মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বানভাসী মানুষ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এখন বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।  সরকারের দেওয়া তথ্যানুয়ায়ী বন্যায়  ২৭ টি জেলায়   এ অবধি (১৯/৮/১৭ইং) ৫৭ লাখ ১৯ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে এবং বিদ্যৎস্পৃষ্ট হয়ে  মৃত্যু হয়েছে ৯৬ জনের। এর মধ্যে কয়েকটা জেলার অবস্থা বেশ খারাপ। অনেক মানুষ এখানে তাদের সহায় সম্বল হারিয়েছে। মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু জলমগ্ন হয়ে পড়ায় খোলা আকাশের নিচে তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত হয়েছে খাবারের অপ্রতুলতা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এসব মানুষের কাছে ত্রান পৌঁছানোও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকারের পাশিাপাশি সামর্থ্যবান মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

বন্যায় স্থাবর অস্থাবর সম্পদের ক্ষতির পাশাপাশি বন্যাক্রান্ত মানুষগুলো নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হয়ে থাকে। সব থেকে বড় সমস্যা যেটা হয় সেটা হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে খাবার পানির অভাব। একাধারে খাবার, শোবার এবং পানির কষ্টে মানুষগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। জীবন ও জীবিকার চিন্তায়  অস্থির হয়ে পড়া এ মানুষগুলোর তাই নানা রকম শারীরিক এবং মাসুষিক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

একটা এলাকা যখন তলিয়ে যায় তখন সেখানের পানিতে মিশে যায় মানুষ এবং পশুপাখির মলমূত্র, মৃত গবাদী- পশুপাখি এবং গাছপালার পঁচা অংশ সহ নানা রকম ক্ষতিকর জীবানু। ফলে এ পানি খাওয়ার একদমই অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।এমনকি এ পানি গোসল, বাসন কোসন ধোঁয়ারও অনুপযুক্ত। তাই পানিকে পানের উপযুক্ত করাটা ভীষন গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সহজ এবং প্রচলিত উপায় হচ্ছে, (১) পানি ফুটিয়ে পান করা। (২) ফুটানো সম্ভবপর না হলে এক গ্যালন পানিতে এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার (৪-৬% ক্লোরিনযুক্ত) বা ফিটকিরি ভালোভাবে মেশানোর পর ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তার পর ওপরের পরিষ্কার পানি পান করতে হবে। (৩) এ ছাড়া একটি হ্যালোট্যাব ২০ লিটার পানিতে দিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর সে পানিও পান করা যায়।

পানির মাধ্যমে ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস , আমাশয়, কৃমি, চোখ ওঠাসহ নানা রোগ শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনিতেই  খাবারের অপ্রতুলতায় মানুষের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে বিধায় তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা কমে যায় । এমতাবস্থায় যদি পেটের পীড়াসহ সংক্রামক নানা রোগব্যাধি আক্রমণ করে তখন তার ধকল কাটিয়ে ওঠা  সত্যি সত্যি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ তো গেল শারীরিক ক্ষতির দিক।কিন্তু মানষিক ক্ষতি? সেটাও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। বন্যা আক্রান্ত মানুষগুলোর মনে যে অসহায়ত্ব ভর করে  তার ফলে যে মানুষিক ক্ষতি সেটা আমরা একদমই গোনার মধ্যেই আনি না।

বন্যায় মানুষগুলো তাদের ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপনে বাধ্য হয়। অথচ এ মানুষগুলোর একটা সুন্দর জীবন ছিলো। তারাও জীবন জীবিকার তাগিদে কর্মব্যস্ত সময় পার করে  বাড়িতে এসে প্রিয়জনদের সঙ্গে একটা সুন্দর সময় পার করতো।কারো মুখাপেক্ষী হয়ে তাকে দিন কাটাতো হতো না। একদিন আগে যা ছিলো বাস্তব; সেটাই বন্যার কারণে হয়তো দিনের ব্যবধানে হয়ে গেলো স্বপ্নসম। যে মানুষটা  নিজেই হয়ত নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতো সেই মানুষটিই আজ পরনির্ভরশীল হয়ে গেল। তারই এখন সাহায্যের দরকার।ভাবা যায়?এমন মানষিক কষ্ট বা আঘাত-একে যাই বলুন না কেন তা কিন্তু কোন অংশেই কম নয়!
ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে এ সময় এক অজানা আতংকে পরিবারে সকলের সময় কাটে। একে তো বাচ্চাগুলোর পেটে খিদে—বাবা-মা তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারে না।আছে খাবার পানির কষ্টও। তা উপরে রয়েছে একটু অসতর্ক বা অসাবধান হলেই সদা সর্বদা বাচ্চাগুলোর পানিতে পড়ে  মারা যাওয়ার আশংকা।আছে গর্ভবতী মায়েদের সন্তান জন্মদানের পরিবেশ এবং দরকার হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অপ্রতুলতা।  আছে বিষধর সাপে কাটার আতংক।এমন আতংক নিয়ে বন্যাক্রান্ত মানুষগুলো কেমনে মানষিকভাবে ভালো থাকবে বলুন? ফলে বন্যা যত দীর্ঘস্থায়ী হবে মানুষগুলোর ভোগান্তি ততই বাড়বে। তারা তত বেশি অসহায় পড়বে।ফলে তাদের মানষিক জোরটাও এক সময়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।

তাই বন্যার সময় ত্রান এবং বন্যা পরবর্তী  পুনর্বাসন কর্মকান্ডে তাই তীক্ষ্ন নজর দিতে হবে।। খাবার দাবারের সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন-এসব সরবরাহ করতে হবে।এ সময়ে যদি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও জলমগ্ন হয়ে পড়ে তাহলে ভ্রাম্যমান হাসপাতাল পরিচালনা করা যেতে পারে একদম প্রাথমিক চিকিৎসা চালিয়ে নেয়ার জন্য। আর গুরুতর ক্ষেত্রে আক্রান্ত মানুষদেরকে থানা এবং সদর হাসপাতাল বা আশেপাশে যেখানে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে সেখানে দ্রুত স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমার মনে হয় অন্ততপক্ষে বন্যা নেমে যাওয়ার পরেও মাসখানেক অবধি জরুরি চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরও শারীরিক নানা রোগব্যাধির আক্রমন কিন্তু চলতেই থাকে।তাই  গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে পাঠাতে হবে আক্রান্ত মানুষগুলোর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অভিযোগের খোঁজ খবর নিতে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশেষ করে টিভি এবং রেডিওতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বুলেটিন তৈরি করে তা নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে হবে।পত্রিকাগুলোও স্ব-উদ্যোগে মানুষ এবং গবাদী পশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নানা ধরনের কৌশল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপাতে পারে।

আমাদের বিগত সময়ের বন্যা এবং বন্যা সরে যাওয়ার পরে কাজ করতে যেয়ে যে  অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে সেটা তো বিস্তর। সেগুলোর আলোকে এবং বর্তমান সময়ের সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার নিরসনকল্পে কেন্দ্রীয়ভাবে যে কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে তাদেরকে মাঠ পর্যায়ে এখন কি কাজ হচ্ছে  এবং প্রেরিত নির্দেশনাগুলো ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা কঠোরভাবে দেখতে হবে। কোনো সমস্যা মাঠ পর্যায় থেকে এলে তার তাৎক্ষণিক সমাধানও দিতে হবে।এভাবে সমন্বিত কর্মকাণ্ড গ্রহণ করলে আশা করা যায় বন্যা এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিকাটিয়ে ওঠা  দ্রুত সম্ভবপর হতে পারে। সবরকম ক্ষয়ক্ষতি আমাদের আক্রান্ত মানুষগুলো যেন দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে সবার মতো আমিও  কায়মনোবাক্যে সে কামনাই করছি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর