ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অষ্টগ্রামে চার’শ বছরের ঐতিহাসিক কুতুব শাহ মসজিদ আজ ধ্বংসের মুখে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০১:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ অগাস্ট ২০১৫
  • ৫১৯ বার

প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদটি টিকে আছে। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় মসজিদটির কোনো কোনো অংশের নকশা চুন সুড়কির প্রলেপ কিছুটা বিনষ্ট হলেও নিজস্ব মহিমায় দাড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক কুতুব শাহ মসজিদ।

কিশোরগঞ্জের গভীর হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম সদরে পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির অবস্থান। দেশের পুরাকীর্তিগুলোর অন্যতম কুতুব শাহ মসজিদটির ইতিহাস অনেকই জানেন না। যারা এ সম্পর্কে গবেষনা করেন তারাও মসজিদটির ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। প্রায় ৭৩ শতাংশ ভূমির উপর মসজিদটির অবস্থান। সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তকার মাঠ। কিনার দিয়ে আম, জাম, কাঁঠাল,সুপাড়ি, কাঁঠাল চাঁপা গাছের কিছুটা বিুব্দ সারি। মৌসুমী ফলের গাছগুলোতে প্রতি বছর ফুল ফলের আগমন হাওরবাসীকে বিমুগ্ধ করে। নামাজের সময় এলাকার মুসল্লি ছাড়া অন্যরা প্রবেশ না করলেও নামাজের সময় ছাড়া দর্শনার্থীরা উৎসুক্য দৃষ্টি নিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনটি অবলোকন করে। তাদের পদচারনায় নিরিবিলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। মসজিদের সামনে পুকুরটির স্বচ্ছ পানি দূর থেকে আসা পথিকের দ্রোহ কান্তিকে দূর করে। দূর থেকে পাঁচ গম্বুজওয়ালা প্রাচীন স্থাপত্যটিকে অন্যরকম সুন্দর দেখায়।
পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে কুতুব শাহের মাজার ও আরও পাঁচটি মাজারে কোনো শিলালিপি বা তারিখ পাওয়া যায়নি। বিশিষ্ট লোক ঐতিহ্য সংগ্রহ মোঃ সাইদুর সম্পাদিত কিশোরগঞ্জ গ্রন্থে এ নির্মাণশৈলী বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, এতে সুলতানী আমলের বৈশিষ্ট্য থাকলেও মোঘল প্রভাবই বেশী। অধ্যাপক ধানির মতে, মসজিদটি ষোড়শ শতকের শেষার্ধে নির্মিত হয়েছিল। তবে এ েেত্র শ্রদ্ধেয় আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিশ্লেষন প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পাঠান সম্রাট শের শাহর রাজ্যভূক্ত হয়। পাঠান রাজত্বের শেষে ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলা এই অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই অঞ্চলের মোঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সুবেদার ইসলাম খানের আমলে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এতে দেখা যাচ্ছে যে, মুঘল অধিকারের পরে যদি এ মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে, তবে তা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের আগে হতে পারে না। আর ঈশা খাঁর আমালে যদি এ মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে তবে তা ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে হতে পারে। ঈশা খাঁর আমলে নির্মিত হলে এত মোঘল প্রভাব থাকার কথা নয়। সঙ্গত কারণে তাই ধারনা করা যায় যে, মসজিদটি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে নির্মিত হয়েছিল।

