ঢাকা ১১:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেভাবে সুফিবাদের পীঠস্থানে পরিণত হয় খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩৩:৪৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ২ বার

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সুফিবাদ, এবং রহস্যময়তার পীঠস্থান হলো ভারতের রাজস্থানের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ। ধর্ম, সম্প্রদায় এবং ভৌগলিক সীমানার চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে এটি এমন এক স্থান অর্জন করেছে, যা পরিদর্শন করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন।

শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীই নন, হিন্দুরা দর্শনার্থীও আজমিরের এই দরগাহে উপস্থিত হন। এখানে নারীরাও প্রবেশ করতে পারেন। বহু হিন্দু নারীই এই দরগাহে আসেন মানত করতে।

এই মুহূর্তে খবরের শিরোনামে রয়েছে আজমিরের দরগাহ, তবে অন্য কারণে। শিব মন্দিরের উপরে এই দরগাহ বানানো হয়েছিল বলে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন হিন্দু সেনা নামে এক সংগঠনের সভাপতি ভিষ্ণু গুপ্তা। তার দাবির স্বপক্ষে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক হরবিলাস সারদারের বইয়ের তথ্য-সহ তিনটে কারণ উল্লেখ করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন গুপ্তা এবং সেখানে হিন্দুদের পুজো করার অনুমতির জন্যও আবেদন জানিয়েছেন।

ভিষ্ণু গুপ্তার দাবি, মন্দিরের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অন্যদিকে, আজমির দরগাহের প্রধান উত্তরাধিকারী এবং খওয়াজা মইনুদ্দিন চিশতির বংশধর সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতি ওই দাবিকে ‘সস্তা প্রচার পাওয়ার জন্য স্টান্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের সম্ভলস্থিত শাহী জামা মসজিদকে ঘিরেও একই দাবি তোলা হয়েছিল। নিম্ন আদালতের নির্দেশে সেখানে জরিপের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জরিপ চলছিল। জরিপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানিয়ে হঠাৎ মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলে তিনদিক থেকে পাথর ও ইটবৃষ্টি শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ বাঁধে। এই ঘটনায় চারজন মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও স্থানীয় কর্মকর্তা মিলিয়ে দু’পক্ষের একাধিক ব্যক্তি জখমও হয়েছেন।

এই আবহে, আগামী ২০ ডিসেম্বর আজমিরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ সংক্রান্ত মামলার শুনানি রয়েছে। অন্যদিকে, জানুরারি মাসের আট তারিখ খাজা মইনুদ্দিন চিশতির উরস। সেই উপলক্ষ্যে প্রতিবছর দুই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে শামিল হন কয়েক লক্ষ মানুষ। বেশ আগে থেকেই উৎসবের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই দরগাহকে ঘিরে যে দাবি ও পাল্টা দাবির ঝড় উঠেছে তাকে কেন্দ্র করে আজমিরের পরিস্থিতি অন্যবারের তুলনায় বেশ আলাদা।

‘গরীব নওয়াজ’

আজমিরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত দরগাহগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারত ছাড়াও, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সুদূর আমেরিকা, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে মানুষ এই দরগাহ পরিদর্শনে আসেন। দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিবিদরা এখানে চাদর দেন।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ রাজস্থানের এই দরগাহ যার নামে তৈরি, তিনি হলেন রহস্যবাদী দার্শনিক ও সুফি সাধক মইনুদ্দিন চিশতি। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘গরীব নওয়াজ’ নামেই পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে, ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার পরিপন্থী এই দরগাহ সম্প্রীতি ও উদারতার বার্তা দেয় এবং তার নেপথ্যে রয়েছেন স্বয়ং মইনুদ্দিন চিশতি।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার গ্রন্থ ‘আকবর’-এ যেসব মুসলিম সাধককে ‘মুসলিম সাম্যবাদী’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন সুফি সাধক ও দার্শনিক খাজা মইনুদ্দিন চিশতি তাদের মধ্যে প্রথম। তিনি ১১৪২ সালে ইরানের সানজার (সিস্তান) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার খ্যাতি ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা অতিক্রম করার পাশাপাশি ধর্মের গণ্ডিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

বিখ্যাত রহস্যবাদী সাধক খাজা ওসমান হারুনির শিষ্য ছিলেন তিনি। মইনুদ্দিন চিশতি ১১৯২ সালে প্রথমে লাহোর, তারপর দিল্লি এবং পরে আজমির পৌঁছান। এর আগে, বাগদাদ ও হেরাত হয়ে বেশ কয়েকটা বড় শহর সফরের সময় সেখানকার প্রসিদ্ধ রহস্যবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

