আমি একা ‘হিরো’ হব কেন, পুলিশের প্রত্যেক সদস্য ‘হিরো’ : বিপ্লব কুমার সরকার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  প্রচলিত পুলিশ চরিত্রের র্ফম ভেঙ্গে যিনি হিরো হয়ে উঠেছেন, তিনিই বিল্পব কুমার সরকার। অর্জন করেছেন বিপিএম, পিপিএম পদক। তার চেয়েও বড় অর্জন সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে নিজের ইমেজ গড়ে ওঠা। পুলিশের সংকট সম্ভাবনা, নতুন ইউনিট, জঙ্গিবাদ আর নিজের ব্যক্তি চরিত্রের মূল্যায়ন, সব প্রসঙ্গেই আজ সারাবেলা’র সঙ্গে মন খুলে কথা বলেছেন রাজধানীর তেজগাঁও ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন এবং ছবি তুলেছেন সোহেল রানা রিপন।

ব্যক্তিগত জায়গায় যদি আসি, দেখা যাবে, আপনার শৈশব ও কৈশর অতিক্রম করেছেন যখন স্বৈরশাসনকাল। শিক্ষাজীবন, মূলত উচ্চশিক্ষার সময়টা, একধরনের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে কেটেছে। স্বাধীনতার ৪৬ বৎসর পার করছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ একমাত্র বাহিনী যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের সরকার। সেই বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে এই সময়টাতে কেমন লাগছে? কেমন কাটছে আপনার?

বিপ্লব কুমার সরকার: আমার অনুভূতি অবশ্যই ইতিবাচক। বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য হতে পেরে আমি অবশ্যই সম্মানিত বোধ করি। বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। একটা কথা আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, ‘একমাত্র’ এই পেশাটায় মানুষকে অনেক বেশি সহযোগিতা করা যায়, উপকার করা যায়। মানুষকে খুব সরাসরি উপকার করার সুযোগ এখানে অনেক বেশি। সমাজের প্রান্তিকজন থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণী যে কাউকে সেবা দেওয়ার সুযোগ এখানে রয়েছে। সে দিক থেকে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। কেননা সত্যি বলতে, আমি পুলিশ সদস্যই হতে চেয়েছি। একথাটি বোধ হয় আমি আগেও বলেছি।

আর সরকারের কথা যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, বাংলাদেশ দর্শনে বিশ্বাসী সরকার, পুলিশকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ঠিক ততটাই দিচ্ছে। পুলিশের উন্নয়নে সরকার প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের সেবায় নিয়োজিত পুলিশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে, সরকার বিনিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করে না। কারণ এই বিনিয়োগের আউটপুট বা আউটকাম সরাসরি জনগণই ভোগ করছে। ফল পাচ্ছে। বর্তমান সরকার এই লক্ষ্যেই পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা অনাকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি। পেশাগত জায়গা থেকে এটা অনেক বড় স্বস্থি ও প্রাপ্তি।

পুলিশ বিনয়, মেধা, দক্ষতা-এমন অনেক গুনের সমন্বয়ে শব্দটি গড়া। দারুণ কম্বিনেশন। পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু পাবলিক পারসেপশনে কেন জানি, মানুষ পুলিশকে বন্ধু মনে করে না। এই মনোভঙ্গিটা কেন? কি মনে হয় আপনার?

বিপ্লব কুমার সরকার: আপনি ভুল বলেননি। মিথ্যা বলেছেন সেটাও বলবো না। কিন্তু এটার মধ্যে যথার্থ সত্য নেই, এটাও সত্য। মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে এই সমাজে অনেক নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। পুলিশ এই সমাজের বাইরের কেউ নয়। ভিনগ্রহী কেউ নয়। সমাজ যেমন, পুলিশও তেমন। সমাজের নানা কিছু তাকে প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেই বলেছেন, পারসেপশন। পারসেপশন তো ম্যান টু ম্যান ভেরি করে। একটা কথা আমি প্রায়ই বলি, সাধারণভাবে লোকে মনে করে, পুলিশ ঘুষ খায়। কিন্তু যদি জানতে চাওয়া হয় দেখা যাবে একজন লোক হয়তো কখনো পুলিশের কাছে যায়ইনি। কিন্তু সে মনে করে পুলিশ ঘুষ খায়। দ্যাট ইজ পারসেপশন। তার মনে হয়। এটা ধারণা মাত্র।

আমি ঠিক এই জায়গাটিতেই আসতে চেয়েছি। এই যে যায়ইনি কিন্তু তারপরও তার মনে হয়, এই মনে হওয়াটি কেন?

বিপ্লব কুমার সরকার: এখানে মনে হওয়ার অনেক কারণ। অনেক ফ্যাক্টরস রয়েছে। দেখতে হবে আমার জন্মটা কিভাবে? জনগণের সেবক হিসাবে আমাদের জন্ম হয়নি। আমাদের জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের নির্যাতনকারী হিসাবে। তাদের খাজনা আদায়কারী নিবর্তকের ভ‚মিকায় ছিল পুলিশ। এই জনপদে পুলিশ ছিল ব্রিটিশদের লাঠিয়াল বাহিনী। যার কারণে পুলিশ সম্পর্কে উপনিবেশিক যে ধারণা ও মানসিকতা সেটা এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু সেই পুলিশের সঙ্গে আজকের আধুনিক পুলিশকে এক করে দেখলে হবে না। আজকের পুলিশ, আজকের বাংলাদেশ পুলিশ, তারা চিন্তা চেতনায় অগ্রসর, আধুনিক, প্রযুক্তি নির্ভর। তবে ১ লাখ ৯০ হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছে। তাদের সকলেই তাদের দায়িত্বে শতভাগ সৎ এমনটি আমি বলবো না। কেউ কেউ হয়তো খারাপ বা বিপথগামী লোক রয়েছে। তবে আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি তাদের শাস্তির মধ্যে নিয়ে এসে, যারা ভালো তাদের ভালো ভালো দায়িত্ব দিয়ে জনগণের সেবার মানকে আরো উন্নত করতে। আমি জনগণের কাছে একটা কথাই বলবো, পুলিশ কেমন সেটা জানতে, যাচাই করতে, যে কোন প্রয়োজনে পুলিশের সংস্পর্শে আসুন। আপনার প্রয়োজনটা জানান। আইনি সহায়তা চান।

কিন্তু স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত একটি বাহিনী, যার কোন কোন সদস্য, ছোট খাটো অন্যায় অপরাধ বিচ্যুতি নয়, কখনো কখনো চুরি, ছিনতাই, মাদকপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের বড় অপরাধে সরাসরি জড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে এসব খবরও এসেছে, তার প্রমাণও রয়েছে। তখন কেমন লাগে আপনার?

বিপ্লব কুমার সরকার: যখন একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কোন সদস্য কোন ধরনের অপরাধে নিজেকে যুক্ত করে তখন আমি লজ্জিত হই, দুঃখ পাই, কষ্ট লাগে। বাহিনীর ইমেজ তখন প্রশ্নের মুখে পড়ে। আমাদের সবারই তখন লজ্জা হয়। আমি আগেও বলেছি, এক লাখ নব্বই হাজার সদস্যের সবাই এক নয়। কিন্তু এটাও সত্য, কিছু বিপথগামী ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান কেন নেবে? যার যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকেই করতে হবে। প্রতিবছর আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আমরা যতজন অপরাধী সদস্যকে শাস্তি দিচ্ছি, বাংলাদেশে আর কোন প্রতিষ্ঠান তা করে না। আমি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে দোষও দিচ্ছি না। কিন্তু এটা একমাত্র আমরাই করে থাকি।

আপনি বিভাগীয় তদন্তের কথা বলেছেন। দেখা যায়, পুলিশের কোন সদস্য অন্যায় অপরাধ করে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে ক্লোজ বা সাসপেন্ড হলো। কিন্তু এই সময়টাতে তার কোন কাউন্সেলিং হয় না, তাকে কোনভাবে মোটিভেট করা হয় না। বরং সে একধরনের ‘হাইবারনেশন’ বা ‘শীতনিন্দ্রায়’ থাকে। অপরাধ প্রবণতা তার মধ্যে থেকেই যায়। যদি ব্যাখ্যা করে বলেন, এটা কি যথার্থ সমাধান?

