বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবিসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সময় বাংলাদেশকে এমন কতগুলো শর্ত মেনে নিতে হয়, যেগুলো দেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার চাপিয়ে দেওয়া শর্ত মেনেই ঋণ নিয়ে আসছে সরকারগুলো। তবে গত চার দশকে দেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তাই আগামী জানুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করতে যাওয়া এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে শর্তযুক্ত ঋণ নিতে আগ্রহী নয় সরকার। ব্যাংকটির কাছ থেকে শর্তমুক্ত ঋণ নিয়ে নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সে টাকা খরচ করতে চায় সরকার। ব্যাংকের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ৫৭ দেশের বৈঠক থেকে ফিরে সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এমনটিই জানালেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান।
রাজধানীর শেরে বাংলানগরের নিজ কার্যালয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তাই অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে সে ঋণ হতে হবে শর্তমুক্ত। ঋণ ব্যবহারের পুরো কর্তৃত্ব থাকতে হবে সরকারের হাতে। তাহলেই কেবল ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে। তাঁর মতে, লাভের গুড় পিঁপড়া খাবে, এটা মানা যায় না। সরকার ঋণ নেবে, কোনো দয়া, দাক্ষিণ্য কিংবা খয়রাতি নয়।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানো এআইআইবির কাছ থেকে শর্তমুক্ত ঋণ পাওয়ার আশ্বাসও পেয়েছে বাংলাদেশ। চীনের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলো যেসব শর্ত দিয়ে ঋণ দেয়, এআইআই ব্যাংক সে ধরনের কোনো শর্ত দেবে না। এআইআই ব্যাংকের কার্যক্রম হবে পুরোপুরি ভিন্ন। দেশটির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, পণ্য ও সেবা কেনাকাটার ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ থাকবে না। ঋণগ্রহীতা দেশগুলো তাদের নিজেদের পছন্দ মতো দেশ থেকে পণ্য ও সেবা কেনাকাটা করতে পারবে। ঠিকাদার নিয়োগ হবে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন মেনে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর কোনো শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন চীনের নীতিনির্ধারকরা।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জানান, এআইআই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কোন কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়, অগ্রাধিকারভিত্তিতে তার একটি তালিকা তৈরি করে তা দ্রুত বেইজিং পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে দেশটি। অবকাঠামো খাতে অগ্রাধিকার ঠিক করে প্রকল্পের তালিকা শিগগিরই বেইজিংয়ে পাঠানো হবে। এআইআই ব্যাংকের সুদের হার কত হবে জানতে চাইলে এম এ মান্নান বলেন, সুদের হার হবে প্রতিযোগিতামূলক। অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই নবগঠিত ব্যাংকটি পরিচালিত হবে। বিশ্বব্যাংক এখন দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ দিয়ে থাকে। এডিবির ঋণের সুদের হার দেড় থেকে দুই শতাংশ। এআইআই ব্যাংকের ঋণের সুদের হার থাকতে হবে মাঝামাঝি অবস্থানে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকে বেশি সুদে ঋণ দিলে সদস্য দেশগুলো সে ঋণ নেবে না। আবার ঋণের সুদের হার কম হলে অন্যান্য সংস্থা বাধা দেবে। সে ক্ষেত্রে দুইয়ের মাঝখানেই থাকবে সুদের হার জানান মন্ত্রী। বড় বড় অবকাঠামো উন্নয়নে এআইআই ব্যাংক বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার উন্মোচন হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
গত ২৯ জুন চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের গ্রেট হলে এআইআই ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই হয়েছে। আর্টিকেল অব অ্যাগ্রিমেন্টে বাংলাদেশসহ সই করেছে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫০টি দেশ। অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে সাতটি দেশ ২৯ জুন সই করতে পারেনি। ওইসব দেশকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আর্টিকেল অব অ্যাগ্রিমেন্টে সই করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এআইআই ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ১০ হাজার কোটি ডলার। আর পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান।
প্রতিমন্ত্রী জানান, এআইআই ব্যাংকের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর শেয়ার ও ভোটের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জিডিপির চলতি মূল্য ও ক্রয়ক্ষমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে। ওই বছর বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ১৬১ বিলিয়ন ডলার। জিডিপির চলতি মূল্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ পরিমাণ শেয়ার কেনার বিপরীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে পরিশোধিত মূলধন দুই হাজার কোটি ডলার হওয়ায় শেয়ারের ২০ শতাংশের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে ১৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা। পাঁচ কিস্তিতে বাংলাদেশকে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রতি কিস্তিতে প্রায় আড়াই কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ওই শেয়ারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মোট ভোটের সংখ্যা দাঁড়াবে ৯ হাজার ৬৩৫টি।
এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশ এখন যেসব দেশ ও সংস্থা থেকে ঋণ নেয়, সে ঋণ চুক্তির সময় বেশ কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয়। প্রকল্পের পরামর্শক, পণ্য কেনাকাটা ও ঠিকাদার তাদের পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানোর শর্ত থাকে। এর ফলে ঋণ নেওয়ার পর সে অর্থ খরচে সরকারের হাতে কর্তৃত্ব থাকে না। দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে চূড়ান্ত করা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও থাকে উন্নয়ন সহযোগীদের হাতে। তবে চীনের উদ্যোগে আগামী বছর জানুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করতে যাওয়া এআইআইবি থেকে এসব শর্ত মেনে ঋণ নেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
এম এ মান্নান বলেন, এআইআই ব্যাংক গঠনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এশিয়ার অবকাঠামো এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্পদ বাড়ানো। একই সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সংযোগ বাড়ানো। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়নে বাধা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা অংশীদারিত্ব বাড়াতে একসঙ্গে কাজ করা। এ ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ, যাদের অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা রয়েছে। এআইআই ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বিকল্প অর্থের উৎস তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
এআইআই ব্যাংকের মোট শেয়ারের ২৯ ভাগই চীনের দখলে। শেয়ার পাওয়ার দিক দিয়ে দেশটি শীর্ষে। ৮ শতাংশ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। ৪ শতাংশ শেয়ার নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে জার্মানি। এরপর যথাক্রমে রয়েছে রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রাজিল। ভোটের দিকেও চীন শীর্ষে। চীনের ভোট প্রায় তিন লাখ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের ভোটের সংখ্যা ৮৬ হাজার।