তরাইনের যুদ্ধের পর এমন এক সময়ে তিনি আজমিরে আসেন যখন ভারতে মুসলিম শাসন শুরু হচ্ছিল। কুতুবউদ্দিন আইবেক, ইলতুৎমিশ, আরাম শাহ, রুকনুদ্দীন ফিরোজ ও রাজিয়া সুলতানার সময়কার ঘটনা এটা। কথিত আছে, মোহময়ী সাধক ও অতীন্দ্রিয়বাদী ছিলেন মইনুদ্দিন চিশতি। জীবনাদর্শ এবং বার্তা বিখ্যাত করে তুলেছিল তাকে। তার খ্যাতির বিষয়ে জানতে পেরে ইলতুৎমিশ নিজে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বলেও শোনা যায়। কথিত আছে, রাজিয়া সুলতানাও বহুবার আজমিরে এসেছিলেন।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি মনে করতেন মানুষ শান্ত থেকেও কারও অত্যাচারকে প্রতিহত করতে পারে। তার এই বার্তার জন্যই যেন সেই সময় ভারত অপেক্ষা করছিল। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক এবং আর্য সমাজের অনুগামী হরবিলাস সারদা তার বই ‘আজমির: হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ডেসক্রিপটিভ’ বইয়ে মইনুদ্দিন চিশতির ফকিরানা জীবন শৈলীর বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এই দরগাহকে আজমিরের ‘ঐতিহাসিক কীর্তি’ হিসাবেও বর্ণনা করেছেন তিনি।

তার জীবনদর্শনের বিখ্যাত ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। কথিত আছে, বহুদিনই তিনি নিজে একটা রুটি খেতেন কিন্তু ক্ষুধার্তদের জন্য সব সময় লঙ্গর প্রস্তুত থাকত। অসহায় এবং ক্ষুধার্ত দরিদ্রদের প্রতি তার আতিথেয়তার কথা কারোরই অজানা ছিল না।

ঐতিহাসিক রানা সাফভি লিখেছেন, “খাজা মইনুদ্দিন চিশতির বক্তৃতা রাজা ও কৃষক উভয়কেই আকৃষ্ট করেছিল। আজমিরের নাম শুনলেই খাজা গরিব নওয়াজ ও তার দরগাহের ছবি মনে ভেসে ওঠে। এই সাধক সমুদ্রের মতো উদার এবং তার অতিথিপরায়ণতা ছিল বিশ্বের মতো ব্যাপক।” ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু হয় মঈনুদ্দিন চিশতির।

দরগাহ তৈরির ইতিহাস

খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মৃত্যুর পর তার সমাধিতে এই দরগাহের নির্মিত হয় যা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মান্ডুর সুলতান মাহমুদ খিলজি ও তার পরে গিয়াসউদ্দিন সেখানে সমাধিসৌধ এবং সুন্দর একটা গম্বুজ নির্মাণ করেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সম্ভবত প্রথম সম্রাট ছিলেন যিনি ১৩২৫ সালে এই দরগাহ পরিদর্শন করেন।

আর তুঘলক শাসক জাফর খান দরগাহ পরিদর্শন করেছিলেন ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। সফরকালে সময় দরগাহের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বহু উপহার দিয়েছিলেন তিনি। মান্ডুর খিলজি ১৪৫৫ সালে আজমিরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন। সেই সময় এই দরগাহ তার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তার শাসনকালে দরগাহের প্রাঙ্গণে বিশাল ফটক, বুলন্দ দরওয়াজা এবং মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর আগে পর্যন্ত তেমন পোক্ত কোনও নির্মাণ ছিল না সেখানে।

ঐতিহাসিকদের মতে, আদি দরগাহ ছিল কাঠের তৈরি। পরে এর উপর একটা পাথরের ছাউনি নির্মাণ করা হয়। ইতিহাসবিদ রানা সাফাভির মতে, “দরগাহ পরিসরে নির্মাণের প্রথম মজবুত প্রমাণ হল তার গম্বুজ যা ১৫৩২ সালে অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। এটা সমাধির উত্তর দেয়ালে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটা শিলালিপি থেকে স্পষ্ট।”

“এই সেই সুন্দর গম্বুজ যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গম্বুজকে পদ্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং রামপুরের নবাব হায়দার আলী খানের দেওয়া একটা সোনার মুকুট এর উপরে স্থাপন করা হয়েছে।”

শেখ মঈনুদ্দিন চিশতিকে নিয়ে অনেকৎ ‘গল্প’ সংগ্রহ করেছেন ফজলুল্লাহ জামালি। তার মতে দরগায় বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন হতো এবং হিন্দুদের পক্ষ থেকে মুজাভিরদের উপহারও দেওয়া হত। ফজলুল্লাহ জামালির (মৃত্যু ১৫৩৬) মতে, সেই সময় দরগাহ সাবজাওয়ার, মিহনা, জিল, বাগদাদ এবং হামাদানের লোকদের মধ্যে সুপরিচিত ছিল।

আকবরের সঙ্গে দরগাহের সম্পর্ক

আকবর যখন প্রথমবার এই দরগাহ পরিদর্শনে এসেছিলেন ততদিনে খওয়াজা মঈনুদ্দিন চিশতির খ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন আকবর গ্রন্থে লিখেছেন, “এক রাতে আকবর আগ্রার নিকটবর্তী একটা গ্রাম থেকে শিকারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। সেখানে কিছু মানুষের মুখে আজমিরের খওয়াজার প্রশংসা শুনে তার অন্তরে ভক্তি জেগে ওঠে। ১৫৬২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে আজমির যাত্রা শুরু করেন।”