বিপ্লব কুমার সরকার: আপনি ঠিকই বলেছেন। শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে অপরাধ নিবারন কঠিন। হয়তো সবক্ষেত্রে সফলও হওয়া যায় না। তারপরও অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে, এটি প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন।পাশাপাশি যদি তাকে কাউন্সেলিং করা যায়, সে যেন পুনরায় অপরাধ না করে তার মধ্যে এই বোধটুকু জাগিয়ে তোলা খুব জরুরি।

আমার যেটা মনে হয়, একজন অপরাধী পুলিশ সদস্য, যাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, সে হয়তো এক ধরনের ‘আফসোস’ বোধ করে যে, আমি দায়িত্ব ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে দূরে রয়েছি। কিন্তু তার ‘অনুশোচনা’ হয় কি না সেটা খুব জরুরি। কারণ ‘আফসোস’ ও ‘অনুশোচনা’ শব্দ দুটোর ভিন্ন অর্থ রয়েছে।

বিপ্লব কুমার সরকার: অনুশোচনা তার হয় কি না এটা কিভাবে নির্ণয় করবেন? এটা বলা খুব মুশকিল।

বাইরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। আমার এক বন্ধু ফরাসি পুলিশে কাজ করে। সাইকোএনালিস্ট। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিং হয়। কাউন্সেলিংয়ের একপর্যায়ে কেন অপরাধ করেছে, তার এ প্রবণতার মাত্রা, কোন বিকৃতি আছে কি না, সে অনুশোচনা বোধ করে কি না- সকল বিষয় প্রকাশিত হয়। যা এখানে হয় না মোটেও।

বিপ্লব কুমার সরকার: আপনার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা করা গেলে ভাল হতো। একটি অপরাধ হয়তো সে করছে কিন্তু পরবর্তীতে সে অপরাধ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসবে। হয়তো আর কোনদিনই এধরনের অথবা কোন ধরনের অপরাধ আর করবে না। তবে খুব অফিসিয়ালি না হলেও আমরাও কিন্তু কেউ অপরাধ করলে তদন্ত চলাকালীন তাকে ডাকি। কথা বলি। তাকে বোঝাবার চেষ্টা করি এই কাজটিতে কী নিজের সম্মান বৃদ্ধি হয়েছে না বাহিনীর? সে শুধু নিজের ক্ষতি করেনি, পরিবারের, সমাজের, সর্বোপরি বাহিনীর ক্ষতি- এটা খুব ভালোভাবে বোঝাবার চেষ্টা করি। লেভেল ওয়াইজ আলোচনা হয়। একজন কনস্টেবল কে থানার ওসি বোঝান। আমি হয়ত আরেকটু উপরের পর্যায়ে আলোচনা করি। কথা কিন্তু বলা হয়। পাশাপাশি সঠিক তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করি।

কমিউনিটি পুলিশিং এর দিকে আসি। জানতে চাইবো কতটা কার্যকর, সফল এবং এর ভবিষ্যৎ কী?

বিপ্লব কুমার সরকার: কমিউনিটি পুলিশিং আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ। আমরা কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকিনি। চিন্তায়, কর্মে এই স্লোগান আমরা বিশ্বাস করি। কমিউনিটি পুলিশিং-এর আরেকটা পার্ট বিট পুলিশিং, যাতে আমরা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছি। একটি থানাকে ৮-১০টি বিটে ভাগ করি। এলাকার জনগণকে আমাদের কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করি। ইতিমধ্যেই তথ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। মানুষ আমাদের কাছে তথ্য দিচ্ছে। সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (CIMS) চালু হওয়ায় অপরাধের মাত্রা অনেক কমে গিয়েছে। অপরাধ সংগঠনের আগেই জনগণ স্বর্তঃস্ফর্তভাবে তথ্য দিচ্ছে। যাচাই করছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি। ফল পাচ্ছি। সেদিক থেকে কমিউনিটি পুলিশিং দুর্দান্ত সফল ও কার্যকর বলা যায় নিশ্চিতভাবে।

রিলিজিয়াস টেররিজম বা জঙ্গিবাদ এখানে নতুন উপদ্রব। জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমরা কতটা প্রস্তুত, কতটা সফল?