মসজিদে পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। এর ভিতর মাজের গস্বুজটি বৃহৎ। মসজিদটি আয়তকার। বাইরের দিক থেকে দৈর্ঘ্যে ৪৫´ফুট। চার কোণে চারটি আট কোণাকার বুরুজ আছে। এগুলো মোল্ডিং দ্বারা শোভিত এবং চূড়া ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো মসজিদের কার্নিশগুলো বেশ বাঁকানো, যা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষন করে।
পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দনি দেয়ালে দুটি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। পূর্বের তিনটির প্রবেশ দ্বারের মধ্যে মাঝেরটি অপোকৃত বড়। পূর্ব ও পশ্চিম দেয়াল প্রায় পাঁচফুট এবং উত্তর ও দনি দেয়াল প্রায় ৪.৫ ফুট প্রশস্থ। দেয়ালের বাইরের দিকে পোড়ামাটির চিত্র ফলকের অলংকরণ ছিল। যার সামান্য নমুনা আজও অবিশিষ্ট রয়েছে। পূর্বদিকের দেয়াল দুই সারি প্যানেল দ্বারা শোভিত। প্রবেশদ্বারগুলো অর্ধবৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত। কালের ভ্রুকুটি উপো করে ব্যাতিক্রমধর্মী এই পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট আয়তকার মসজিদটি অনেকটাই শীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে।
কুতুবশাহের মসজিদ ও মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর বাংলা মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার বিশাল ওরশ মোবারক হয়ে থাকে।

মসজিদ ও মাজার শরীফ উন্নয়নের জন্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন উদাসীন বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। প্রায় দেড় দশক আগে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির সামান্য উন্নয়ন করে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার মাঝেই কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া যে দল সরকার গঠন করে সেই দলের প্রভাবশালী লোকজন মসজিদ ও মাজারের নিয়ন্ত্রন করে বলে স্থানীয়রা জানান। মসজিদ ও মাজারের জমিজমা নিয়েও আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে বলে মজারের খাদেম শাহ আব্দুল আজিজ জানান। মসজিদটির উত্তর ও পশ্চিম দিকের দেয়ালে বেশ কয়েকটি বড় বড় ফাঁটল দেখা গেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ উদাসীন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি যে কোন সময় ধ্বংস হতে পারে।
দেশের অন্যতম ঐতিহাসিক এই ঐতিহ্যটিকে রা ও এর সুষ্ঠু সংরনে সরকার ব্যবস্থা নেবে এই প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ সচেতন মহলের।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

অষ্টগ্রামে চার’শ বছরের ঐতিহাসিক কুতুব শাহ মসজিদ আজ ধ্বংসের মুখে

আপডেট টাইম : ১২:০১:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ অগাস্ট ২০১৫

প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদটি টিকে আছে। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় মসজিদটির কোনো কোনো অংশের নকশা চুন সুড়কির প্রলেপ কিছুটা বিনষ্ট হলেও নিজস্ব মহিমায় দাড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক কুতুব শাহ মসজিদ।

কিশোরগঞ্জের গভীর হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম সদরে পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির অবস্থান। দেশের পুরাকীর্তিগুলোর অন্যতম কুতুব শাহ মসজিদটির ইতিহাস অনেকই জানেন না। যারা এ সম্পর্কে গবেষনা করেন তারাও মসজিদটির ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। প্রায় ৭৩ শতাংশ ভূমির উপর মসজিদটির অবস্থান। সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তকার মাঠ। কিনার দিয়ে আম, জাম, কাঁঠাল,সুপাড়ি, কাঁঠাল চাঁপা গাছের কিছুটা বিুব্দ সারি। মৌসুমী ফলের গাছগুলোতে প্রতি বছর ফুল ফলের আগমন হাওরবাসীকে বিমুগ্ধ করে। নামাজের সময় এলাকার মুসল্লি ছাড়া অন্যরা প্রবেশ না করলেও নামাজের সময় ছাড়া দর্শনার্থীরা উৎসুক্য দৃষ্টি নিয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনটি অবলোকন করে। তাদের পদচারনায় নিরিবিলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। মসজিদের সামনে পুকুরটির স্বচ্ছ পানি দূর থেকে আসা পথিকের দ্রোহ কান্তিকে দূর করে। দূর থেকে পাঁচ গম্বুজওয়ালা প্রাচীন স্থাপত্যটিকে অন্যরকম সুন্দর দেখায়।
পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে কুতুব শাহের মাজার ও আরও পাঁচটি মাজারে কোনো শিলালিপি বা তারিখ পাওয়া যায়নি। বিশিষ্ট লোক ঐতিহ্য সংগ্রহ মোঃ সাইদুর সম্পাদিত কিশোরগঞ্জ গ্রন্থে এ নির্মাণশৈলী বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, এতে সুলতানী আমলের বৈশিষ্ট্য থাকলেও মোঘল প্রভাবই বেশী। অধ্যাপক ধানির মতে, মসজিদটি ষোড়শ শতকের শেষার্ধে নির্মিত হয়েছিল। তবে এ েেত্র শ্রদ্ধেয় আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিশ্লেষন প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পাঠান সম্রাট শের শাহর রাজ্যভূক্ত হয়। পাঠান রাজত্বের শেষে ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলা এই অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই অঞ্চলের মোঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সুবেদার ইসলাম খানের আমলে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এতে দেখা যাচ্ছে যে, মুঘল অধিকারের পরে যদি এ মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে, তবে তা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের আগে হতে পারে না। আর ঈশা খাঁর আমালে যদি এ মসজিদ নির্মিত হয়ে থাকে তবে তা ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে হতে পারে। ঈশা খাঁর আমলে নির্মিত হলে এত মোঘল প্রভাব থাকার কথা নয়। সঙ্গত কারণে তাই ধারনা করা যায় যে, মসজিদটি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে নির্মিত হয়েছিল।