আবুল ফজল আবার লিখেছেন, “এক রাতে তিনি (আকবর) শিকারের জন্য ফতেহপুর গিয়েছিলেন। সেই সময় আগ্রা থেকে ফতেপুর যাওয়ার পথে গ্রামের কিছু লোক খওয়াজা মঈনুদ্দিনের গৌরব ও গুণাবলী সম্পর্কে একটি সুন্দর গান গাইছিল।” সেখান থেকেই এই দরগাহের বিষয়ে জানতে পারেন তিনি।

দরগাহের প্রতি মুঘল সম্রাট আকবরের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার‘আকবর’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “১৫৭২ সালের এপ্রিল মাসে সন্তান লাভের মানত করে আকবর পায়ে হেঁটে জিয়ারতের উদ্দেশে রওনা হন এবং প্রতিদিন ১৪ মাইল গতিতে ১৬ মঞ্জিল অতিক্রম করে আজমির পৌঁছান।”

কিছু তথ্য আবার বলছে, তিনি সন্তান লাভের আশায় ফতেপুর সিক্রি থেকে খালি পায়ে দরগাহে গিয়েছিলেন। প্রতি বছর দরগাহ পরিদর্শনের জন্য আগ্রা থেকে আজমির পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন তিনি। আকবর দরগাহে একটা মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন, যাকে আকবরী মসজিদ বলা হয়।

ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন, “আকবর প্রথম মুঘল শাসক যিনি ১৫৬২ সালে প্রথমবার দরগাহ পরিদর্শন করেছিলেন। দরগাহের সাথে যুক্ত লোকদের উপহার ও অনুদান দিয়েছিলেন।” তার মতে ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আকবর তার প্রথমবারের মানত পূরণের জন্য পায়ে হেঁটে দরগাহে এসেছিলেন।

আকবর দেখেছিলেন যে হাজার হাজার দরিদ্র ও তীর্থযাত্রীদের জন্য লঙ্গরের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই তিনি আজমির, চিতোর এবং রণথম্ভোরের ১৮টা গ্রাম দিয়ে দেন।

আকবর ১৫৬৯ সালে আজমিরে একটা মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী তৈরি হয় লাল বেলেপাথরের আকবরী মসজিদ। শাহজাহান ১৬৩৭ সালে একটা সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা দরগাহের পশ্চিমে শাহজাহানী দরওয়াজার সঙ্গে অবস্থিত।

দরগাহে আগত মানুষদের জন্য আকবর এবং জাহাঙ্গীর অনেক ব্যবস্থা করেছিলেন যার উল্লেখ হরবিলাস সারদার বইয়ে পাওয়া যায়। সম্ভর হ্রদ থেকে দরগাহ ২৫ শতাংশ নুন পেত যার পরিবর্তে সেই সময় মিলত ৭ টাকা। দরগাহের লঙ্গরের জন্য মোট পাঁচ হাজার সাত টাকা দেওয়া হতো।

বৈরাম খাঁর শাসনের অবসানের পরপরই ১৫৬০ সালের একটা সনদের কথা জানা যায় যেখানে দরগাহের এক সেবককে ২০ বিঘা জমি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে দরগাহের যোগ

আকবরের প্রথমবার আজমির সফরএর (১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে) আগেই দরগাহের সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই কাজ মুঘলরা ক্ষমতায় থাকাকালীন তো বটেই এমন কী তার পরেও এই সংস্কার অব্যাহত ছিল।

দরগাহের বিষয়ে আকবরের আগ্রহ শুরু হয় তার শাসন বর্গের মধ্যে ভারতীয় উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার নীতি থেকে। কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে মুঘলরা ঐতিহ্যগতভাবে সুফিবাদের নকশবন্দি সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিল।

আকবর শুধু খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহেই নয়, দিল্লির অন্যান্য চিশতি সুফিদের সমাধিতেও যেতেন। ঐতিহাসিকদের মতে দরগাহকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ শুধুমাত্র আকবরের আধ্যাত্মিক চিন্তাই ছিল না, এটা ভারতে মুঘল শাসনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেও সাহায্য করেছিল।

ব্রিটিশ শাসনামলেও এই দরগাহ আধ্যাত্মিক গুরুত্বের কেন্দ্র ছিল। তবে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আসে।

অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাস

আজমিরের এই দরগাহ পরিদর্শনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আসেন এবং এই পরম্পরা শত শত বছর ধরেই চলে আসছে। বার্ষিক উরস উৎসবের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হন এবং এই রীতিই এখনও চলে আসছে। এখানে নারীদের অবাধ প্রবেশ রয়েছে। হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারীরাও এই দরগাহ দর্শনের জন্য আসেন, কেউ বা নিজের মনোকামনা পূরণের জন্য মানত করেন। শুরু থেকেই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষেরা এই দরগাহে আসতেন, সেই রীতি এখনও রয়েছে।