বিপ্লব কুমার সরকার: জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় উগ্রবাদ যেভাবেই বলেন সমস্যাটা মূলত গ্লোবাল। সেটার ধাক্কা বা প্রবাহই এখানে এসে লেগেছে। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় উগ্রবাদি তারা বাইরের ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের অনুকরণ করে। তাদের মত আচরণ করতে চায়। বাইরে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, তারা এখানে চেষ্টা করে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ করা যায় কি না। বাইরে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তারা এখানেও চেষ্টা করতে পারে সেটা করতে। বিদেশি নাগরিক, মসজিদের ইমাম, প্রকাশক, শিক্ষক- এমন নানাজনকে হত্যার একটা চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় হলি আর্টিজানের মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সাঁড়াশি অভিযানের মধ্য দিয়ে এসব ঘটনা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আমি কখনো বলবো না আমরা সন্ত্রাসবাদ পুরোপুরি নির্মূল করতে পেরেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই ধরনের সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে না পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দমন কার্যক্রম চলবেই।

আপনি কি মনে করেন জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমরা যে ধরনের অভিযান করছি সেটাই যথেষ্ট?

বিপ্লব কুমার সরকার: জঙ্গিবাদ একটি সামাজিক, রাজনৈতিক সংকট। আমরা যেটা করতে পারি, উগ্রবাদিদের ধরে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারি। যদি ধরতে গিয়ে তারা আমাদের কোন ধরনের আক্রমণ করে সেক্ষেত্রে বন্দুকযুদ্ধ সংগঠিত হতে পারে। তাদের ধারণা তারা একটি আদর্শিক যুদ্ধ করছে। তাদের এই ‘তথাকথিত আদর্শিক লড়াই’ বা আক্রমণকে শুধুমাত্র বন্দুককের গুলি দিয়ে বা আইন দিয়ে মোকাবেলা করা অনেক সময় কঠিন। বিপ্লবের বিপরীতে যেমন প্রতিবিপ্লব, তেমনি তথাকথিত আদর্শের বিপরীতে ধর্মের প্রকৃত আদর্শকে দাঁড় করাতে হবে। কোন ধর্মই সন্ত্রাসবাদ অনুমোদন করে না। তারা যে ভুল পথে প্রচালিত হচ্ছে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে, বিকৃত করছে- এটা তুলে ধরতে হবে। কেবল একা পুলিশ নয়, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সকল পেশাজীবীদের সচেতনতা জরুরি, যাতে ধর্মের সত্যিকার সৌন্দর্য ও বাণী প্রচারিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ধর্মীয় নেতাদেরকে আহবান করেছেন এবং তারা কার্যকর ভূমিকা পালনও করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি একধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিপ্লবও প্রয়োজন ধর্মীয় উগ্রবাদ নির্র্মূলে।

পুলিশের নতুন নতুন ইউনিট খোলা হচ্ছে। নৌপুলিশ, ট্যুরিস্টপুলিশ এতটা ওয়ার্ককেবল নয়, এমনটা বলছেন অনেকে।