মসজিদে পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। এর ভিতর মাজের গস্বুজটি বৃহৎ। মসজিদটি আয়তকার। বাইরের দিক থেকে দৈর্ঘ্যে ৪৫´ফুট। চার কোণে চারটি আট কোণাকার বুরুজ আছে। এগুলো মোল্ডিং দ্বারা শোভিত এবং চূড়া ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো মসজিদের কার্নিশগুলো বেশ বাঁকানো, যা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষন করে।
পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দনি দেয়ালে দুটি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। পূর্বের তিনটির প্রবেশ দ্বারের মধ্যে মাঝেরটি অপোকৃত বড়। পূর্ব ও পশ্চিম দেয়াল প্রায় পাঁচফুট এবং উত্তর ও দনি দেয়াল প্রায় ৪.৫ ফুট প্রশস্থ। দেয়ালের বাইরের দিকে পোড়ামাটির চিত্র ফলকের অলংকরণ ছিল। যার সামান্য নমুনা আজও অবিশিষ্ট রয়েছে। পূর্বদিকের দেয়াল দুই সারি প্যানেল দ্বারা শোভিত। প্রবেশদ্বারগুলো অর্ধবৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত। কালের ভ্রুকুটি উপো করে ব্যাতিক্রমধর্মী এই পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট আয়তকার মসজিদটি অনেকটাই শীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে।
কুতুবশাহের মসজিদ ও মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর বাংলা মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার বিশাল ওরশ মোবারক হয়ে থাকে।

মসজিদ ও মাজার শরীফ উন্নয়নের জন্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন উদাসীন বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। প্রায় দেড় দশক আগে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির সামান্য উন্নয়ন করে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার মাঝেই কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তাছাড়া যে দল সরকার গঠন করে সেই দলের প্রভাবশালী লোকজন মসজিদ ও মাজারের নিয়ন্ত্রন করে বলে স্থানীয়রা জানান। মসজিদ ও মাজারের জমিজমা নিয়েও আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে বলে মজারের খাদেম শাহ আব্দুল আজিজ জানান। মসজিদটির উত্তর ও পশ্চিম দিকের দেয়ালে বেশ কয়েকটি বড় বড় ফাঁটল দেখা গেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগ উদাসীন। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি যে কোন সময় ধ্বংস হতে পারে।
দেশের অন্যতম ঐতিহাসিক এই ঐতিহ্যটিকে রা ও এর সুষ্ঠু সংরনে সরকার ব্যবস্থা নেবে এই প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ সচেতন মহলের।