উরস এবং মিলাদ-উন-নবী এই দুই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয় এই দরগাহে। ঐতিহাসিকদের মতে, খওয়াজা মঈনুদ্দিন চিশতির এমন এক স্থানকে আধ্যাত্মিকতার জন্য বেছে নিয়েছিলেন যা হিন্দুদের জন্য ইতিমধ্যে পবিত্র ছিল। সেখানে ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে। আর খওয়াজা মৈনুদ্দিন চিশতির হাত ধরে আজমির দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই তীর্থের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক দাবি ও পাল্টা দাবি

প্রায় ৮০০ বছরের ইতিহাসে দিল্লির সুলতান, মুঘল সম্রাট, রাজপুত, মারাঠা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে , খওয়াজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ। তবে এর আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে কেউ আদালতের দ্বারস্থ হননি যেমনটা এখন হয়েছে।

হিন্দুসেনার জাতীয় সভাপতি বিষ্ণু গুপ্তার দাবি, দরগাহের নিচে হিন্দু মন্দির রয়েছে। হরবিলাস সারদার বইয়ের তথ্যকেই তার মামলার অন্যতম ভিত্তি করেছেন তিনি। গুপ্তার কথায়, “ব্রিটিশ শাসনামলে আজমির মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ছিলেন হরবিলাস সারদা, ১৯১১ সালে লেখা তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে দরগাহ মন্দিরের উপর নির্মিত হয়েছিল। আমরা তার উপর ভিত্তি করে আবেদন তৈরি করেছি।”

“আমরা নিজেদের পর্যায়ে গবেষণা করেছি এবং বইয়ে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দরগাহ পরিদর্শন করেছি। একটা হিন্দু মন্দির ভেঙে দরগার কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। দরগার দেওয়াল ও দরজায় খোদাই করা ছবি হিন্দু মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়।”

তার দাবির তৃতীয় ভিত্তি সম্পর্কে বিষ্ণু গুপ্তার বলেন, “আজমিরের প্রত্যেক মানুষ জানেন এবং তাদের পূর্বপুরুষরাও বলছেন যে সেখানে একটা শিবলিঙ্গ ছিল।” তিনি বলেন, “আমাদের বক্তব্য হলো এটা আজমির দরগাহ নয়, এটা সঙ্কটমোচন মহাদেব মন্দির। দরগাহ উপরে রয়েছে, নিচে ভগবান শিবের মন্দির ছিল।”

১৯১১ সালে হারবিলাস সারদার লেখা বই ‘আজমির: হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ডেসক্রিপটিভ’-এ একাধিক বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। বইয়ে দরগাহ খাজা মইনুদ্দিন চিশতিরও একটা অধ্যায় রয়েছে। ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে দরগাহে মহাদেব মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।

ইংরেজিতে লেখা ওই বইয়ের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “ঐতিহ্য অনুসারে বলা হয় বেসমেন্টের ভিতরে একটা মন্দিরে মহাদেবের মূর্তি রয়েছে, যার উপর একটা ব্রাহ্মণ পরিবার প্রতিদিন চন্দন কাঠ রাখত।” এর ভিত্তিতেই বিষ্ণু গুপ্তা আদালতে আবেদন জানিয়েছেন।

আজমির শরিফের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা অঞ্জুমান কমিটি গুপ্তার দাবি খারিজ করে দিয়েছে। অঞ্জুমান কমিটির সেক্রেটারি সৈয়দ সরওয়ার চিশতি বিবিসিকে বলেন, “আমরা বংশানুক্রমিক খাদিম, যারা গত ৮০০ বছর ধরে দরগাহের সঙ্গে সম্পর্কিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য কাজ করছি। কিন্তু এক্ষেত্রে (মামলায়) আমাদের কোনও পক্ষই করা হয়নি।”

তিনি বলেন, “আঞ্জুমান কমিটি খাদিমদের প্রতিনিধিত্ব করে, আর দরগাহ কমিটি শুধু তদারকির কাজ করে। এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র, যা আমরা হতে দেব না। আমরা আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছি। আমরা আদালতে যাব।”

হরবিলাস সারদার বই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তার কথায়, “সারদাজি আর্য সমাজের সভাপতি ছিলেন। তিনি হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের আমলে তাকে রায় উপাধি দেওয়া হয়। তিনি হিন্দু সুপিরিয়রিটির মতো একটি বই লিখেছেন যা তার মতাদর্শের কথা বলে।”

সৈয়দ সরওয়ার চিশতি বলেছেন হরবিলাস সারদার ওই বইয়ের কথা সর্বত্র উদ্ধৃত হচ্ছে, তবে ১৯১৫ সালে তার দেওয়া একটা সিদ্ধান্তের কথা কোথাও বলা হচ্ছে না। তিনি বলেন, “১৯১৫ সালে প্রদত্ত সিদ্ধান্তে সারদাজি লিখেছিলেন যে, দরগাহের খাদিম বংশানুক্রমিক। তাদের উত্তরাধিকার রয়েছে এবং দরগাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।”

“একটা বই লেখা এবং রায় দান দুটো ভিন্ন জিনিস। তার বিচারে তিনি কোথাও লেখেননি যে দরগাহে মন্দির ছিল এবং কয়েকজন ব্রাহ্মণ সেখানে উপাসনা করতেন।

” সূত্র: বিবিসি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

যেভাবে সুফিবাদের পীঠস্থানে পরিণত হয় খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ

আপডেট টাইম : ১০:৩৩:৪৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সুফিবাদ, এবং রহস্যময়তার পীঠস্থান হলো ভারতের রাজস্থানের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ। ধর্ম, সম্প্রদায় এবং ভৌগলিক সীমানার চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে এটি এমন এক স্থান অর্জন করেছে, যা পরিদর্শন করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন।

শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীই নন, হিন্দুরা দর্শনার্থীও আজমিরের এই দরগাহে উপস্থিত হন। এখানে নারীরাও প্রবেশ করতে পারেন। বহু হিন্দু নারীই এই দরগাহে আসেন মানত করতে।

এই মুহূর্তে খবরের শিরোনামে রয়েছে আজমিরের দরগাহ, তবে অন্য কারণে। শিব মন্দিরের উপরে এই দরগাহ বানানো হয়েছিল বলে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন হিন্দু সেনা নামে এক সংগঠনের সভাপতি ভিষ্ণু গুপ্তা। তার দাবির স্বপক্ষে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক হরবিলাস সারদারের বইয়ের তথ্য-সহ তিনটে কারণ উল্লেখ করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন গুপ্তা এবং সেখানে হিন্দুদের পুজো করার অনুমতির জন্যও আবেদন জানিয়েছেন।

ভিষ্ণু গুপ্তার দাবি, মন্দিরের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অন্যদিকে, আজমির দরগাহের প্রধান উত্তরাধিকারী এবং খওয়াজা মইনুদ্দিন চিশতির বংশধর সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতি ওই দাবিকে ‘সস্তা প্রচার পাওয়ার জন্য স্টান্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের সম্ভলস্থিত শাহী জামা মসজিদকে ঘিরেও একই দাবি তোলা হয়েছিল। নিম্ন আদালতের নির্দেশে সেখানে জরিপের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জরিপ চলছিল। জরিপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানিয়ে হঠাৎ মসজিদ সংলগ্ন অঞ্চলে তিনদিক থেকে পাথর ও ইটবৃষ্টি শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ বাঁধে। এই ঘটনায় চারজন মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও স্থানীয় কর্মকর্তা মিলিয়ে দু’পক্ষের একাধিক ব্যক্তি জখমও হয়েছেন।

এই আবহে, আগামী ২০ ডিসেম্বর আজমিরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ সংক্রান্ত মামলার শুনানি রয়েছে। অন্যদিকে, জানুরারি মাসের আট তারিখ খাজা মইনুদ্দিন চিশতির উরস। সেই উপলক্ষ্যে প্রতিবছর দুই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে শামিল হন কয়েক লক্ষ মানুষ। বেশ আগে থেকেই উৎসবের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই দরগাহকে ঘিরে যে দাবি ও পাল্টা দাবির ঝড় উঠেছে তাকে কেন্দ্র করে আজমিরের পরিস্থিতি অন্যবারের তুলনায় বেশ আলাদা।

‘গরীব নওয়াজ’

আজমিরের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত দরগাহগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারত ছাড়াও, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সুদূর আমেরিকা, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে মানুষ এই দরগাহ পরিদর্শনে আসেন। দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিবিদরা এখানে চাদর দেন।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ রাজস্থানের এই দরগাহ যার নামে তৈরি, তিনি হলেন রহস্যবাদী দার্শনিক ও সুফি সাধক মইনুদ্দিন চিশতি। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘গরীব নওয়াজ’ নামেই পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে, ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার পরিপন্থী এই দরগাহ সম্প্রীতি ও উদারতার বার্তা দেয় এবং তার নেপথ্যে রয়েছেন স্বয়ং মইনুদ্দিন চিশতি।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার গ্রন্থ ‘আকবর’-এ যেসব মুসলিম সাধককে ‘মুসলিম সাম্যবাদী’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন সুফি সাধক ও দার্শনিক খাজা মইনুদ্দিন চিশতি তাদের মধ্যে প্রথম। তিনি ১১৪২ সালে ইরানের সানজার (সিস্তান) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার খ্যাতি ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা অতিক্রম করার পাশাপাশি ধর্মের গণ্ডিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

বিখ্যাত রহস্যবাদী সাধক খাজা ওসমান হারুনির শিষ্য ছিলেন তিনি। মইনুদ্দিন চিশতি ১১৯২ সালে প্রথমে লাহোর, তারপর দিল্লি এবং পরে আজমির পৌঁছান। এর আগে, বাগদাদ ও হেরাত হয়ে বেশ কয়েকটা বড় শহর সফরের সময় সেখানকার প্রসিদ্ধ রহস্যবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

তরাইনের যুদ্ধের পর এমন এক সময়ে তিনি আজমিরে আসেন যখন ভারতে মুসলিম শাসন শুরু হচ্ছিল। কুতুবউদ্দিন আইবেক, ইলতুৎমিশ, আরাম শাহ, রুকনুদ্দীন ফিরোজ ও রাজিয়া সুলতানার সময়কার ঘটনা এটা। কথিত আছে, মোহময়ী সাধক ও অতীন্দ্রিয়বাদী ছিলেন মইনুদ্দিন চিশতি। জীবনাদর্শ এবং বার্তা বিখ্যাত করে তুলেছিল তাকে। তার খ্যাতির বিষয়ে জানতে পেরে ইলতুৎমিশ নিজে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বলেও শোনা যায়। কথিত আছে, রাজিয়া সুলতানাও বহুবার আজমিরে এসেছিলেন।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি মনে করতেন মানুষ শান্ত থেকেও কারও অত্যাচারকে প্রতিহত করতে পারে। তার এই বার্তার জন্যই যেন সেই সময় ভারত অপেক্ষা করছিল। বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক এবং আর্য সমাজের অনুগামী হরবিলাস সারদা তার বই ‘আজমির: হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ডেসক্রিপটিভ’ বইয়ে মইনুদ্দিন চিশতির ফকিরানা জীবন শৈলীর বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এই দরগাহকে আজমিরের ‘ঐতিহাসিক কীর্তি’ হিসাবেও বর্ণনা করেছেন তিনি।

তার জীবনদর্শনের বিখ্যাত ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। কথিত আছে, বহুদিনই তিনি নিজে একটা রুটি খেতেন কিন্তু ক্ষুধার্তদের জন্য সব সময় লঙ্গর প্রস্তুত থাকত। অসহায় এবং ক্ষুধার্ত দরিদ্রদের প্রতি তার আতিথেয়তার কথা কারোরই অজানা ছিল না।

ঐতিহাসিক রানা সাফভি লিখেছেন, “খাজা মইনুদ্দিন চিশতির বক্তৃতা রাজা ও কৃষক উভয়কেই আকৃষ্ট করেছিল। আজমিরের নাম শুনলেই খাজা গরিব নওয়াজ ও তার দরগাহের ছবি মনে ভেসে ওঠে। এই সাধক সমুদ্রের মতো উদার এবং তার অতিথিপরায়ণতা ছিল বিশ্বের মতো ব্যাপক।” ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু হয় মঈনুদ্দিন চিশতির।

দরগাহ তৈরির ইতিহাস

খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মৃত্যুর পর তার সমাধিতে এই দরগাহের নির্মিত হয় যা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মান্ডুর সুলতান মাহমুদ খিলজি ও তার পরে গিয়াসউদ্দিন সেখানে সমাধিসৌধ এবং সুন্দর একটা গম্বুজ নির্মাণ করেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সম্ভবত প্রথম সম্রাট ছিলেন যিনি ১৩২৫ সালে এই দরগাহ পরিদর্শন করেন।

আর তুঘলক শাসক জাফর খান দরগাহ পরিদর্শন করেছিলেন ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। সফরকালে সময় দরগাহের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বহু উপহার দিয়েছিলেন তিনি। মান্ডুর খিলজি ১৪৫৫ সালে আজমিরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন। সেই সময় এই দরগাহ তার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তার শাসনকালে দরগাহের প্রাঙ্গণে বিশাল ফটক, বুলন্দ দরওয়াজা এবং মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর আগে পর্যন্ত তেমন পোক্ত কোনও নির্মাণ ছিল না সেখানে।

ঐতিহাসিকদের মতে, আদি দরগাহ ছিল কাঠের তৈরি। পরে এর উপর একটা পাথরের ছাউনি নির্মাণ করা হয়। ইতিহাসবিদ রানা সাফাভির মতে, “দরগাহ পরিসরে নির্মাণের প্রথম মজবুত প্রমাণ হল তার গম্বুজ যা ১৫৩২ সালে অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। এটা সমাধির উত্তর দেয়ালে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটা শিলালিপি থেকে স্পষ্ট।”

“এই সেই সুন্দর গম্বুজ যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গম্বুজকে পদ্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং রামপুরের নবাব হায়দার আলী খানের দেওয়া একটা সোনার মুকুট এর উপরে স্থাপন করা হয়েছে।”

শেখ মঈনুদ্দিন চিশতিকে নিয়ে অনেকৎ ‘গল্প’ সংগ্রহ করেছেন ফজলুল্লাহ জামালি। তার মতে দরগায় বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন হতো এবং হিন্দুদের পক্ষ থেকে মুজাভিরদের উপহারও দেওয়া হত। ফজলুল্লাহ জামালির (মৃত্যু ১৫৩৬) মতে, সেই সময় দরগাহ সাবজাওয়ার, মিহনা, জিল, বাগদাদ এবং হামাদানের লোকদের মধ্যে সুপরিচিত ছিল।

আকবরের সঙ্গে দরগাহের সম্পর্ক

আকবর যখন প্রথমবার এই দরগাহ পরিদর্শনে এসেছিলেন ততদিনে খওয়াজা মঈনুদ্দিন চিশতির খ্যাতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন আকবর গ্রন্থে লিখেছেন, “এক রাতে আকবর আগ্রার নিকটবর্তী একটা গ্রাম থেকে শিকারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। সেখানে কিছু মানুষের মুখে আজমিরের খওয়াজার প্রশংসা শুনে তার অন্তরে ভক্তি জেগে ওঠে। ১৫৬২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে আজমির যাত্রা শুরু করেন।”

আবুল ফজল আবার লিখেছেন, “এক রাতে তিনি (আকবর) শিকারের জন্য ফতেহপুর গিয়েছিলেন। সেই সময় আগ্রা থেকে ফতেপুর যাওয়ার পথে গ্রামের কিছু লোক খওয়াজা মঈনুদ্দিনের গৌরব ও গুণাবলী সম্পর্কে একটি সুন্দর গান গাইছিল।” সেখান থেকেই এই দরগাহের বিষয়ে জানতে পারেন তিনি।

দরগাহের প্রতি মুঘল সম্রাট আকবরের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার‘আকবর’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “১৫৭২ সালের এপ্রিল মাসে সন্তান লাভের মানত করে আকবর পায়ে হেঁটে জিয়ারতের উদ্দেশে রওনা হন এবং প্রতিদিন ১৪ মাইল গতিতে ১৬ মঞ্জিল অতিক্রম করে আজমির পৌঁছান।”

কিছু তথ্য আবার বলছে, তিনি সন্তান লাভের আশায় ফতেপুর সিক্রি থেকে খালি পায়ে দরগাহে গিয়েছিলেন। প্রতি বছর দরগাহ পরিদর্শনের জন্য আগ্রা থেকে আজমির পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন তিনি। আকবর দরগাহে একটা মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন, যাকে আকবরী মসজিদ বলা হয়।

ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন, “আকবর প্রথম মুঘল শাসক যিনি ১৫৬২ সালে প্রথমবার দরগাহ পরিদর্শন করেছিলেন। দরগাহের সাথে যুক্ত লোকদের উপহার ও অনুদান দিয়েছিলেন।” তার মতে ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আকবর তার প্রথমবারের মানত পূরণের জন্য পায়ে হেঁটে দরগাহে এসেছিলেন।

আকবর দেখেছিলেন যে হাজার হাজার দরিদ্র ও তীর্থযাত্রীদের জন্য লঙ্গরের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই তিনি আজমির, চিতোর এবং রণথম্ভোরের ১৮টা গ্রাম দিয়ে দেন।

আকবর ১৫৬৯ সালে আজমিরে একটা মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী তৈরি হয় লাল বেলেপাথরের আকবরী মসজিদ। শাহজাহান ১৬৩৭ সালে একটা সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা দরগাহের পশ্চিমে শাহজাহানী দরওয়াজার সঙ্গে অবস্থিত।

দরগাহে আগত মানুষদের জন্য আকবর এবং জাহাঙ্গীর অনেক ব্যবস্থা করেছিলেন যার উল্লেখ হরবিলাস সারদার বইয়ে পাওয়া যায়। সম্ভর হ্রদ থেকে দরগাহ ২৫ শতাংশ নুন পেত যার পরিবর্তে সেই সময় মিলত ৭ টাকা। দরগাহের লঙ্গরের জন্য মোট পাঁচ হাজার সাত টাকা দেওয়া হতো।

বৈরাম খাঁর শাসনের অবসানের পরপরই ১৫৬০ সালের একটা সনদের কথা জানা যায় যেখানে দরগাহের এক সেবককে ২০ বিঘা জমি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে দরগাহের যোগ

আকবরের প্রথমবার আজমির সফরএর (১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে) আগেই দরগাহের সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই কাজ মুঘলরা ক্ষমতায় থাকাকালীন তো বটেই এমন কী তার পরেও এই সংস্কার অব্যাহত ছিল।

দরগাহের বিষয়ে আকবরের আগ্রহ শুরু হয় তার শাসন বর্গের মধ্যে ভারতীয় উপাদান অন্তর্ভুক্ত করার নীতি থেকে। কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে মুঘলরা ঐতিহ্যগতভাবে সুফিবাদের নকশবন্দি সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিল।

আকবর শুধু খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহেই নয়, দিল্লির অন্যান্য চিশতি সুফিদের সমাধিতেও যেতেন। ঐতিহাসিকদের মতে দরগাহকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ শুধুমাত্র আকবরের আধ্যাত্মিক চিন্তাই ছিল না, এটা ভারতে মুঘল শাসনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেও সাহায্য করেছিল।

ব্রিটিশ শাসনামলেও এই দরগাহ আধ্যাত্মিক গুরুত্বের কেন্দ্র ছিল। তবে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আসে।

অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাস

আজমিরের এই দরগাহ পরিদর্শনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আসেন এবং এই পরম্পরা শত শত বছর ধরেই চলে আসছে। বার্ষিক উরস উৎসবের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হন এবং এই রীতিই এখনও চলে আসছে। এখানে নারীদের অবাধ প্রবেশ রয়েছে। হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারীরাও এই দরগাহ দর্শনের জন্য আসেন, কেউ বা নিজের মনোকামনা পূরণের জন্য মানত করেন। শুরু থেকেই সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষেরা এই দরগাহে আসতেন, সেই রীতি এখনও রয়েছে।

উরস এবং মিলাদ-উন-নবী এই দুই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হয় এই দরগাহে। ঐতিহাসিকদের মতে, খওয়াজা মঈনুদ্দিন চিশতির এমন এক স্থানকে আধ্যাত্মিকতার জন্য বেছে নিয়েছিলেন যা হিন্দুদের জন্য ইতিমধ্যে পবিত্র ছিল। সেখানে ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে। আর খওয়াজা মৈনুদ্দিন চিশতির হাত ধরে আজমির দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই তীর্থের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক দাবি ও পাল্টা দাবি

প্রায় ৮০০ বছরের ইতিহাসে দিল্লির সুলতান, মুঘল সম্রাট, রাজপুত, মারাঠা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে , খওয়াজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ। তবে এর আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে কেউ আদালতের দ্বারস্থ হননি যেমনটা এখন হয়েছে।

হিন্দুসেনার জাতীয় সভাপতি বিষ্ণু গুপ্তার দাবি, দরগাহের নিচে হিন্দু মন্দির রয়েছে। হরবিলাস সারদার বইয়ের তথ্যকেই তার মামলার অন্যতম ভিত্তি করেছেন তিনি। গুপ্তার কথায়, “ব্রিটিশ শাসনামলে আজমির মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ছিলেন হরবিলাস সারদা, ১৯১১ সালে লেখা তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে দরগাহ মন্দিরের উপর নির্মিত হয়েছিল। আমরা তার উপর ভিত্তি করে আবেদন তৈরি করেছি।”

“আমরা নিজেদের পর্যায়ে গবেষণা করেছি এবং বইয়ে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দরগাহ পরিদর্শন করেছি। একটা হিন্দু মন্দির ভেঙে দরগার কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। দরগার দেওয়াল ও দরজায় খোদাই করা ছবি হিন্দু মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়।”

তার দাবির তৃতীয় ভিত্তি সম্পর্কে বিষ্ণু গুপ্তার বলেন, “আজমিরের প্রত্যেক মানুষ জানেন এবং তাদের পূর্বপুরুষরাও বলছেন যে সেখানে একটা শিবলিঙ্গ ছিল।” তিনি বলেন, “আমাদের বক্তব্য হলো এটা আজমির দরগাহ নয়, এটা সঙ্কটমোচন মহাদেব মন্দির। দরগাহ উপরে রয়েছে, নিচে ভগবান শিবের মন্দির ছিল।”

১৯১১ সালে হারবিলাস সারদার লেখা বই ‘আজমির: হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ডেসক্রিপটিভ’-এ একাধিক বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। বইয়ে দরগাহ খাজা মইনুদ্দিন চিশতিরও একটা অধ্যায় রয়েছে। ৯৭ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে দরগাহে মহাদেব মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।

ইংরেজিতে লেখা ওই বইয়ের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “ঐতিহ্য অনুসারে বলা হয় বেসমেন্টের ভিতরে একটা মন্দিরে মহাদেবের মূর্তি রয়েছে, যার উপর একটা ব্রাহ্মণ পরিবার প্রতিদিন চন্দন কাঠ রাখত।” এর ভিত্তিতেই বিষ্ণু গুপ্তা আদালতে আবেদন জানিয়েছেন।

আজমির শরিফের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা অঞ্জুমান কমিটি গুপ্তার দাবি খারিজ করে দিয়েছে। অঞ্জুমান কমিটির সেক্রেটারি সৈয়দ সরওয়ার চিশতি বিবিসিকে বলেন, “আমরা বংশানুক্রমিক খাদিম, যারা গত ৮০০ বছর ধরে দরগাহের সঙ্গে সম্পর্কিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য কাজ করছি। কিন্তু এক্ষেত্রে (মামলায়) আমাদের কোনও পক্ষই করা হয়নি।”

তিনি বলেন, “আঞ্জুমান কমিটি খাদিমদের প্রতিনিধিত্ব করে, আর দরগাহ কমিটি শুধু তদারকির কাজ করে। এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র, যা আমরা হতে দেব না। আমরা আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছি। আমরা আদালতে যাব।”

হরবিলাস সারদার বই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তার কথায়, “সারদাজি আর্য সমাজের সভাপতি ছিলেন। তিনি হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের আমলে তাকে রায় উপাধি দেওয়া হয়। তিনি হিন্দু সুপিরিয়রিটির মতো একটি বই লিখেছেন যা তার মতাদর্শের কথা বলে।”

সৈয়দ সরওয়ার চিশতি বলেছেন হরবিলাস সারদার ওই বইয়ের কথা সর্বত্র উদ্ধৃত হচ্ছে, তবে ১৯১৫ সালে তার দেওয়া একটা সিদ্ধান্তের কথা কোথাও বলা হচ্ছে না। তিনি বলেন, “১৯১৫ সালে প্রদত্ত সিদ্ধান্তে সারদাজি লিখেছিলেন যে, দরগাহের খাদিম বংশানুক্রমিক। তাদের উত্তরাধিকার রয়েছে এবং দরগাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।”

“একটা বই লেখা এবং রায় দান দুটো ভিন্ন জিনিস। তার বিচারে তিনি কোথাও লেখেননি যে দরগাহে মন্দির ছিল এবং কয়েকজন ব্রাহ্মণ সেখানে উপাসনা করতেন।

” সূত্র: বিবিসি।