বিপ্লব কুমার সরকার: এক্ষেত্রে আমি ভিন্নমত পোষণ করবো। একটু ব্যাখ্যা করি। আমরা যদি কোন জঙ্গিকে ধরি বা জঙ্গি আস্তানায় হানা দেই, তখন সেটা প্রচারে আসে কিন্তু একই কার্যক্রম যখন গোপনে করি বা হামলা হতে পারে, হামলা হয় না, সেসব কিন্তু মানুষ জানতে পারে না। জানার কথাও নয়। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অসংখ্য ইতিবাচক কার্যক্রম রয়েছে যেটা সবসময় আলোতে আসে না। মিডিয়াতেও আসে না। মানুষ জানতে পারে না। নৌপুলিশ, ট্যুরিস্টপুলিশ নবসৃষ্ট ইউনিট। অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। একটা ইউনিট গঠিত হবার কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। আমি এটা মনে করি না। যখন সেই ইউনিট তার লজিস্টিক সকল সাপোর্ট পাবে তখন ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ বিকাশ লাভ করবে। নৌপুলিশের কর্মকান্ডের কারণে নৌপথে অপরাধের মাত্রা অনেক কমেছে। ট্যুরিস্টপুলিশও তাই। পর্যটন স্পটগুলো আগের চেয়ে অনেক নিরাপদ। আশা করি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাদের কার্যক্রমও পূর্ণাঙ্গভাবে দৃর্শ্যমান হবে।

ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশ পুলিশে অনেকে সুনাম ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু আপনি তার মধ্যেও নিজের একটি আলাদা ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন। ইংরেজি দৈনিক ‘দি ডেইলি স্টার’ আপনাকে নিয়ে স্টোরি করেছে, সেখানে আপনাকে বলা হয়েছে ‘হিরো’। ‘সাপ্তাহিক কাগজ’ আপনাকে প্রচ্ছদে এনেছে। এই যে ইমেজ ব্র্যান্ডিং, হিরো হয়ে উঠা কিভাবে? আপনার মূল্যায়ন কি?

বিপ্লব কুমার সরকার: হিরো তো আসলে একটি কনসেপ্ট। একটা চরিত্র। পর্দায় যে প্রতিবাদ করে, অন্যায় কে বাধা দেয়, রুখে দাঁড়ায়, তাকেই লোকে হিরো বলে। বাস্তবেও তাই। পুলিশের প্রত্যেক সদস্য ‘হিরো’, যারা সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করছে। আমি একা হিরো হব কেন? আমার কাছে হিরোর কনসেপ্টটা তা-ই। বাঙালি জীবনের যেমন সবচেয়ে বড় হিরো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি এই বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। এই জাতিকে আলোর পথ, মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সব সময় মনে করি, আমার উপর যে অর্পিত দায়িত্ব তা যথাযথভাবে পালন করতে পারছি কি না? আমি ন্যায়ের মধ্যে থেকে মানুষকে সেবা দিতে পারছি কি না সেটাই বড় আমার কাছে।

শেষ প্রশ্ন। ব্যক্তি বিপ্লব, আপনি কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো বন্ধু। আপনার নিজেকে আপনি কি বলতে চান? নিজের কাছে নিজের চাওয়াটা কি?

বিপ্লব কুমার সরকার: আমার প্রথম পরিচয়, আমি একজন মানুষ। তারপরই নিজের কাছে আমার পরিচয়, আমি একজন পুলিশ কর্মকর্তা। নিজের কাছে আমার নিজেকে বলা, যে পেশায় আমি রয়েছি, যে পোশাক আমি পরিধান করেছি, এই পোশাকের মর্যাদা যেন আমি রক্ষা করি। যেন আমার দ্বারা কোন অবমান না হয় এই পোশাকের।

৫ মে, ২০১৩ সাল। হেফাজতের সেই তান্ডবের দিন। বাংলাদেশ পুলিশ তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সে তান্ডব প্রতিহত করেছিল। হেফাজত যদি সেদিন সফল হতো বাংলাদেশের ইতিহাস পাল্টে যেত। আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হতো বাংলাদেশ। পিছিয়ে যেতাম আমরা ৫০ বছর, ১০০ বছর। সে দিনের সে অপারেশনে থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। সে জন্য আমি গর্ববোধ করি।

একথা একারণে বললাম, যে পোশাক পরিধান করেছি, সে পোশাকের মর্যাদা রক্ষার জন্য, সর্বোপরি দেশের জন্য যে কোন ধরনের ত্যাগ করার জন্য আমি সব সময় যেন নিজেকে প্রস্তুত রাখি। জীবনের যে স্বপ্ন ও সংগ্রাম, একজন ভাল মানুষ হওয়া, তা যেন অব্যাহত থাকে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর